(১৪)
রিপোর্টটা পড়ে একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে শংকরের ঠোঁটে। পি ইউ সি এল (পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস) বার করেছে রিপোর্টটা। রিপোর্টের শিরোনামটায় সে চোখ বোলায় আর একবার। “জনবাদী আন্দোলন বনাম শরাব, পুঁজি ও হিংসা কি রাজনীতি”। “শরাব, পুঁজি আর হিংসা কি রাজনীতি”! বছর চারেক আগের ঘটনাটা মনে পড়ে যায় শংকরের। সদ্য অর্থনৈতিক আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী বেড়ে হয়েছে ষোল টাকা। তাতে লাভের লাভ এই হল দল্লী-রাজহরায় মদের বিক্রি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। শংকরের কপালের ভাঁজ গভীর হল। শ্রমিক নেতাদের বোঝালো শরাব বন্দী আন্দোলন কতটা জরুরী। ছোট ছোট সভা করে, লিফ লেট বিলি করে, পোস্টার বানিয়ে ওদের মদ ছাড়ানোর চেষ্টা চালালো ইউনিয়ন। কিন্তু খুব যে একটা কাজ হতে লাগল তা নয়। যতই মজদুরদের বোঝানো হোক না কেন পুঁজিপতিরা আসলে মদ বিক্রি করে ওদের শোষণ করে, সে কথায় তারা ঘাড় নাড়ে বটে কিন্তু কথাগুলো মন থেকে মানতে চায় না। আদিবাসী সমাজে মদ খাওয়ার রীতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জঙ্গল থেকে মহুয়া কুড়িয়ে এনে ঘরে চোলাই মদ তৈরি করে খায়। এই নিয়ম তাদের স্বাভাবিক জীবনেরই অঙ্গ। আইনেও তাদের ছুট দেওয়া আছে। তারা ঘরে নিজেদের জন্য মদ বানাতে পারবে কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। সে সময়ে চিখলি গ্রামের ঘটনাটা একটা জোর ধাক্কা দিয়ে গেল দল্লী-রাজহরার মজদুরদের। শহর থেকে ছ’-সাত কিলোমিটার দূরে চিখলি গ্রাম। সেখানে এক আদিবাসী পরিবারে মদ তৈরি হচ্ছিল। মদের ঠেকাদার তক্কে তক্কে থাকে কারণ ওরা যদি ঘরেই মদ বানিয়ে নেয় তাহলে ব্যবসা চলে কি করে! ঠেকাদার আবার অর্থমন্ত্রী ঝুমুক লালের জিগরী দোস্ত। শাসক দলের চামচা বলে বাড়তি সুযোগ থাকায় স্বামী স্ত্রী দু’জনকে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে গেল নিজের ভাটিখানা সংলগ্ন ঘরে। চলল অকথ্য অত্যাচার। চিৎকারের শব্দ শুনে ছুটে যায় ওই ভাটিখানায় মদ খেতে আসা কয়েকজন ইউনিয়নের সদস্য মজদুর। গিয়ে যা দেখে তাতে তাদের হাড় হিম হয়ে যায়। ওদের পায়ে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে ঠেকাদারের লোক। খবর পৌঁছায় ইউনিয়ন অফিসে। হাজার হাজার মজদুর ভাটিখানা ঘিরে ফেলে, গুন্ডাদের হাত থেকে স্বামী স্ত্রীকে উদ্ধার করে। ঠেকাদার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার অভিঘাত ওদের চোখ খুলে দেয়। শরাব, পুঁজি আর হিংসার পারস্পরিক সম্পর্ক খোলসা হয় ওদের কাছে। শহীদদের নামে ওরা মদ ছাড়ার শপথ নেয়। কিন্তু মদের নেশা ছাড়ব বললেই ছাড়া অত সহজ নয়। শংকর দেখেছে ওরা মদ ছাড়বার জন্য কত নতুন নতুন ব্যবস্থা চালু করেছিল। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া গেলে পরের দিন ইউনিয়ন অফিসে এসে সবার সামনে মদ খাওয়া কেন জরুরী এ বিষয়ে আধ ঘন্টা বলতে হবে। মদ খেয়ে ঘরে বৌ বাচ্চাদের গাঁয়ে হাত তুললে যদি ইউনিয়নে অভিযোগ জমা পরে তা হলে ফাইন দিতে হত। ফাইনের টাকা কিছুটা ইউনিয়ন রেখে বাকি টাকা অবশ্য পরে তার বৌকে লুকিয়ে দিয়ে আসা হত। বারবার মদ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে বারবার কথার বিচ্যুতি হলে খনির কাজ থেকে সরিয়ে তাকে ইউনিয়নের কাজে বহাল করা হত। যারা নেশা ছাড়তে চায় কিন্তু ছাড়তে পারছে না তাদের ইউনিয়নের নেতারা সন্ধ্যের সময় নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে রাখা শুরু করল। সন্ধ্যেবেলা কাজ থেকে ফিরে কিছু করার নেই তাই মদ খাওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করে শংকর মজদুর বস্তিতে সন্ধ্যের সময় লোকগীতির অনুষ্ঠান, নাটক, এসবের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এত কিছুর পরেও মহিলা মুক্তি মোর্চার সহযোগীতা ছাড়া আজকের এই রিপোর্ট সম্ভব নয়। আটাত্তর সাল থেকে আর আজ এই বিরাশি সালের মধ্যে দশ হাজারের বেশি মজদুর মদের নেশা ছেড়েছে। শুধু কি এই রিপোর্ট? কেন গত বছরই তো একজন সাংবাদিক হিসাব করে দেখেছেন আগে যেখানে পনেরো দিনের বেতন হলে পাঁচ হাজার বোতল বিক্রি হত এখন সেখানে মাইনের দিনে চল্লিশ পঞ্চাশ বোতলের বেশি বিক্রি হয় না। মদের দোকানের ঠেকাদারের আয় এখন্ তলানিতে ঠেকেছে। শরাব বন্দী আন্দোলন ভাঙার জন্য ওদের তো চেষ্টার খামতি নেই। শংকরকে জেলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গান্ধীবাদী অখিল ভারতীয় নেশাবন্দী পরিষদকে শংকর এই আন্দোলনের সমর্থনে সি এম এস এস -র সঙ্গে জুড়েছে। সেই পরিষদের রাজহরা শাখার সভাপতিকে এমন কি ট্রাক চাপা দিয়ে মারার চেষ্টাও করেছে ওরা। শংকর জানে সাপের লেজে পা দিয়েছে ছোবল তো মারবেই ওরা। কিন্তু তাও জিততে পারে নি ওরা। গো হারান হেরে গেছে। গত বছর কলকাতা থেকে যে ডাক্তারবাবু-রা শংকরের এই কর্মকান্ডে স্বেচ্ছায় এসে যোগ দিয়েছেন তাঁরাও এই কাজে অনেক সাহায্য করেছেন। মদ খেলে শরীরের কি ক্ষতি হয় সেসব নিয়ে আলোচনা সভা করেছে্ন। মজদুরদের বুঝিয়েছেন। এই বছরের শুরু থেকে ইউনিয়ন অফিসের পাশের গ্যারেজে শহীদ ডিসপেনসারি চালু করা গেছে। দেখা যাক, মজদুরদের একতা আর মনোবল পুঁজি বাদের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে পারে কিনা। শংকরের মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবিরা এখানে এসে কাজ করতে চাইছেন। সস্ত্রীক ডঃ বিনায়ক সেন কিছু দিন হল এসেছেন এখানে কাজ করতে। আসলে এই পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস-এর তদন্ত দলের এক জন সদস্য উনি। এখানের কর্ম কান্ড ওনাকে স্পর্শ করেছে। শংকরের জেল, আদিবাসীদের নিরন্তর লড়াই কোথাও গিয়ে সর্ব ভারতীয় স্তরে সারা জাগাতে পেরেছে। এ তারই প্রমাণ। আজ মন খুশ হয়ে গেছে শংকরের। খবরটা আশুকে না দেওয়া পর্যন্ত মন হালকা হচ্ছে না যেন। ইউনিয়ন অফিস থেকে বেরিয়ে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায় দীর্ঘ দেহী মানুষটা। বসন্তের হাওয়ায় মাতাল হয়ে উঠেছে শাল, পিয়াল, মহুয়ার দল। ঝোড়ো হাওয়ায় মিঠে সুবাস। বুনো গন্ধ আর গগনে উদিত পূর্ণিমার চাঁদ হঠাত করে শংকরের মনে যেন প্রেমের জোয়ার তুলল। আশুর জন্য মন কেমন করে উঠল। বড়ো কম সময় দেয় নিজের পরিবারকে, এটা যেন কাঁটার মতো মনের মধ্যে খচ খচ করে উঠল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই আশুকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিপ্লবী লোকটা। বিপ্লবীরাই বুঝি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। তারাই পারে প্রেমের জন্য বন্য হতে, অনন্য হতে। বাচ্চাদের সারা শব্দ নেই। ওরা বোধ হয় খেলা থেকে ফেরে নি এখনও। শংকর পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকে। আশু ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে ব্যস্ত। শংকর পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে। আজ আর মনের আবেগ বাঁধ মানতে চাইছে না। ঘরের টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলোয় মুগ্ধ হয়ে দেখে সে আশাকে। নেতা হওয়ার কোনও অতিরিক্ত সুবিধা কখনও নেয় নি শংকর। অতি সাদামাটা যাপনের গল্প ওদের সংসারে। তবু এই মূহূর্তে নিজেকে সম্পূর্ণ মনে হয় ওর। খুব নরম গলায় ফিস ফিস করে ওঠে শংকর, “আশু”। আশা চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে চায় স্বামীর দিকে। এক মূহূর্তের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ে শংকরের মন। ওর তো শত্রুর অভাব নেই। যদি ওর কিছু হয়ে যায় আশা কি পারবে একা এই জীবন যুদ্ধ লড়তে! ন’ গাঁও য়ের ধীরেশ কবেই মরে গেছে কিন্তু আজকের শংকর বাঁচতে চায়। এই সুন্দর পৃথিবীতে আরও অনেক কিছু করে যেতে চায় ও। সুন্দর একটা সমাজ গড়ে তুলতে চায়। সে সুযোগ পাবে তো? পশ্চিম আকাশে শুকতারা মিট মিট করে জ্বলতে থাকে। ছত্তিশগড়ের এই লাল মাটির দেশে রাত নামে। দূর থেকে ভেসে আসে মাদলের আওয়াজ আর সমবেত সঙ্গীত……………
গাঁও কে গলী গলী খোর খোর নওয়াঁ অঞ্জোর
বগরাবো রে সঙ্গী নওয়াঁ অঞ্জোর বগরাবো।
নওয়াঁ অঞ্জোর কে লাল কিরণ সব জগহ বগরহী, সব জগহ বগরহী
আঁখি সবকে খুল জহী অঁধিয়ারী রাত টরহী, অঁধিয়ারী রাত টরহী,
হয় জহী বিহান জাগহী মজদুর ঔর কিসান………