ক্যান্টিনে ঢুকে আমাকে দেখেই তুঙ্গনাথের ভুরু কুঁচকে গেল। কাছে এসে উঁকি দিয়ে আমার কাপের ভেতরে কতটা চা আছে, ঝেড়ে খাওয়া যায় কি না, দেখতে গিয়ে যা দেখল তাতে নাকও কুঁচকে গেল। উলটো দিকের বেঞ্চে বসে বলল, “খাস তো ওই ছাইপাঁশ লেবু চা। ভদ্রমতন চা-ও খেতে জানিস না।”
হাত তুলে ক্যান্টিন-বয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “এক কাপ চা দে। দুধ চা।”
চা তৈরিই থাকত, পট্ করে এক কাপ চা এসে গেল তুঙ্গনাথের সামনে।
আমি বললাম, “লেবু চা খেয়ে দেখেছিস কখনও?”
তুঙ্গনাথ মুখটা বেঁকিয়ে বলল, “আমার অম্বল হয়।”
জানতে চাইলাম, “গ্যাস-ও হয় নিশ্চয়ই?”
আমার প্রশ্নটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “অতটা করে লেবু খালি পেটে খেলে অম্বল হবে না?”
বললাম, “খেতে ভালো হয়। এই ক্যানটিনের পচা লেবুই তো ডালে কচলে কচলে মাখিস দেখি।”
“তা মাখি। ডালে। চায়ে মাখি না। লেবুর গন্ধ আর স্বাদ দুই-ই ভালো। পচা হলেও।”
বললাম, “চায়েও একটু মেখে দেখ না। খারাপ লাগবে না। আমার থেকে এক চামচ নিয়ে নিজের চায়ে গুলে নে, দেখবি…”
একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “ভালো লাগবে?”
আমি বললাম, “আমি তো পছন্দই করি…”
একটা চামচ নিয়ে তুঙ্গনাথ আমার কাপ থেকে খানিকটা চা নিয়ে নিজের কাপে গুলে নিল। তারপরে আবিষ্কার করল যে ও ছানা চা খায় না।
আসলে ব্যাপারটা এত নিঃশব্দে হয়নি। আমাকে নানা বিশেষণে ভূষিত হতে হল, পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েরা বলে গেল, “তুই কি বোকা নাকি, তুঙ্গ? তুই জানিস না, দুধে লেবু দিলে ছানা হয়?” ছেলেরাও, এমনকী যে সব ছেলেরা তাদের বাড়িতে রান্নাঘরটা কোথায় তা-ও ঠিক জানে না, তারাও বলে গেল, “এর পর দিন মাসীমা যখন ছানা কাটবেন, বলিস যেন ডেকে দেখিয়ে দেন।”
এ সবের ফলে তুঙ্গনাথ আরও এমন সমস্ত শব্দ ব্যবহার করল, আমি সে কিছুতেই এখানে লিখতে পারব না। মনে মনে বললাম, লেবু-চা ছাইপাঁশ? আমাকে চেনো না, জাদু… আমার বন্ধু তার বন্ধুকে গয়া পাঠিয়েছিল হানিমুন করতে… দোষের মধ্যে সে বলেছিল, দার্জিলিং পচে গেছে… হুঁঃ!”
দিন কয়েক পরে, আমি ক্যান্টিনে এসে সবে বসেছি, তুঙ্গনাথ সামনে বসে বলল, “অ্যাই দেড়েল, একটা গল্প শুনবি?”
উৎসাহিত হয়ে বললাম, “অবশ্যই শুনব! বল, বল!”
দুজনে যে যার পছন্দের চা চেয়ে গুছিয়ে বসলাম। বললাম, “শুরু কর…”
“রাজা, রাজকন্যা, শিকারী, হাতি, আর হলদে আর গোলাপী পাউরুটির গল্প… শুনেছিস?”
শুনিনি।
তুঙ্গনাথ বলল, “বেশ। তবে শোন… রাজার রাজত্বের একেবারে শেষ প্রান্তে ছিল এক গহন বন। তার শুরু কোথায় সবাই জানে, শেষ কোথায় কেউ জানে না। সেই জঙ্গলে থাকত অনেক ভয়ানক শিকারী প্রাণী…”
আমি বললাম, “বাপরে!”
“একবার হয়েছে কী, একটা বিরাট হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে আশেপাশের গ্রামে ভাঙচুর করতে লেগেছে। রোজ আসে, রোজ ভাঙচুর করে আবার ফিরে যায়। দেখতে দেখতে জঙ্গলের বাইরের যত গ্রাম, সব গ্রামের বাসিন্দারা একেবারে মৃত্যুভয়ে সারাক্ষণ জড়োসড়ো।”
আমি বললাম, “কী কাণ্ড!”
“দেখতে দেখতে রাজার কাছে খবর গেল, আর রাজা তাঁর সবচেয়ে বড়ো শিকারীকে পাঠালেন – যাও, হাতিটাকে মেরে এসো।”
উৎসাহিত হয়ে বললাম, “ব্যাস, আর কিছু দিন পরে, রাজার বাড়িতে একটা নতুন হাতির দাঁতের বজরা!”
তুঙ্গনাথ মাথা নেড়ে বলল, “এঁজ্ঞে না। হাতিটা শিকারীকে মেরে ফেলল।”
চা এল। এক হাত দিয়ে সাবধানে নিজের চায়ের কাপ ঢেকে অন্য হাত দিয়ে কাছে টেনে নিল তুঙ্গনাথ। তারপরে বলে চলল, “রাজার হাতির দাঁত পাওয়া হল না, শিকারীও মারা গেল। আচ্ছা, তোকে একচামচ দুধ চা দেব? লেবুর সঙ্গে দুধের ফ্লেভার ভালো লাগবে…”
দুঃখ দুঃখ মুখে বললাম, “দুধের নাম শুনলে আমার চোঁয়া ঢেকুর ওঠে রে… আমার ল্যাকটোজ ইনটলারেনস আছে… হাতিটার কী হল?”
“সত্যি নিবি না?” তুঙ্গনাথের খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝেও মাথা নাড়লাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “রাজা কী করে, আর একজন রাজ-শিকারী পাঠাল।”
“বাঃ, ভালো।”
“তাকেও হাতিটা মেরে ফেলল।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “ডি লা গ্র্যান্ডি, মেফিস্টোফিলিস, মামা মিয়া, ইয়াক ইয়াক!”
তুঙ্গনাথের ভুরু কুঁচকে গেল। বলল, “মামা মিয়া বলত?”
আমি মাথা নেড়ে বলতাম, “না, বলত না। আমি বললাম।”
তুঙ্গনাথ আবার গল্পে ফিরল। বলল, “সে যা-ই হোক, রাজা তো একের পর এক রাজ-শিকারী পাঠায়, আর হাতি একের পর এক মারে… শেষে, সব রাজ-শিকারী মরে গেল।”
আমি নেচে উঠে বললাম, “হাতির পোয়া বারো!”
তুঙ্গনাথ দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “অ্যাদ্দিন কি পোয়া কিছু কম ছিল? এখন সরকারী শিকারী ছেড়ে বেসরকারি শিকারী আসতে শুরু করল। কারণ রাজা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন, কেউ যদি হাতি শিকার করতে পারে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দেবেন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “রাজপুত্র গেল না কেন?”
তুঙ্গনাথ মাথা নাড়ল। “রাজার ছেলে ছিল না। কেবল এক মেয়ে। রাজকন্যা।”
আমি বরাভয় দেবার ভঙ্গীতে বললাম, “তাতে কী? রাজকন্যারা কম কী? যুদ্ধ করতে পারে, ঘোড়ায় চড়তে পারে, তীরন্দাজী, ধনুর্বিদ্যা… কিছুতেই কম যায় না। চিত্রাঙ্গদার কথা জানিস না?”
ভস্ম করে দেবার মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুঙ্গনাথ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এই রাজকন্যা ওরকম তেড়িয়া মহিলা না। ইনি নরম মতো। গায়ের রং যেন মেঘমুক্ত আকাশের চন্দ্রালোক। মাথার চুল শ্রাবণের মেঘ। দাঁত… আচ্ছা থাক। বেশি বললে তুইও হাতি মারতে যাবি। স্রেফ এইটুকু জেনে রাখ, এই রাজকন্যা ছেলেদের মতো শার্ট প্যান্ট পরে ঘোড়ার পিঠে জিন না লাগিয়ে মারপিট করতে যেত না।”
তুঙ্গনাথের চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। বাইরে কালিঝুলি মাখা কাঁঠাল গাছটার দিকে চেয়ে বলল, “এই রাজকন্যা রামপুর সাসাওয়ান ঘরানার গান গাইতেন। কুচিপুডি নাচ শিখতেন।”
বুঝলাম এই রাজকন্যাকে তুঙ্গনাথ কিছুটা চেনে, বাকিটা নিজের মনের মাধুরী। বললাম, “ও, হো! তাই বুঝি? তাহলে বল, রাজা নিজে গেলেন না কেন?”
তুঙ্গনাথ প্রায় বিষম খায় আর কী! “তোর মতো একটা বাজে অডিয়েন্স আমি জীবনে দেখিনি। রাজা বুড়ো না? আর রাজা মরে গেলে চলবে? কন্যাদান কে করবে? মুখ বন্ধ করে শুনবি, কি না?”
মুখ বন্ধ করলাম। তুঙ্গনাথ ব্যাজার মুখে আবার শুরু করল।
“সারে সারে শিকারী মারা যাবার পরে রাজ্যে সবাই হতাশ। রাজা তখন ঘোষণা করলেন, এই হাতিকে যে মারতে পারবে, সে অর্ধেক রাজত্ব না – পুরোটাই পাবে। আর সেই সঙ্গে রাজকন্যার পানিগ্রহণ…”
কথা বলা বারণ। নিঃশব্দে হাততালি দিলাম।
“কিন্তু কেউ আসে না।”
আমি নিঃশব্দে ভুরু তুললাম কপালে।
তুঙ্গনাথ তেড়ে উঠে বলল, “কে আসবে, শুনি? অর্ধেক শিকারী মরে গেছে, বাকিরা রিস্ক নিতে চায় না… যাই হোক,
রাজা সবে হাল ছেড়ে দেয় আর কী, এমন সময় রাজার সহিসের ছেলে এসে বলল, আমি যাব হাতি শিকারে…”
বিধিনিষেধ ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম, “আঃ হাহাহা, বুঝেছি। ওর সঙ্গে রাজকন্যার একটা ইন্টুমিন্টু…”
গর্জন করে উঠল তুঙ্গনাথ, “না!”
আমি কাতরস্বরে বললাম, “এরকম করিস না, ভালোবাসা না থাকলে এই বিয়ে টিঁকবে না। কোথায় সহিসের ছেলে, কোথায় রাজকন্যা। তুই কি চাস না ওরা সুখী হোক?”
তুঙ্গনাথ এমন রেগে গেল যে এক চুমুকে সবটুকু চা শেষ করে কাপের শেষের চায়ের পাতা, দুধের সর, সব গিলে ফেলে ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। মুখ লাল করে বলল, “গ্রর্র্র্…”
তড়িঘড়ি বললাম, “আমি আর একটাও কথা বলব না।”
“মনে থাকে যেন।” বলে আবার শুরু করল।
“রাজা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন, হাত নেড়েই সহিসের ছেলেকে অনুমতি দিলেন। তারপরে বললেন, রাজ-অস্ত্রশালা থেকে যা অস্ত্র চায়, নিয়ে যায় যেন। সহিসের ছেলে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, অস্ত্রশস্ত্র চায় না সে। কেবল রাজ-রন্ধনশালা থেকে ওকে যেন রোজ একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি দেয়। রোজ। যতদিন ও চাইবে। ‘না’ যেন না বলে।
“রাজা মনে ভাবলেন, যে রাজ্যে শিকারী নেই, সেখানে তো এরকম ভাঁড়ই আসবে শিকার করতে, হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, যা চাও করো। সহিসের ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে রওয়ানা হল জঙ্গলের দিকে।”
তুঙ্গনাথ হাঁক পেড়ে আর এক কাপ চা চাইল। আমি তো এদিকে ছটফট করছি ― কিন্তু কথা বলা বারণ, তাই বললাম, “এই আমাকেও একটা দিস। লেবু চা।”
“ছেলেটা জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
ফিসফিস করে বললাম, “তারপর?”
তুঙ্গনাথ বলল, “পরদিন ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
তারপরে তুঙ্গনাথ আবার ওই কথাগুলোই বলল, “পরদিন ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছি, তুঙ্গনাথ অম্লানবদনে আবার চারবার ওই একই কথাগুলো বলল। “আবার পরদিন ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
এর পরে আরও সতেরো বার বলল। ওই একই কথা। “পরদিন ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
আরও পঁচিশ বার বলল, “পরদিন ছেলেটা রাজ-রন্ধনশালায় গিয়ে রাঁধুনিকে বলল একটা হলদে পাউরুটি আর একটা গোলাপী পাউরুটি বানিয়ে দিতে, তারপরে সে-দুটোকে একটা থলেতে ভরে জঙ্গলের ধারে গেল। হাতি তেড়ে এল। ছেলেটা ব্যাগ থেকে হলদে পাউরুটি আর গোলাপী পাউরুটি বের করে হাতিটার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাতিটা থামল। প্রথমে হলদে পাউরুটি খেল। তারপরে গোলাপি পাউরুটি খেল। তারপরে জঙ্গলে ফিরে গেল। ছেলেটা ফিরে এল।”
আমি অপেক্ষা করছি, পাউরুটি খেয়ে খেয়ে কবে হাতি খুশি হয়ে (বা বোর হয়ে গিয়ে) ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে কোন গোপন সাতরাজার ধন মাণিক দেবে, যা নিয়ে ছেলেটা রাজার সমান ধনী হয়ে হাতির কাছ থেকে আর কোনও দিন কোনও মানুষের ক্ষতি করব না – এমন অঙ্গীকার নিয়ে ফিরবে – জাতীয় হিরো হয়ে, একাধারে কনজার্ভেশনিস্ট, প্লাস জনগণের রক্ষাকর্তা, প্লাস বড়োলোক – রাজার একমাত্র কন্যা, যে কি না দুধ-ক্ষীর-ননীর পুতুল, তাকে বিয়ে করার জন্য আইডিয়াল…
এ সব কিছুই হল না। তুঙ্গনাথ হঠাৎ খুব রেগে চিৎকার করে উঠল, “তুই সত্যিই একেবারে রাবিশ, তোকে গল্প বলে কোনও মজা নেই… কোনও একটা রি-অ্যাকশন ঠিক না। ধ্যাত্তেরি…” বলে উঠে চলে গেল। চলেই গেল। আর আমি বোকার মতো বসে বসে ভাবতে লাগলাম, হলদে আর গোলাপী পাউরুটির বিশেষত্ব কী? হাতিটার কী হল? ছেলেটার কী হল? রাজকন্যার কার সঙ্গে বিয়ে হল? তুঙ্গনাথ রেগে গেল কেন? উঠে চলেই বা গেল কেন?
আরও ক’ দিন পরে, ক্যান্টিনে বসে ছিলাম একাই। মনে নেই, বোর হয়ে, না ক্লান্ত হয়ে দু হাত ভাঁজ করে টেবিলে রেখে তার ওপর মাথা নামিয়ে শুয়ে মতন ছিলাম। আমার ডান গাল ছিল হাতের ওপর, আমার মুখ ছিল বাঁ দিকে ফেরানো। হঠাৎ শুনলাম পাশ থেকে তুঙ্গনাথ ফ্যাশফ্যাশে গলায় বলছে, “দাড়ি, নড়িস না।”
গলায় একটা ওয়ার্নিং ছিল শুনে আমি থমকে গেলাম। যাকে বলে ফ্রিজ করে যাওয়া। তুঙ্গনাথ কাছে এগিয়ে এসে, নুনের কাপটা…
এই নুনের কাপ সম্বন্ধে দুটো কথা না বললেই নয়। ক্যান্টিন মালিক, মিন্টুবাবু চায়ের কাপের হাতল ভেঙে গেলে, বা চুমুক খাবার জায়গায় বেশি চলটা উঠে গেলে ভাঙা কাপগুলো নুন রাখার কাজে ব্যবহার করতেন – বর্ষায় সে কাপগুলো এক একটা মিনিয়েচার ডেড সি হয়ে উঠত।
তুঙ্গনাথ এই রকম একটা নুনের কাপ আমার বাঁ দিকের কপালের পাশে, কানের ওপরের সমতল জায়গাটায় রেখে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, “এক্কেবারে চুপ করে বসে থাকিস…”
আমি যথাসম্ভব নিশ্চল হয়ে চেঁচাতে লেগেছি, “অ্যাই ব্যাটা তুঙ্গনাথ, খল্নায়ক কোথাকার, ফিরে আয়, ফিরে আয় বলছি, নইলে কালো যা যা বলে গালাগালি দেয় সেই কথাগুলো বলব কিন্তু হতচ্ছাড়া…”
কোনও সাড়া নেই। আমার হাতদুটো আমারই মাথার নিচে। মনে হল, একটু চুপ করে অপেক্ষা করি। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ এসে আমাকে মুক্তি দেবে? আমার ক্লাসমেট কেউ? অন্য ইয়ারের কেউ? ক্যান্টিন বয়-দের কেউ?
কয়েক মিনিট কেটে গেল। কেউ এল না। ক্যান্টিন বয়রা অন্য দিকে ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। জুনিয়ররা যে ক’জন গেল, কেবল হেসেই কুটিপাটি। আজ অবশ্য ওদের দোষ দিই না। আমার এমনিতেই খ্যাপাটে বলে সুনাম ছিল। বুঝলাম, যেইদিন আমি কলেজের ছাত্রদের হতভাগার দল বলেছিলাম, সেইদিন ভগবান অকুস্থলেই ছিলেন।
একটু বাদে যখন ঘাড়টা প্রথমে শক্ত হয়ে তারপরে ঝিনঝিন করতে আরম্ভ করল, বুঝলাম কিছু করতে হবে। আস্তে আস্তে, অল্প অল্প করে, মাথার নিচ থেকে ডান হাতটা বের করতে আরম্ভ করলাম।
হাতটা বেরিয়ে এল – কোনও ঝামেলা বিনা-ই। কিন্তু একেবারে শেষে, যখন কাপটা প্রায় ধরে ফেলেছি, কী করে জানি নড়ে গিয়ে উলটে পড়ল – আর সমস্ত নুনটা ঢুকে গেল কলারের নিচে, জামার ভেতরে।
ফ্যাটি-দা ছুটে এসে বলল, “আরে আমি ওখান থেকে দেখেই চেঁচিয়ে বলেছি, ‘চুপ করে থাক, নড়িস না, আসছি।’ তিন পা দূরে ছিলাম।”
বুঝলাম নুনটা পড়ার ঠিক আগে যে অর্থহীন অব্যক্ত চিৎকারটা শুনেছিলাম, ওটাই ফ্যাটি-দার হাঁক ছিল।
জিজ্ঞেস করল, “কার কাজ?”
বললাম, “তুঙ্গনাথ।”
“খুব খচা তোর ওপরে? কী করেছিলি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামার ভেতর, গেঞ্জি, এসব থেকে থেকে নুন ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, “সে অনেক লম্বা কাহিনি, ফ্যাটি-দা। তার হিরো এক কাপ লেবু চা, আর ভিলেন অনেকগুলো পাউরুটি… সব গোলাপী আর হলদে রঙের।”
Note: ডিসিডিডি সমীপেষু…