“ভোপাল চলো মানে! বললেই হল চলো। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই কী করে যাব?” আনন্দ বড় বড় চোখ করে সুদো-র দিকে তাকায়। সুদো, শিবু, অরুণ এমন করে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে যেন কি একটা মস্ত অপরাধ করেছে প্রশ্নটা করে। নাছোড়বান্দা সহপাঠীদের জেদের কাছে হার মানতেই হল তাকে। কলকাতা থেকে ডাক্তারদের টিম যাবে ভোপালের গ্যাস পীড়িতদের চিকিৎসা করতে।
আনন্দ এখন ইন্টার্ণশিপ করছে। মাস গেলে সাড়ে চার’শ টাকা মাইনে। খারাপ নয় মোটেই। ক্যান্টিনে দু’টাকায় মাছ ভাত পাওয়া যায়। ওয়ার্ডে ঘুরে চলছে কাজ শেখা। এসব ছেড়ে এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দিতে মন চাইছিল না। কিন্তু সেটা কি সর্বৈব সত্যি? আমরা নিজের মনের গতি টের পাই না অনেক সময়। আসলে আমরা কি চাই তার একটা বহিরঙ্গের রূপ আছে, এবং একটা অন্তরঙ্গ রূপ আছে। গত বছর ১৯৮৪ সালে পর পর কয়েকটা ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের ইতিহাসে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা সংযোজিত করেছে। জুন মাসে অপারেশন ব্লু স্টার, তার প্রতিক্রিয়ায় শরতের সকালে অক্টোবরের একত্রিশ তারিখ দুই শিখ দেহরক্ষীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তার জেরে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে চলেছে শিখদের ওপর অবাধ আক্রমণ। সারা দেশ জুড়ে প্রাণ গেছে অনেক নিরীহ মানুষের। পশ্চিমবঙ্গে ‘৮২ সালে আবার সিপিএম জিতে ক্ষমতায় আসীন। এদিকে মমতা ব্যানার্জী লোকসভা ভোটে দুঁদে নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জীকে যাদবপুর সিটে হারিয়ে দিয়ে লোকসভায় পাড়ি দিয়েছেন।
আনন্দদের জীবনে এইসব ঘটনার গুরুত্বকে ছাপিয়ে গেছে আরও দুটো ঘটনা। এক জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের স্তিমিত হয়ে পড়া আর ইলেকশনে তাদের প্রিয় এম সি ডি এস এ- র পরাজয়। আলাদা আলাদা বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুগুলো আলাদা। তথাপি সব বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুগুলো একটি বিন্দুতে ঘনীভূত হলে বৃত্তগুলি তখন আর পৃথক থাকে না। এত বড় দেশ ভারতবর্ষ। কত সমস্যা, টানাপোড়েন, দাঙ্গা, বিভাজন সব যেন আলাদা আলাদা বৃত্তের গল্প। যখন দেশে গভীর কোন সুখ ঘনিয়ে আসে তখন যেন সেই বৃত্তগুলো এক হয়ে যায়। যেমনটা ঘটেছিল ‘৮৩ সালে প্রথম ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতে আসার পরে। গভীর কোনও সংকটেও কি তাই না? এক বিপুল সংকটের সাক্ষী হতে হল আপামর ভারতবাসীকে। ডিসেম্বরের শুরুতেই এক সকালে সংবাদপত্রে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে গেল সারা দেশ। দোসরা ডিসেম্বর শেষ রাতে ভোপালের বহুজাতিক সংস্থা ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানায় একটা বিশাল ট্যাংক থেকে মিথাইল আইসোসায়ানেট নামের মারাত্মক রাসায়নিক গ্যাস বেরিয়ে আসে। হাওয়ার সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অসংখ্য মানুষ। কত মানুষ? সরকারি মতে সংখ্যাটা সাত হাজার, বেসরকারি মতে কুড়ি হাজার।
জুন মাসের গরমের হল্কা মুখে চোখে এসে লাগতেই ট্রেনের দুলুনিতে আসা চটকা ঘুমটা ভেঙে গেল। আনন্দ টের পেল ভীষণ রকমের মন খারাপ ছেয়ে আছে চারপাশে। কে জানে কেন মায়ের জন্য মনটা কেমন করে উঠল। তার মা চলে গেছে সে তো বছর ছয় হতে চলল। প্রথমে মেনে নিতে পারত না কিন্তু এখন অনেক গা সওয়া হয়ে গেছে। তবু এই যাত্রায় কেন যেন মায়ের কথা মনে পড়ে যেতে বুকটা হু হু করে উঠল। যুক্তিবাদী মনের কোনও শাসনই আর মানতে চাইল না তার আবেগ সিঞ্চিত মন। কেবল বাইরে সে সবের আঁচ পেল না তার বন্ধু ও সহযাত্রী সুদর্শন ওরফে সুদো। ওরা দু’জনেই এখন হাফ ডাক্তার। এখন চলেছে ভোপালে গ্যাস পীড়িতদের ত্রাণ কাজে সাহায্য করতে।
আনন্দরা ভোপালে এসে পৌঁছে স্থিতিশীল হয়েছে। তাদের থাকার জায়গা হয়েছে প্রফেসর কলোনী বলে একটা জায়গায় এক তলার একটা ঘরে। ঠাসাঠাসি করে অনেক জনের থাকা। তার ওপর নিত্য কোনও না কোনও আক্টিভিস্টের আসা যাওয়া লেগেই আছে। ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার চৌহুদ্দীর মধ্যে একটা মুক্তাঞ্চল বানিয়ে সেখানে ছাউনি তৈরি করে আন্দোলনকারীরা একটা অস্থায়ী ক্লিনিক করেছেন। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, যার গায়ে লেখা জনগণের দাবীতে লক্ষ লক্ষ গ্যাস পীড়িতদের মানবিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার জন্য ১৯৮৫ সালের ৩ রা জুন এই হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হল।
ত্রিপলের ছাউনি বানিয়ে চলে ক্লিনিকের কাজ। ক্লিনিকের পরিকাঠামো বলতে কয়েকটা তাক, বেঞ্চি চেয়ার আর উদ্যোক্তাদের মনোবল, আর অসংখ্য পীড়িত মানুষের আশা। সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু হয়। মানুষ জড়ো হন চিকিৎসা করাতে। কারখানার আশেপাশে থাকা গরীব মানুষ, স্বজন হারিয়েছেন, স্বাস্থ্য হারিয়েছেন, এখন আগামীর বীভৎসতার মোকাবিলা কি করে করবেন জানা নেই। বেঁচে আছেন এই সান্ত্বনা যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, অসম্ভব দুর্বল লাগা এই সব উপসর্গ নিয়ে মানুষ হাজির হচ্ছে। আনন্দ মনে মনে ভাবে তাদের মতো হাফ ডাক্তাররা এদের কথা মন দিয়ে শুনছে বটে কিন্তু চিকিৎসার কিনারা করতে পারছে কি? মিক তথা মিথাইল আইসোসায়ানাইড গ্যাস সম্বন্ধে এবং মানব শরীরে তার বিষক্রিয়া নিয়ে কিছুই ঠিক করে জানা নেই। এই মিক তো সহজলভ্য নয়, কাজেই ভোপালের এই ঘটনার পর যখন মানব শরীরে তার প্রবেশ ঘটল, তার চিকিৎসা নিয়েও কোনও কুল কিনারা করে উঠতে পারছে না কর্মরত ডাক্তাররা। কেবল মিক নয়, ক্রমে ক্রমে জানা গেল তার সঙ্গে ছিল ফসজিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। অনেক কষ্টে সোডিয়াম থায়োসাল্ফাইট ইঞ্জেকশন যোগাড় করা হল, কারণ জানা গেছে এই ইঞ্জেকশন দিতে পারলে মিক-এর ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা কমানো যাবে। চিকিৎসা যেমন চলছিল তার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল তথ্য সংগ্রহ আর অনুসন্ধান। সকাল থেকে শুরু করে কাজ সারতে রাত দশটা বেজে যায়। বিশ্রাম নেই, কাজের ফাঁক তাল খুঁজে পাওয়া দায়। দিন সাতেক কেটে গেছে। এখনও শহরটা ঘুরে দেখারও সুযোগ হয় নি। তবে সে সুযোগ এসে গেল একদিন। শহরে মিছিল হবে পরেরদিন তাই ক্লিনিক জলদি বন্ধ হল সেদিন। সুদো, আনন্দ আর কয়েকজন মিলে শহর দেখতে বেরোল। ইতি উতি ঘোরাঘুরি, আড্ডা, গান সব সেরে যখন ঘরে ফিরল তখন ওদের ক্লান্ত শরীর গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। কিন্তু ওরা জানতেও পারল না কি সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে ওদের সাথে, সেই রাতে। আকাশের নীলাভ আঁচলের গায়ে মিটিমিটি তারাদের জ্বলে ওঠা সেই রাতের কথা আনন্দের চিরকাল মনে থাকবে।
ক্রমশঃ…