মায়ের শেষ অপারেশনের আগের সন্ধ্যাটা আমার জীবনে বারবার ঘুরে ঘুরে চলে আসে। সেই সন্ধ্যার স্মৃতিটা কিছুতেই মন থেকে যায় না। যেতে চায় না। আমিও কি ছাই কখনো চেয়েছি, ভুলতে, যে ভুলবো?
অনেক কথার মধ্যে মা একটা কথা বলেছিল, কাল আমি না থাকলে যারা পাশে থাকবে, বিপদের সময় যারা সহায় হবে, সাহায্য করবে, তাদের কখনো ভুলিস না। দেখবি, অনেকে আশ্বাস দেবে, কিন্ত খুব কম কয়েকটা হাত শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসবে। তাদের চিরদিন মনে রাখিস। তাদের সাথে থাকিস। তাদের এগিয়ে আসাটাকে সম্মান করিস। চট করে তাদের বিচার করে বসবি না। ভুল মানুষ মাত্রই করে। তারাও ভুল করে। ভুল করবে। করতেই পারে। কিন্ত একটা ঘটনা দিয়ে তাদের বিচার করলে, পস্তাতে হবে। পরে।
খুব অল্প বয়সে না হলেও, যে বয়সে মাকে হারিয়ে ছিলাম, তখন মাকে প্রচন্ড প্রয়োজন ছিল। মাকে প্রয়োজন, সব বয়সেই হয়। কিন্ত মাকে হারিয়ে, আমি যেন এক অদ্ভুত ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিলাম। উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া… আরো অনেক শব্দ যোগ করা যায়, সেই সময়ের ‘আমি’ সম্বন্ধে। সেই হাসি-খুশি, বিশুদ্ধ মানুষটার মৃত্যু হয়েছিল। একই চিতায় মায়ের সাথে আরো একজন পুড়ে মরে ছিল। বহু কষ্ট করে তাকে সুস্থ করতে হয়েছিল। তা যাক সে কথা। মায়ের মৃত্যুর পর, কথাগুলো কতোটা সত্যি তা বুঝতে শিখেছিলাম। বাস্তব যে ঠিক কতোটা কঠোর, জেনেছিলাম। জানতে বাধ্য হয়েছিলাম।
বহুবছর পর, ঘর সংসার করছি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে থাকতে চেষ্টা করছি। ২০১৭ সাল। আগস্ট মাসের এক দুপুরে জিনিয়া ফোন করে জানালো সে মস্ত বিপদে পড়েছে। জানতে পারলাম, যে ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে সে রেডিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করে, সেখানে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে। সেন্টার ঘিরে রেখেছে বহু মানুষ। ডাক্তারকে মারতে চায়! ডাক্তার নাকি ভুল রিপোর্ট দিয়েছেন! অবিবাহিত মহিলা গর্ভবতী হতে পারে নাকি! ভুল রিপোর্ট। যদিও জিনিয়ার রিপোর্টেই পরে সীলমোহর পরেছিল। ভুল যে জিনিয়া ছিল না, তা জানা গেছিল। কিন্তু সে তো পরে! কিন্তু আজ! এখন! এই মুহূর্তে কি হবে! ডাক্তারের গর্দান চাই আগে। এখনই। দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। ছুটে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্ত জিনিয়া পরিষ্কার বললো, তুমি এখানে এসো না। পরিস্থিতি খুব খারাপ। আর তুমি এলে তোমাকে মারবেই।
আমি যাবো না! জিনিয়ার কি হবে? কি করে বাড়ি ফিরবে? জিনিয়া কি সত্যিই ভুল করেছে? মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। কি করি? কার কাছে যাই? কাকে ফোন করবো?
ফোন করতেই অপছন্দ করি। নিজের জন্য, নিজেদের জন্য কারো কাছে হাত পাততে, অনুরোধ করতে তো আরোই অসম্মানিত বোধ করি। নিজেকে কেমন খেলো মনে হয়। তাও সেদিন জিনিয়ার জন্য করেছিলাম। জিনিয়ার প্রাণের কথা ভেবে। যদি মেরে ফেলে! সঞ্জয় ব্যানার্জিদা, সঞ্জয়দা, চাকীদা (তখন কৌশিক স্যার বলতাম), মিস্টার গুপ্ত। যাকে পেরেছিলাম। পরিস্থিতির কথা জানিয়ে। আর কিছু করতে হয়নি আমাকে। হ্যাঁ, জিনিয়া ঘরে না পৌঁছানোর আগে অবধি অবশ্যই দুশ্চিন্তা করেছি। ভয় পেয়েছি। কিন্ত জিনিয়া সুস্থ ভাবে ঘরে পৌঁছেছিল। অক্ষত অবস্থায়। এই যাদের নাম নিলাম এদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই দিনের জন্য। বহু ফোন এসেছে। রসালো খবরের সন্ধানে সংবাদমাধ্যমের থেকেও ফোন পেয়েছিলাম। সব সামলে দিয়েছিল, কয়েকজন মানুষ।
না। ওই একটা দিনই কেবল নয়। এরপর লাগাতার পরের সাত দিন ফোন পেয়েছিলাম এই মানুষগুলোর। সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা জানার জন্য। আমার মতো, আমাদের মতো, অতি সাধারণ ডাক্তার। যাদের পরিচিতির পরিধি খুব কম। যাদের হাত ‘লম্বা’ নয়। বিপদের দিনে তাদের পাশে কেউ থাকে কি? সত্যি কথা বলতে আমাদের মতো, স্বল্প পরিচিত ডাক্তারের ভিড়ই চারিদিকে বেশি। তাদের মধ্যেই দুই-এক জন জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠতে পারেন। তাঁদের হাতও অনেক ‘লম্বা’। তাঁদের জন্য অনেকেই থাকেন। করেন। কিন্ত আমাদের জন্য? অধিকাংশ সময়েই শুনতে হয়, তোর ব্যাপার বুঝে নে। অথবা সম্ভব নয়। সময় নেই এখন।
না। সেদিন এবং সেইদিনের পরে কখনো, এইরকম শুনতে হয়নি। কৌশিক স্যার, নিজের যোগ্যতায় আজ চাকীদা হয়ে গেছে। নিজের যে কোন বিপদের সময় নির্দ্বিধায় ফোন করতে পারি। সমস্যার কথা জানাতে পারি। সমাধান সবসময়ই যে হয় তা নয়, কিন্ত পরামর্শ মেলে। সঞ্জয়দা কলেজের সিনিয়র ছিল। ওই টুকুই। পরিচিত ছিল না। কিন্ত…
প্রার্থীদের অনেককেই চিনি। চিনেছি। কাউকে কোন ঘটনার মাধ্যমে, কাউকে আবার এমনিই। বহুবছর ধরে। চাকীদা নামটা কথায় কথায় চলে এলো তাই, না হলে ব্যক্তিগত ভাবে কোন নাম নেবার ইচ্ছা ছিল না। এটা ভাবার কোন কারণ নেই, এই ঘটনার পর আমি, কোন বিশেষ সংগঠনকে, বিশেষ সময় দিয়েছি। দিতে পারিনি। তবুও কখনো সখনো সঙ্গী হয়েছি। পথে হেঁটেছি। মুষ্ঠি বদ্ধ করেছি হাত। চোয়াল শক্ত করেছি। বদল চেয়েছি।
ভোট প্রার্থীদের তাহলে কি এটাই যোগ্যতা? পরিচিত হওয়া? আমি ভোট দেবো, কারণ আমার পরিচিত? তাহলে অন্যান্য যাঁরা প্রার্থী আছেন? তাঁদের পরিচিতরাও তো তাঁদেরই ভোট দেবেন। ভুল কোথায়?
তাহলে বলবো, লেখাটা আর একবার পড়তে। এই মানুষগুলোর কাছে আমি তো অপরিচিতই ছিলাম। আর এই মানুষগুলোও আমার অপরিচিতই ছিল। এবং অপরিচিতই থাকতো। যদি না, আমি… আমরা… জিনিয়া… বিপদে পড়তো। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ না জেনে, আমাদের রাজনৈতিক রং না দেখে, ভালো-খারাপ না দেখে, বিপদের দিনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছিলাম। শুধুমাত্র আমাদের! না। বিগত কয়েক বছরে যেখানে, যখনই কোন ডাক্তারকে বিপদে পড়তে দেখেছি, এই মানুষগুলোকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। অপরিচিতদের জন্য। একটাই যোগসূত্র। সকলেই ডাক্তার। অতি সাধারণ ডাক্তার। আর কাউকে দেখিনি। পাশে পাইনি। পাশে যেতে দেখিনি। হ্যাঁ, অপরিচিতকে পরিচিত করে তোলাই এঁদের যোগ্যতা। দেওয়াল ভেঙে এগিয়ে আসাই যোগ্যতা।
সরকারপন্থী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ জানানোর কোন উপায় নেই। কারণ, ওই তাঁদের চিনিই না। অপরিচিত। তাঁরা কখনো এগিয়ে এসে আমার মতো, আমাদের মতো অখ্যাত ডাক্তারদের সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। নিজেদের গন্ডী পেরোবার কথা ভাবেননি। দেওয়ালটা ভেঙে এগিয়ে আসতে পারেননি। হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারেননি। হয়তো, হাতটা খুব ‘লম্বা’ না হলে পৌঁছবার উপায় নেই। তাই… ক্ষমতাশালীরা আসলে সাধারণের সাথে মিশে যেতে চায় না। তাতে ক্ষমতার দম্ভ কমে যায়। তারা জানে সাধারণ মানুষ তার কাছে যাবে। খুঁজে নেবে। সম্ভব হলে। সাধারণের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থাকলে, তাদের গায়ে ক্ষমতাসীনের নয়, সাধারণের তকমা পরে যাবে। তাই…
আর আমরা? আমরা যারা সাধারণ। অতি সাধারণ। তারা চাই, আরেকজন সাধারণ মানুষকে। আমাদের মানুষকে। গদি যেন তার সাধারণত্বকে কেড়ে না নেয়। ক্ষমতার কাছে বিকৃত ও বিক্রিত হওয়া নয়। ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ নয়। সহমর্মী। নিজেদের বিচারক না ভেবে, সহকর্মী ভাবা।
বিগত কয়েক বছরে যা দেখেছি, তাতে রাগ হয়নি। হাসি পেয়েছে। ডাক্তাররা তো শিক্ষিত বলেই জানি। তাতে সন্দেহ হয়েছে। শিক্ষাকে ক্ষমতার তলায় বিকিয়ে দিতে দেখেছি। মেরুদন্ডকে বিকিয়ে দিতে দেখেছি। তাই রাগ নয়। করুণা করেছি। আর যাকে করুণা করি, তাকে আর যাই হোক মাথার উপর বসাতে চাই না। চাই না।
আজ আমাদের সকলের বেড়া ভাঙার সময়। পাল্টে দেবার প্রয়োজন। প্রয়োজন বদলে দেবার। প্রয়োজন প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে দেবার। আসুন। বদলে দেই। পালটে দেই।