আগের দিন কাজের মহিলাটিকে শাড়ি কেনার জন্য একটু বেশি টাকা দেওয়া নিয়ে, সকালে বেরোতে যাওয়ার আগে জিনাতের সঙ্গে রোহণেরর এক রাউণ্ড তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষ হয়ে কাজের মেয়েকে তোল্লা দেওয়া ! ‘ঘরে ফিরে আস , তারপর দেখাবো তোমার দিন কি আমার দিন !’ বলে, ধমকে রেখেছে জিনাত। মনে মনে একটু ভয় আর চাপা টেনশন নিয়েই রোহণ একটু রাত করে ঘরে ফিরেছে।
শোবার ঘরে এ সি চালিয়ে, নতুন কেনা প্লাস্টিকের ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে রোহণ রিল্যাক্স করছে। একবার ভয়ে ভয়ে হাঁক পেড়ে বৌকে ডাক দিল। উত্তর পেল না। তিনি এখন টিভিতে ‘চোখের গুড়ে বালি’ দেখছেন। বুঝল যে তিনি এখন এঘরে ঢুকবেন না, মানে, বিপদটা এখনও পেনডিং। যাকগে, যা হবে হবে। দেখা যাবে । চাপ হাল্কা করার জন্য ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে ফেসবুক খুলে দেখতে লাগল। বাহান্নটা নোটিফিকেশন দেখে মন উৎফুল্ল হয়ে গেল রোহণের। বেশ কিছু ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্টও এসেছে। তাদের নাম, ছবি, প্রোফাইল, সব খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। স্থান,কাল, আসন্ন আক্রমণের সম্ভাবনা সব ভুলে বুঁদ হয়ে গেল। খেয়াল করেনি, কখন জীনাত এসে ঘরে ঢুকেছে।
‘শুনছ, এবার ঈদে মাকে একটা দামী কাঞ্জিভরম কিনে দিও’
রোহণ বেহুঁশের মত কিছু একটা শুনতে পেল, ‘ গরম লাগছে তো এই ঘরে এসে বোসো’।
‘তাই বললাম?’ জীনাত অসহিষ্ণু।‘কাজ সেরে এসেই বসে পড়েছ? তোমার ঐ ফেসবুকের জ্বালায়…কী দেখছিলে ওটা? কার ছবি ওটা ? দেখি দেখি।’
‘চিনি না’।
‘চিনি না বললেই হবে ? এত মন দিয়ে দেখছ যে ভরম কে গরম শুনছ!’
‘ছাড়ো ওসব। ও একটা ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট’।
‘রিকোয়েস্ট ? ফুঃ; ঐ বাচ্চা মেয়েগুলো কোন সাহসে তোমাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়? অ্যাঁ? ছেলেপিলে এত বড় বড় হয়ে গেল! তোমার সত্যিই খুব হ্যাবিট খারাপ। আস্কারাটা তুমিই দাও’।
‘আরে না জানো না, সোস্যাল সাইটগুলোতে এসব চলে, তুমি না বুঝেই আবোলতাবোল ভাবো’।
‘আবোল তাবোল কাজ তুমিই কর। এ সময়ে কম্পুটার না করে, ছেলে পড়ছে না অন্য কিছু করছে, সেটা দেখলে তো পারতে’।
‘আমার ছেলে আত্মসচেতন। ছোটবেলা থেকেই ওকে স্বনির্ভর হতে দাও। তবেই বড় হয়ে ও নিজে সব বুঝে নিতে পারবে’।
‘বুঝিনা? সব বুঝি। জাস্ট ফাঁকি মারার ধান্দা। আর বেলাইনে চলে গেলে?’
‘পড়া ধরলেই বুঝি বেলাইন যাওয়া আটকে যাবে? জীবন অত সহজ নয় জিনি ম্যাম; আমি যে লেখা পড়া করেছি, আমার বাপ মা কখনো কিছু দেখেছে? তারা তো ৩০০ মাইল দূরে থাকতো। হঠাৎ হঠাৎ আমদানি হত। গ্রামে এসে বাজারে দোকানদারের মুখে শুনে আসতো যে আমার রেজাল্ট অসাধারণ, আর রাতে মাকে চুপি চুপি বলতো “জানোতো, তোমার এই ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভাল শুনছি”; তাহলে?’
‘ওসব দিন এখন নেই। এখন ছেলে নষ্ট হওয়ার হাতিয়ার অনেক কিছু’।
‘নষ্ট হওয়ার হাতিয়ার সব যুগেই ছিল, যে সময়ে যে রকম’।
‘তোমার সঙ্গে এইজন্য কথা বলতে ভাল লাগে না। খালি নিজের মত করে আজে বাজে যুক্তি। যা বলছি শোন তো’।
‘যার সাথে বকতে ভাল লাগে, তার সাথেই বকবকম করো না । আমি কি বারণ করেছি?’
‘অসহ্য, অসহ্য লাগছে। তুমি বেশ কায়দা করেই আমার কথাটাই শুনলেনা। শুনতে চাইবে কেন? আমার মায়ের জন্য কিছু করা তো তোমার ধাতেই নেই’।
‘তোমার মায়ের জন্য কিছু করিনি বললে? বলতে পারলে?’
‘তোমার মা?’ জীনত এবার সত্যিই ক্ষেপে গেল।‘আমার মাকে “তোমার মা” বলতে তোমার দেখছি সত্যিই এতটুকুও বাধে না; আসলে ঐ যে কী একটা বলে না জন, জামাই…’
‘আহা, তুমিই তো বললে, আমার মা…তাই বলছিলাম, রেসিপ্রোকেট’
‘বাজে কথা রাখো, তুমি সব সময় ঐ ভাষা ব্যবহার কর।বাইরের লোকের কাছে তো খুব রুচিবান, শিক্ষিত মার্জিত হাব ভাব নাও, ভেতরে ভেতরেতো তুমি এইরকম; সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? কই, আমি তো বলি না,’
‘কী বল তুমি?’
‘আমাদের মা’
‘অ, ভেরি গুড; আই অ্যাডমিট মাই মিসটেক ম্যা’ম। ভবিষ্যতে শুধরে নিতে হবে। এখন বল, কী বলতে এসেছিলে’।
‘তুমিই তো তর্ক করতে করতে ঘুলিয়ে দিলে! এখন মনে পড়ছে না কী বলতে এসেছিলাম; ভুলে গেছি’।
জিনাত গজগজ করতে লাগল , ‘উফ, আগে থেকে যদি এতটুকু জানতে পারতাম, তুমি এত ডুপ্লিকেট, তাহলে তোমাকে বিয়েই করতাম না। তার চাইতে ঢের ভাল ছিল মামার এনে দেওয়া ঐ প্রফেসর পাত্রটা। সপ্তাহে অন্ততঃ চারদিন তো ঘরেই থাকতো। কী যে ভূত চেপেছিল তখন!’
‘ও কে। ফরগেট ইট। ইট ইল সারফেস আপ এগেইন, দেন ক্যাচ ইট। নাউ উ্য আর ইন হট মুড।ইয়োর ভরম ইজ গরম’।
সারফেস আপ, ক্যাচ ইট , এইসব খোঁচা বৃথাই গেল। ‘ভরম’ পাসওয়ার্ডে তার ভুলে যাওয়া মেমারি ফাইল ওপেন হয়ে গেল।
‘আরে, তাই তো, এই কথাটাই বলছিলাম। বলছি যে মা কে একটা কাঞ্জিভরম…’
‘কাঞ্জিভরম মেড ইন কাঞ্চিপুরম, ও কে বস, উ্য ইল গেট ইট। নাউ লেটস জয়েন ইন ডিনার।ইটস অলরেডি টুয়েলভ ও ক্লক’।
‘রান্নাই করিনি এখনো। বাবু ডিনার খাবেন! একটা কথা বলতে এলাম, মেজাজটাই বিগড়ে দিলে!’
‘নো প্রবস ডিয়ার, আমি যখন ঢুকি তুমি তো বাথরুমে ছিলে। দ্যাখোনি। ফ্রিজটা খুলে দেখো’।
বিনা প্রতিবাদে জিনি দৌড়োয় ফ্রীজ দেখতে। সেখানে সারি সারি প্যাকেট। পাস্তা উইথ হোয়াইট সস, গ্রেভি ভেজ চাউমিনের প্যাকেট , ড্রাই চিলি চিকেন, মায় একটা বড় কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল ফ্রিজের একটা পুরো র্যাক অধিকার করে বসে আছে।
জিনি হাসিমুখে ঘরে ফিরে এল। তখন রোহণ ফেসবুকে বন্ধুর পাঠানো ভিডিও দেখছে। এখন আবহাওয়া প্রশান্ত।
‘আবার ফেসবুক নিয়ে পড়লে? দেখি একটু; তুমি আমার ছবিটা দেখাওতো’।
‘তোমার ছবি?’
‘আলবাত, আমার ছবি! তুমি কী ভাবছো? জানি না বুঝি? তুমি ফেসবুকে ঢুকিয়েছ!’
‘কে বললে?’
‘তোমার ছেলে! বলল, মা তোমার ছবিতে অনেক লাইক পড়েছে! আচ্ছা, লাইক আবার পড়ে নাকি? লাইক তো মানুষ করে! কবে থেকে আবার পড়তে শুরু করল?’
‘হুম, লাইক আজকাল পড়ে। অনেক পড়ে। গ্রামারই পালটে যাচ্ছে! অক্সফোর্ড ডিক্সনারি খুললে দেখবে। কতরকম ভার্ব অ্যপ্লিকেশন পাল্টাচ্ছে। শর্টেস্ট এসেমেস রাইটিঙ্গসএর ওপর একটা আস্ত প্যারাগ্রাফ’।
ছবি দেখে তার মাথা আরো ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল হয়ে এল।
‘কী করে জানলে আজ রান্না করিনি?’
‘মাইণ্ড রিডিং ম্যাডাম, দিস ইজ সিম্পলি মাইণ্ড রিডিং’
‘আমিও পারি। তুমি ডাক্তারী পড়ে মাইণ্ড রিডিং শিখেছ, আর আমি ডাক্তার চরিয়ে মাইণ্ড রিডিং শিখেছি, তফাৎ এই যা’।
‘খাবারগুলো কি আরো ঠান্ডা হতে থাকবে? নাকি ইউটিলাইজড হবে?’
‘চলো, চলো, বাবুকে ডাকো। তুমি প্লেট বার কর, আমি গরমভরম করি’।
আপাততঃ যুদ্ধবিরতি। দুজনেই ঘনিষ্ঠভাবে চলল ডাইনিং টেবিলের দিকে।