সে রাতে আনন্দ আর সঙ্গীরা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আচমকাই পুলিশ বাসায় ঢুকে টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলল ওদের। কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়া কেন ওদের তোলা হল তা বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় চলে গেল ওদের। কেন ওদের বিনা অপরাধে থানায় আনা হয়েছে জানতে চাইলে কপালে জুটল চড় থাপ্পড়। যত নষ্টের গোড়া তো ওই সোডিয়াম থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন। সায়ানাইড বিষের প্রতিষেধক হল সোডিয়াম থায়োসালফেট। ভোপালের গান্ধী মেডিকাল কলেজের ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান ডা হীরেশ চন্দ্র গ্যাসকান্ডে মৃতদের শবব্যবচ্ছেদ করে রায় দেন গ্যাস-আক্রান্তদের শরীরে সায়ানাইড বিষের অস্তিত্ব আছে। তিনি সুপারিশ করেন জীবিত গ্যাস-আক্রান্তদের থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন রূপে দেওয়া হোক। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের কারখানার চিফ মেডিকাল অফিসার দুর্ঘটনার পর পরই ডিসেম্বরের চার তারিখে এক টেলেক্স-বার্তায় বিষ-গ্যাসের প্রতিষেধক হিসেবে সোডিয়াম থায়োসালফেট ব্যবহার করতে বলেন। তার দিন চারেক পর ৮ই ডিসেম্বর বিখ্যাত জার্মান বিষ বিশারদ ম্যাক্স ডন্ডেরারও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করলেন। ভারতে সোডিয়াম থায়োসালফেট তৈরি হয় না তাই তিনি ১০হাজার সোডিয়াম থায়োসালফেট ইঞ্জেকশনের এম্পুল রেখে গেলেন। কিন্তু বাধ সাধতে লাগল ভোপালের সরকারী চিকিৎসকরা, পুলিশ, প্রশাসন। তারা নানাভাবে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার মালিকের প্রসাদধন্য। থায়োসালফেটে গ্যাস-পীড়িতদের অবস্থার উন্নতি হওয়া মানে বিষ-গ্যাস মিশ্রণে সায়ানাইডের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়ে যাওয়া—এতে ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানীর ক্রিমিনাল রেপন্সিবিলিটি অনেকগুণ বেড়ে যায়। সরকার ইঞ্জেকশন দিচ্ছে না। তাই দুর্ঘটনার প্রায় ছ’ মাস পরে আক্রান্তরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে কারখানার প্রাঙ্গণেই জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এই ইঞ্জেকশন দেওয়া শুরু করেছিল। সেই উদ্যোগে যোগ দিতেই আনন্দদের কলকাতা থেকে ছুটে আসা। আনন্দরা যে ক্লিনিকের হয়ে কাজ করতে এসেছে, আর সেখানে চিকিৎসা সংক্রান্ত যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সে সব পন্ড করে দিতে না পারলে মামলায় সুবিধা হবে না। তাই এই সার্জিকাল স্ট্রাইক। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হল। সরকার ওষুধ সাপ্লাইও বন্ধ করল। অগত্যা কলকাতায় ফিরে যেতে হল ওদের।
শুভ-র হাউস জব চলছে। সঙ্গে চলছে পরবর্তী কাজের জায়গা খোঁজা। তার মন তো ঠিক করাই আছে নো পোস্ট গ্রাজুয়েশন। ভাল করে সার্জারির কাজ শিখে সমাজের জন্য কাজ করা। ইতি উতি খোঁজ চলছে। চীনের মুক্তি যুদ্ধের মতো কোনও যুৎসই মুক্তি যুদ্ধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নয়া দিল্লিতে সান্দিনিস্তা সরকারের এক প্রতিনিধির খোঁজ পেয়ে তাকেই চিঠি লিখল। নিকারাগুযায় সবে তদানীন্তন সাম্রাজ্যবাদের দালাল সরকারকে হটিয়ে সান্দিনিস্তা সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সে দেশে এখন চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মী দুই দরকার। কিন্তু হায় সে চিঠির জবাব এলো না। খোঁজ চলছেই। পশ্চিমবঙ্গের যে সব সমাজ পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী আছে তাদের কাছে রাজনীতির গুরুত্ব কাজের থেকে বেশি। কাজেই শুভ-র সুবিধে হল না বিশেষ। কাজের জায়গা সম্বন্ধে সাত পাঁচ যখন ভেবে চলেছে ঠিক সেই সময়ে ভোপালের দুর্ঘটনা এবং ঘটনার ক্রম শুভ-র কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একদিন ও আর সুদো মিলে চেপে বসল ভোপালগামী ট্রেনে। দেখে আসা যাবে পরিস্থিতি। ওখানে গন্ডগোলের খবর পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্তই হল ইউনিয়ন থেকে। বেশ রোমাঞ্চিত হল শুভ। ধরপাকড় আছে, পুলিশি হামলা আছে, বন্ধ স্বাস্থ্য কেন্দ্র খোলার উন্মাদনা আছে। আর কি চাই?
এখন বর্ষা নেমেছে ভোপালে। গত কয়েক মাসের গরম থেকে কিছুটা মুক্তি এখানের মানুষের। যদিও এসবে আর কিছুই যায় আসে না বিলকিশ, রসিদা, বিহারী বা নার্গিসদের। ওদের কাছে বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত অভিশাপ এখন। শ্বাসকষ্ট, খিদে কমে যাওয়া, পেটে ব্যথা, খাওয়ার পর পেট ফাঁপা, বুক-জ্বালা, দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া, মাংসপেশিতে ব্যথা এসব নিয়ে জেরবার ওদের জীবন।
মেয়েরা মাসিক ঋতুচক্রের অনিয়মিততায় ভুগছেন। গর্ভপাতের হার বেড়ে গেছে। গ্যাস-আক্রান্তরা, বিশেষত শিশুরা ফুসফুস-পেট-চামড়ার ছোঁয়াচে রোগে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের এই দুর্দশা শুভ-র সংবেদনশীল মনে গভীর রেখাপাত করে। যদিও তাকে বাইরে থেকে দেখলে সেসব বোঝার উপায় নেই। কলকাতা ছেড়ে এসে ইস্তক কেমন মনটা চিন চিন করছে। প্রেমে ধাক্কা খেলে বোধহয় এমন ব্যথা অনুভব করাটাই স্বাভাবিক। জীবনের এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে তার নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে নি:স্ব মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। হয়তো এই ধাক্কাটাই তাকে আরও বেশি করে ভাল মানুষ হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভোপালের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনের কোণের শূন্যতা যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এখানে কাজ করছে অনেকগুলি সংগঠন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল অনিল সদগোপালজীর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা জহরিলি গ্যাস কান্ড সংঘর্ষ মোর্চা। এছাড়াও আছে নাগরিক রাহাত আউর পুনর্বাস সমিতি (এনআরপিসি), বোম্বের ট্রেড ইউনিয়ন রিলিফ ফান্ড। একটা ছোট রাজনৈতিক দলও ছিল এদের সাথে। এরা এবং ইউনিয়ন কার্বাইড কর্মচারী সংঘ মিলে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালাত। অনিল মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদে পালিয়া পিপারিয়া গ্রামে কিশোরভারতী নামের একটি সংস্থা চালান। বিজ্ঞানী অনিল নিজের অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ছেড়ে গ্রামের শিশুদের বিজ্ঞান শিক্ষায় মনোনিবেশ করেছেন। শুধু শিক্ষাই নয়, কৃষি এবং স্বাস্থ্য এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তিনি কাজ শুরু করেছেন।
ভোপালে এসে শুভ-র কাছে একটা অভূতপূর্ব সুযোগ এসে গেল। ছত্তিশগড়ের শহীদ হাসপাতাল তৈরি ও সেখানে কলকাতার ডাক্তারদের যোগ দেওয়া, কাজ করা সব খবরই শুনেছে। সেই সব কিছুর পিছনে সূর্যের মতো জ্বল জ্বল করছে যে মানুষটা, সেই বৃহৎ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শুভ-র। দীর্ঘদেহী মানুষটার জলদ গম্ভীর সুরের আলাপচারিতা শুভর মনটাকে ভিজিয়ে দিল। বলেই ফেলল, সে কাজের ক্ষেত্র খুঁজছে, শহীদ হাসাপাতালে কাজ করতে ইচ্ছুক। সামান্য নীরবতার পর উত্তর এল। আপাতত: হাসপাতালের বেড কম সংখ্যায় ডাক্তার বেশি। শুভ দ্বিধান্বিত। আগামীর খবর কে বা জানতে পারে। এখন এগিয়ে চলার নাম জীবন। চরৈবতি চরৈবতি। শুভ মনে মনে ঠিক করল, এই ভোপালের মানুষগুলোর জন্যই কাজ করবে। এই হোক ওর কাজের ক্ষেত্রে।
ভোপালে কাজ করবে মনস্থির করে স্থায়ীভাবে এসে অনেক কিছুই দেখতে বুঝতে শিখতে লাগল শুভ। প্রতি সপ্তাহে ৫০জন করে রোগীর চিকিৎসা করা হত। প্রথমে তাঁদের উপসর্গগুলো লিপিবদ্ধ করা হত। সোম থেকে শনি রোজ এঁদের শিরায় থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন লাগানো হত—তৃতীয় ও ষষ্ঠ দিনে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা হত রোগী কতটা লাভবান হলেন, সে তথ্য নথিভুক্ত করা হত। এখানে এসে গ্যাস পীড়িত মানুষদের সাথে কথা বলে কত কিছুই না জানতে পারছে। এক ধরনের মানুষ দেখছে —যাঁরা কিছুতেই ওই দুর্ঘটনা নিয়ে কোনও কথা বলতে চান না। ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা এড়িয়ে চলেন। গ্যাস কান্ডের কথা বললেই প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েন। এমন কি কিছু মানুষ গ্যাস-কান্ডের কথা মনে পড়লে অনুভূতিশূন্য হয়ে বসে থাকেন, ঠিকমত ঘুমোতে পারেন না, অল্পতেই চমকে ওঠেন, অনেক সময় দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে পড়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। শুভ বুঝে পায় না এই উপসর্গ গুলো কেন হচ্ছে।
সন্ধ্যের দিকে পেটটা খিদেতে যেন চুঁই চুঁই করে ওঠে। মাসের শেষ। হাতে টাকা কড়ি কিছু অবশিষ্ট নেই। খাবার খাবে না কি সিগারেট কিনবে? শুভ ভেবে পায় না। যে জনস্বাস্থ্য কমিটির ডাকে কাজ করতে এসেছে তারাই শুভ-র থাকা খাওয়ার খরচ চালাবে এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাদের সে সঙ্গতি নেই। তবে চলে কি ভাবে? মেডিক্যাল কলেজের বন্ধুরা চাঁদা তুলে পাঁচশো টাকা করে পাঠায়। তাই দিয়ে থাকা খাওয়া, সাইকেল ভাড়া, সিগারেটের খরচ সব চালাতে গিয়ে মাসের শেষে পকেট ধু ধু গড়ের মাঠ।
স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে শুভ এই পথ কেন বেছে নিয়েছে? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন রাখল সে। ডুবন্ত সূর্যের আলো মেঘের আড়াল থেকে বর্ণময় ছটায় চারপাশ রক্তিম করে তুলেছে।
এই সময়ে মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে ক্রাইসিস আসা দরকার। সংকটের মুহূর্তেই মানুষ পথ খোঁজে। পথ খুঁজে পায়। শুভ বুঝতে চেষ্টা করে আসলে সে কি চায়? এই সমাজের অধিকাংশ মানুষ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। অশিক্ষা, কুসংস্কার, অস্বাস্থ্য যেন নাগপাশে জড়িয়ে রেখেছে তাদের। সেই সব মানুষের মুক্তি চাই। যেন এক লহমায় শুভ বুঝতে পারে এর থেকে বড় আর কি বা চাওয়ার আছে। মানুষের মুক্তি! মানুষের মুক্তিতেই তারও মুক্তির পথ খুলে যাবে। এই সব মানুষের জন্যেই তাকে কাজ করতে হবে। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তবু শুভ জানে এই অন্ধকার ঘোচাতে গেলে একটা দীপ জ্বালাতেই হবে।