সপ্তাহে একদিন, প্রতি শুক্রবার যাই সরবেড়িয়ায়। সরবেড়িয়ার কৃষিচক্রের গড়ে তোলা সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল। আমি যাই ২০১৪-র জানুয়ারী থেকে। আমি ছাড়া শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের কজন বিশেষজ্ঞ যান মাসে একদিন করে—স্ত্রীরোগবিদ চঞ্চলাদি, মনোরোগবিদ সুমিত, চর্মরোগবিদ জয়ন্ত। তাছাড়া জুনিয়র দেবজিত, মাসুম, বিপ্লব, অনীক, রাহুল মাঝেমাঝে আরএমও-র ডিউটি করেছে ওখানে।
শুক্রবারে ভিড় থাকে—ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ, আর্থ্রাইটিস, কোমর-ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথার সব রোগী—দেড়শ, পৌনে দু’শ ছাড়িয়ে যায় রোগীর সংখ্যা। ২২শে মে (২০১৫) রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম ছিল, ভ্যাপসা গরমের জন্য। শেষ দিকে এল সন্ন্যাসী সর্দার সাধারণ জ্বর-কাশি নিয়ে, বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার দাড়িজঙ্গল, পেশায় নৌকার মাঝি। প্রেসক্রিপশন লিখে ওর স্ত্রীকে দিলাম ওষুধ তুলতে আর গল্প শুরু করলাম সন্ন্যাসীর সঙ্গে। পাখার নীচে বসলে ওর জ্বরটাও কিছুটা কমবে।
না, সন্ন্যাসী সুন্দরবনের নদীতে নৌকা চালায় না। চিৎপুরে বালি তোলার নৌকাতে কাজ করে। সরবেড়িয়া থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ধামাখালি, ধামাখালি থেকে খেয়া পেরোলে সন্দেশখালি দ্বীপ, আরেকবার খেয়া পেরিয়ে উত্তর দাড়িজঙ্গল। আগে গ্রামেই ভ্যান চালাতো সন্ন্যাসী, রোজগার কম হওয়ায় কলকাতায় পাড়ি জমায়। কেমন করে থাকে সন্ন্যাসী, জানলাম, মনে হল আপনাদেরও জানাই, কিভাবে মানুষ বেঁচে থাকে।
গঙ্গার ওপর নৌকোতেই সন্ন্যাসীর বাস আর আটজনের সঙ্গে। বালি তুলে মাসে মেলে সাত হাজার টাকা। খাওয়ার খরচ বাবদ দিনে সত্তর টাকা দিতে হয়—সকালে চা-বিস্কুট, দুপুরে ভাত-ডাল-তরকারি, রাতে মাছ-ভাত। সপ্তাহে একদিন মদ খাওয়া হয়, মদ আর চাট বাবদ দিতে হয় পঞ্চাশ টাকা। নদীর জলে স্নান করা। নৌকার হালে বসে মল-মূত্রত্যাগ। আর পানীয় জলও গঙ্গার, ফটকিরি দিয়ে জল নাকি সাফ করে নেওয়া হয়। দু’মাস ছাড়া বাড়ি আসতে পারে সন্ন্যাসী। খরচ-খরচা মিটিয়ে বাড়িতে মাসে তিন হাজার টাকা পাঠাতে পারে। তাতে খরচ চলে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও এক ছেলের।
সন্ন্যাসীর জ্বর আমি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তার জীবনযাপন সারাবে কে?
মন খারাপ হয়ে যায়। কবে যে সবাই একটা মোটামুটি সুস্থ স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করবে?