শুধুমাত্র ভাষা দিবসের একটি দিনে ভাষাকে নিয়ে আদিখ্যেতা আমার একদম পছন্দ নয়। আমার কাছে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই ভাষা দিবস। একটি বিশেষ দিনে সেটা নিয়ে খানিক বাড়তি আলোচনা; এই টুকুই। গত রোববার রোটেশন ডিউটি ছিল। তারপর সোমবার আউটডোর মানে রোগীর জলোচ্ছ্বাস। রাজ্য, রাজ্যের বাইরের যাবতীয় সমাধান না হওয়া রোগীর ভীড়ে ছোট্ট আউটডোর প্রাঙ্গন ভেসে যায়। খাতায়-কলমে আউটডোর শেষ হওয়ার কথা দুপুর দু’টোয় কিন্তু কোনদিনই প্রায় আড়াইটে তিনটের আগে শেষ হয় না। এদিনও আউটডোর শেষ হতে প্রায় তিনটে। তারপর আইসিইউতে নতুন ভর্তি হওয়া একটি বাচ্চাকে দেখতে ছুটলাম। এগারো বছরের বেশ মোটাসোটা বাচ্চা। দু চোখ টকটকে লাল, গোটা গায়ে র্যাশ, সাত দিনের জ্বর, সাথে পাতলা পায়খানা। সমস্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হ’ল। খুব সম্ভবত কোভিড পরবর্তী জটিলতা। বাচ্চা বেশ নেতিয়ে পড়েছে।
তখনো স্নান হয়নি, খাওয়া হয়নি। দুদ্দাড় করে তিন তলা থেকে নেমে এসে খেতে বসলাম। স্নান সেরে উঠতে উঠতে বিকেল চারটে। একটু বাদেই আরশি আর পিয়ালী এলো। ভাষা দিবসের দিনে সুবর্ণ বণিক সমাজ হলে ডক্টরস ডায়ালগের অনুষ্ঠান। কোনোরকমে পাঞ্জাবীটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল…
এসে তো রীতিমতো চমকে গেছি! এ যে পুরো চাঁদের হাট! গতবারের অনুষ্ঠানে আসতে পারিনি। এবারে আর সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই ছিল না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তারাদের ভিড়ে। যাঁদের লেখা, গান, কাজকর্মের আমি রীতিমতো ফ্যান স্বয়ং তাঁরাই সশরীরে আমার চোখের সামনে! যাঁর হাত দিয়ে তলোয়ারের মতো ধারালো প্রবন্ধ বেরোয় সেই বিষাণ বসু মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্চের ওপরে বসে আছেন সমুদ্র সেনগুপ্ত। বিভিন্ন বিষয়ে যাঁর জ্ঞান আক্ষরিক অর্থেই সমুদ্রের মতো। বিতর্ক সভায় যাঁরা আলগোছে মণিমুক্তো ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কারো নাম অভিজিৎ মুখার্জি, কেউ কবি আর্যতীর্থ, কেউ কাঞ্চন মুখার্জি। আমি এমনিতেই গুটিয়েসুটিয়ে থাকা লোক। তারপর এত লোকজন দেখে এমনিতেই হকচকিয়ে গেছি। মাঝে মাঝে পুণ্যদা, জয়ন্তদা, ঐন্দ্রিলদাদের মতো পরিচিত মুখ দেখলে একটু হাঁফ ছেড়ে নিচ্ছি। হঠাৎই সামনে কৌশিক লাহিড়ী! দেখে আমার প্রায় শামুকের মতো খোলসে ঢুকে যাওয়ার উপক্রম। যদিও সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও কৌশিকদার সাথে এক-দু’বার সরাসরি কথা হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত কৌশিকদার ব্যারিটোন গলা শুনছি। নিজের লেখা বই সই করে আমার হাতে তুলে দিলো।
দোলনচাঁপাদি, সুবর্ণদা, ইন্দ্রনীলদা, অরুণাচল স্যার, দীপঙ্কর স্যার… কাকে ছেড়ে কার কথা বলি… প্রায় সবাই বয়সে, ধারে, ভারে ঘাড় উঁচু করে দেখার মতো মানুষ। ওপরে তাকাতে তাকাতে আমার তো রীতিমতো ঘাড় ব্যথা করতে শুরু করেছে। আমার কাছাকাছি বয়সী লোকজন বলতে মানসদা, অর্কদা, শুভেন্দুদা, মৃন্ময়, শুভাংশু, দীপাঞ্জয়।
আরশি এর মধ্যে সবার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। বকবক করে আশেপাশের সবার কানের পোকা বের করে দিয়েছে। মাঝেমধ্যেই চেঁচিয়ে উঠছে “বাবা, তোমাকে ‘গোলাপি কিছু’ কখন দেবে?” গোলাপি রঙের প্রতি আরশির ভয়ানক আকর্ষণ। গত সপ্তাহে যখনই শুনেছে বাবার অনুষ্ঠানে যাবে সেদিন থেকেই কয়েকশো বার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে “সেখানে কি তোমাকে ‘গোলাপি কিছু’ দেবে?” ‘গোলাপি কিছু’ দিতে এত বিলম্ব দেখে স্বাভাবিকভাবেই আরশির আর তর সইছে না। এদিকে সব অপরিচিত লোকজন ভাব জমাতে চাইছেন… ব্যাপারটা তার একদমই পছন্দ হচ্ছে না। বাবার কোলে উঠে একদম লেপ্টে থাকছে। তারপর প্রতি মিনিটে একবার করে ‘গোলাপি কিছু’র খোঁজ। শেষমেষ বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
এরমধ্যেই মঞ্চে কিছু বলার জন্য আমার ডাক পড়লো। মিনিট পাঁচেক পাগলের প্রলাপের মত যা যা বলেছিলাম তার সারমর্ম মোটামুটি এরকম… ডাক্তারির ভাষা অর্থাৎ বিভিন্ন ডাক্তারি পরিভাষার মত নিজের মুখের কথাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লেপ্টোস্পাইরা ইক্টেরোহেমারেজিকা যতখানি দরকার ঠিক ততখানিই দরকার “ডাক্তারবাবু বাচ্চাটার তিনদিন হাগা হয় নাই। পাদাও বন্ধ। পেটটা ফুলে গিসে।” জেলার ভাষা, প্রান্তিক মানুষের ভাষা আরো সামনে উঠে আসা দরকার। ভাষা মানে শুধুই ‘ঠোঁট খুলবো না’ পণ করে বলা সুললিত বাংলা কিংবা আলতো জিভ উল্টে ‘স’ বলা নয়। ভাষা মানে খাইসে, যাইসে, খাতি যাবা, করছু, পড়ছু ইত্যাদি সবকিছু। ভাষা মানে ‘গেদে জ্বর’, ভাষা মানে ‘দমে কাশি’, ‘বাচ্চা পারে নি’। জেলার ভাষা মূলধারায় না উঠে এলে ভাষা নিয়ে আলোচনার পুরোটাই ফাঁকি। তার জন্য সবার আগে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর বেঁচে থাকা দরকার। পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশের কোনও মানুষের হাতে ‘আরণ্যক’ বা ‘পথের পাঁচালী’ উঠে আসা যতটা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার হাতে ‘সহজপাঠ’ উঠে আসা… এইসব আবোলতাবোল বলে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম। ইতিমধ্যে কয়েকজন আমার লেখা ভালো লাগে বলে জানিয়েও গেলেন। সেটা সম্ভবত ছোটদের উৎসাহ দেওয়ার কথা ভেবে।
ততক্ষণে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে, অনেকটা রাস্তা। নাটকটা দেখা হলো না। হাতের ঝোলাটায় অনেকগুলো বই ভরে নিয়েছি। দ্বিতীয় ডক্টরস’ ডায়েরীর একজন লেখক হিসেবে কলমের নিব বসানো স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছি। জীবনে পুরস্কার বা উপহার পেয়েছি অগুনতি কিন্তু লেখক হিসেবে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। সোনারঙা স্মারকটা হাতে নিয়ে আরশি ভীষণ খুশি। বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে…
গাড়িতে বাবা-মার মাঝে বসে ফেরার সময় আবার সেই ‘গোলাপি কিছু’র কথা মনে পড়ে গেল। কোনোরকমে রাস্তার পাশে একটা দুটো গোলাপি আলো দেখিয়ে নিরস্ত করা গেল। আরশি রাস্তার সিগন্যালের মানে বুঝতে শিখে গেছে- লাল মানে থামতে হবে, সবুজ মানে যেতে হবে। এদিকে সামনের গাড়িগুলোর সবার ব্যাকলাইট লাল। আরশি ড্রাইভার কাকুকে খুব বকে দিয়েছে- “লাল আলো। তবু যাচ্ছো কেন?” পুরো রাস্তা অবিরাম বকবক করে শেষের দিকে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে…
রাত গভীর হচ্ছে। যেতে যেতে কথা কানে আসছে- “কেন কী, বিন্দাস থাকাটাই আসল কথা।”
আরও একটা ভাষা দিবস গেলো। আজকের মতো আমার ফালতু লেখাও ফুরোলো।