নভেম্বরের মাঝামাঝি ভোপাল থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছে শুভ। ওখানে থেকে যাওয়ার এবং কাজ করার যে ইচ্ছেটা মনে নিয়ে গেছিল সেটা পূরণ হতে পারল না নানা কারণে। যারা সংগঠক তাদের অনেক আচরণ মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। নীতিগত বিভেদ একটা বড় কারণ। তা ছাড়াও ছিল আর্থিক সমস্যা। কিন্তু এ সবের থেকেও যেটা বড় সেটা হল ওখানে থেকে কাজ শেখা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। রোগীকে ইঞ্জেকশন দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করার সুযোগ ছিল না। অথচ শুভ-র মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল একটা সুপ্ত বাসনা। সার্জারির কাজটা খুব ভাল ভাবে শিখবে। যাতে মানুষের কাজে সম্পূর্ণ নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। ভোপালে গিয়ে সেই কাজ শেখাটাই যেন থমকে গেল। অবশেষে শুভ কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। এখনও তাকে মেডিক্যাল কলেজের কাছে ঝুলি পাততে হবে। শিক্ষার পাট শেষ হয় নি যে এখনও। ভাল করে সার্জারির কাজ শিখতে হবে।
কলকাতায় ফিরে ইস্তক শুভ-র মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। একদিকে মায়ের স্পর্শ-গন্ধ লেগে থাকা চেনা শহরের ওম, বন্ধুদের সাহচর্য্য। আর অন্যদিকে একটা হেরে যাওয়ার গ্লানি। সেদিন সন্ধের পর কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চে বসে নিজের সঙ্গে একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে বলে শুভ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল কলেজ গেটের দিকে, হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন জামাটা খামচে ধরে এক টান দিল। একটু হতচকিত হয়ে পেছন ফিরে দেখে বিনোদ দাঁত বার করে হাসছে। বিনোদ এখন আগের থেকে অনেকটা বদলেছে। প্রথম দিনের সেই গ্রাম্য ভাবটা আর নেই সেই অর্থে। নিজেকে সচেতনভাবে শহরের ধাঁচে গড়ে তুলেছে বেশ। পোশাক আশাক সব দিক থেকেই বেশ চোখে পড়ার মতন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাউস স্টাফ হিসাবে কাজ করে যা আয় হয় খুব খারাপ কিছু নয়। ইদানিং আবার বড়লোক বাড়ির এক মেয়েকে পড়াতে ঢুকে ছাত্রীর সাথে জমিয়ে প্রেম করছে। বিনোদ সত্যিই অনেক বদলে গেছে। শুভ দাঁড়ায়। বিনোদ পিঠ চাপড়িয়ে বলে, “কি রে ভোপাল সফর কেমন কাটল?” শুভ মনে মনে বিরক্ত হয়। আজকাল বিনোদের সঙ্গ একদম ভাল লাগে না। কেমন যেন বড্ড স্বার্থপর মনে হয় ওকে। একটা ছেলে যে কিনা অসম্ভব দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে এই জায়গায় এসে পৌঁছল সে বেমালুম নিজের অতীতকে অস্বীকার করতে চাইছে, হাবে ভাবে, পোশাকে, ব্যবহারে যে প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে সেই অতীত থেকে পালাবার। শুভ কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে। “তোর বাড়ির খবর কি বল?” গলায় কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ পায়। বিনোদ দাঁত বার করে হাসতেই থাকে। “যাই নি এবার। আসলে রিমি খুব চাপ দিচ্ছে পোস্ট গ্রাজুয়েশনটা করতেই হবে। ওর বাবা বলেছে না হলে বিয়ে দেবার কথা ভাববেন না। তাই….” বিনোদ থামে। শুভ-র বিরক্তি বাড়ে। বিয়ের জন্য পড়া! মনে মনে ভাবে এখন একে এড়িয়ে যেতে পারলে সুবিধা হত। এই মূহূর্তে ওর একা থাকতে ইচ্ছা করছে। শুভ এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে “আমার একটা কাজ আছে রে, আজ চলি। পড়ে দেখা হবে।” বলেই হন হন করে হাঁটা দেয় গেটের দিকে। এতদিনে শুভ বুঝে গেছে, ওদের মধ্যে কিছু জন আছে যারা নিজেদের কেরিয়ার গড়তে ব্যস্ত। কিছু জন আছে যারা স্বপ্ন দেখবে, দেখাবেও কিন্তু সময় আসলে নিশ্চিন্ত জীবন আঁকড়ে ধরবে। সেটা শুভ-র থেকে ভাল আর কেউ বোঝে না। অনেক ক্ষণ একা বসে থাকল সে। কলেজ স্কোয়ারের এক কোনে এক চিলতে অন্ধকারে মিশে যেতে যেতে বাতাস যেন ওর কানে কানে বলে গেল এ সব তুচ্ছ কোলাহল। আসলে মুক্তির লড়াই অন্য, অন্যত্র কোথাও। এ শুধু প্রস্তুতি পর্ব। সে দিন বেশ রাত করে বাড়ি ফিরল শুভ। অনেকদিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুলো। যেন সব হেরে যাওয়ার ওপর একটা মলম লাগিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কবে সেই দিনটা আসবে, যেদিন ওর লক্ষ্যে পৌঁছনোর সুযোগ এসে যাবে।
দল্লিরাজহরার খবর পেয়ে এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসেন সেখানকার কান্ড কারখানা দেখতে। তাঁরা ঘুরে ঘুরে সব দেখেন। শ্রমিক শ্রেণী তথাকথিত “ছোটলোক” বলেই যাঁরা পরিচিত সমাজের শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর কাছে সেই শ্রমিকদের পরিশ্রমে গড়ে তোলা হাসপাতাল, স্কুল, বিনোদনের মাধ্যম সব কিছুতেই তাঁদের বিস্ময় জাগে। এও কি সম্ভব? এখন শীতকাল। গ্রামে গ্রামে প্রায়ই মেলার আয়োজন করা হয়। শহীদ হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, মেলা দেখতে যান। তাঁরা এখন এই জনজাতির মানুষগুলোর কাছে ভগবান। যদিও প্রতিনিয়ত কুসংস্কার, ওঝা যাদের স্থানীয় ভাষায় “বৈগা” বলা হয় ইত্যাদির সঙ্গে লড়াই করে যেতে হয় ওঁদের। ডায়ারিয়ায় অচেতন হয়ে পড়া রোগীর চিকিৎসা চলে ঝাড় ফুঁক করে।এমন কি ডাক্তারবাবুরা অসুস্থ হলেও ভালবেসে ঝেড়ে দিয়ে যায় বৈগা। ডাক্তারবাবুরা এখানে শুধুই চিকিৎসক নন।তাঁদের ভূমিকা সমাজসংস্কারকের। মৃত্যু পথ যাত্রী রোগীকে তুলে এনে হাসপাতালে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলেন। তারপর মানুষকে বোঝান জল কি ভাবে ফুটিয়ে জীবানু মুক্ত করা যায়। ডায়ারিয়া হলে কি ভাবে নুন চিনির ঘোল বানিয়ে খাওয়াতে হবে। শুধু রোগের চিকিৎসা নয় কি করে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা যাবে এবং কেন তা জরুরী তা বোঝানোও ডাক্তার বাবুদের কাজ। তার জন্য জন সংযোগ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। তাই গ্রামের মানুষদের আনন্দে, দু:খে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাও একটা বড় কাজ। শহরের জৌলুস থেকে অনেক দূরে, মধ্যপ্রদেশের এই প্রত্যন্ত গ্রামে আদিবাসী জনজাতির নিত্য দিনের যাপনে নিজেদের অভিযোজিত করা বড় সহজ কাজ নয়।কলকাতা বা অন্যান্য বড় শহর থেকে ঘুরে দেখতে আসা এক রকম। কিন্তু সেখানে বরাবরের জন্য থেকে যাওয়ার সংকল্প নেওয়ার মধ্যে অনেকটা ত্যাগ স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতা মিশে থাকে। শহীদ হাসপাতালের কাজ সামলাবার পর ঘরে ফিরে এসে মনে হয় যেন একটা শূন্যতা চারপাশ থেকে গিলে খেতে আসছে। এই ভাবেই কাটছে এখানকার ডাক্তারদের দিন। নিয়োগীজি প্রায়শই কাজের খাতিরে এদিক ওদিক চলে যান। থাকলে ওনার সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কাটে। কালেভদ্রে ওনার সাথে ভিলাই যেতে হলে সে এক উপরি পাওনা। পথে যেতে যেতে অনেক কিছু জানতে পারা যায় ওনার থেকে।হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা যে অনেক তা বলা যাবে না। তবে মাঝে মাঝে ক্রিটিকাল কেস এসে পড়ে। তখন সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
দেখতে দেখতে এই বছরটাও প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গেল। রাজহরায় কর্মরত ডাক্তারদের সঙ্গে শুভ-র যোগাযোগ আছে চিঠির মাধ্যমে।শুভ-র হাউস স্টাফশিপের টার্ম নভেম্বরে শেষ হচ্ছে। ও ঠিক করেছে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে একবার দল্লি রাজহরায় যাবে। নিজের চোখে সব কেমন চলছে দেখে আসবে। যদি কাজের সুযোগ থাকে এবং ওরা নিতে রাজি থাকে তবে আগামী ডিসেম্বর থেকে ওখানেই জয়েন করবে। এখানে ইমার্জেন্সীতে শুভ একা। কাজেই সব সময় অন কল থাকতে হয়। একটু কোণ ঠাসা মনে হয় নিজেকে। অন্য কোনও গঠনমূলক কাজ করার সময়ই পাওয়া যায় না।এই সপ্তাহে শহীদ হাসপাতালের ড: আশীষ কুন্ডুকে একটা চিঠি লিখবে ঠিক করল শুভ। শহীদ হাসপাতালে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাটা মনের মধ্যে সযত্নে রোপন করে তাকে লালন পালন করতে থাকল সে। কি হবে সে তো সময়ই বলতে পারে।