দু’ধারে মোটা গোছের দুটো বিনুনী, টলটলে গোল মুখে ছড়ানো একটা আলগা লাবণ্য। সাধারণ চেহারা। কেবল চশমার আড়ালে থাকা ঝকঝকে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ যেন অসাধারণ। অলকানন্দা নিজেকে একটা সাধারণ মেয়েই মনে করে। তার পরিবার, পারিপার্শ্বিক পরিমন্ডল, সব কিছুর সঙ্গে এই সাধারণ তকমাটাই মানাসই। তার সকাল জুড়ে থাকে গলির কলে জল নিতে আসা সাধারণ মানুষের কলতান, রিকশার প্যাঁক প্যাঁক, ফেরিওয়ালার হাঁক, পথ চলতি মানুষের কথোপকথন, হাওড়া শহরের শতাব্দী প্রাচীন ক্লান্তি। অলকানন্দা বাঁধাঘাটের ফেরি পেরিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তে যায়। তার কলেজের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এশিয়ার বৃহত্তম বই বাজার। সেখানে অবাধ যাতায়াত ওর। দুধারের বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে সস্তায় বই কেনে। বই পড়তে ভাল লাগে খুব। ওর দাদা ওকে বই পোকা বলে ডাকে। এহেন অলকানন্দাও এই উপন্যাসের এক কোণে জায়গা করে নিল নিজের সাধারণত্বের জোরেই। কারণ এই উপন্যাস তো আগাগোড়া সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের গল্প। অলকানন্দা ভারি সংবেদনশীল মেয়ে। পৃথিবীর যাবতীয় সংঘাত তার অন্তরে তরঙ্গ তোলে। এই মূহূর্তে আফ্রিকায় চলছে ভূমিপুত্রদের স্বাধীনতার লড়াই। গোটা আফ্রিকা মাথা দুলিয়ে জেগে উঠেছে, “নকোসি সিকেলে আফ্রিকা” অর্থাৎ কিনা জাগো মাতৃভূমি আফ্রিকা। বর্ণ বৈষম্য আর শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে সেখানের মানুষ সংগ্রাম করে চলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসক গত মাসে অর্থাৎ এই ১৯৮৫ সালের আঠোরই অক্টোবর ফাঁসি দিয়েছে আফ্রিকার কবি সন্তান বেঞ্জামিন মোলায়েজকে। সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল কলকাতার বুকে। কলেজ স্ট্রীটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যুবক-যুবতীর দল সোচ্চারে গেয়ে উঠল, জাগো মাতৃভূমি, জাগো আফ্রিকা। এদিকে কেপ টাউন শহরের পোলসমুর জেলে বন্দীদশায় দিন কাটাচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এইসব তরঙ্গ ছুঁয়ে যায় মেয়েটাকে। চারপাশে এত অন্ধকার তবু লড়াইয়ের জোর মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন চেতনার দিকে। দীপ জ্বলে ওঠে বারবার। আলো পথ দেখায়।
অলকানন্দা রাতে শুয়ে দিদির কাছে গল্প শোনে দল্লিরাজহরা বলে এক দূর গাঁয়ে শ্রমিকদের পরিশ্রমে, পয়সায় তিল তিল করে গড়ে উঠেছে এক হাসপাতাল। শহীদ হাসপাতাল। তার দিদি বলে সেও যাবে ছত্তিশগড়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে ওখানে কর্মরত ড: জানা-র সাথে। অলকানন্দা মনে মনে ভাবে অগুনতি মানুষ সারা পৃথিবী জুড়ে যে সব লড়াই করে চলেছে তা যেন এক সূত্রে বাঁধা। এই মূহূর্তে মনে মনে সেই প্রত্যেকটা লড়াইয়ে সামিল হয়ে যাচ্ছে সে। তার মনের গভীরে একটা বোধ নড়াচড়া করতে থাকে। এই গাঢ় অন্ধকার দূর করতে চাইলে, শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। সে কি পারবে শিক্ষার একটা দীপ জ্বেলে দিতে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে। বুকের ওপর আধ খোলা পড়ে থাকে সমরেশ মজুমদারের কালপুরুষ।
শুভ-র মাথায় এখন একটাই চিন্তা ঘুরতে থাকে। ছত্তিশগড়ের মানুষের লড়াইয়ে সে কি করে সামিল হতে পারে। ভোপালে যাওয়ার এবং সেখানে নিয়োগীজির সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি ঘুরে ফিরে ছবির মতো ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ভোপাল জেলে বন্দী হয়ে থাকা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার ডাক্তার, স্বাস্থ্য কর্মী ও ক্লিনিকের সংগঠকদের সেদিন জামিনে ছাড়া পাওয়ার কথা। জেলের পিছনে টিলার ওপারে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আর দীর্ঘদেহী মানুষটা তখন স্লোগান তুলছে “জেল কা তালা টুটেগা, হামারা সাথী ছুটেগা”। সঙ্গে সঙ্গে জমায়েত হওয়া মানুষ স্লোগান তোলে সমস্বরে। পরনে আধ ময়লা পাঞ্জাবী পায়জামা, কিন্তু তার দীপ্ত ভঙ্গী, তার গলার স্বরের দৃঢ়তায় প্রকাশ পায় তার সততা। সেই মানুষটা ডেকেছে ওকে, বলেছে, “রাজনন্দগাঁওয়ে আর একটা হাসপাতাল খুলব ভাবছি, চলে আসুন…”
শুভ যাবে তো বটেই। একবার দল্লিরাজহরা গিয়ে নিজের চোখে সব কিছু দেখে আসবে। যদি মনে হয় কাজের সুবিধা আছে আর ওরা যদি রাজি হয় তাহলে এর পরে ওখানেই জয়েন করবে। তবে আর একটা বিষয় শুভকে খুব ভাবায়। সেটা হল ওষুধের যুক্তি সঙ্গত ব্যবহার। স্যার অর্থাৎ ড: পীযূষ কান্তি সরকারের কাছে যা শিখেছে তার প্রয়োগ করা খুব জরুরী। ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের আন্দোলনকে ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব প্রয়োজন। ‘মানুষের জন্য ওষুধ না ওষুধের জন্য মানুষ’। ১৯৮৩-র ২৩শে জুলাই ভারতের ওষুধ মহানিয়ন্ত্রকের দপ্তর ১২ ধরনের ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু চিকিৎসক মহল তা প্রয়োগ করায় আগ্রহী? ওষুধ কোম্পানী ওষুধ তৈরী করে মুনাফার জন্য। কিন্তু তার যুক্তি সঙ্গত প্রয়োগ চিকিৎসকের আওতায় পড়ে।
কিছুদিন আগে ঘটা একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় ওর। সেদিন সোমবার ছিল। শুভ হাউস স্টাফ হস্টেলের রুমে শুয়ে কিছুটা পত্রিকা পড়ছে। শিশু নিবাস থেকে সিনিয়র হাউস সার্জেন হিসাবে কল এল। দুপুরের ওয়ার্ডের সিস্টার কল পাঠালেন, রোগী ভর্তি হয়েছে আসতে হবে। শুভ গিয়ে দেখল বছর চারেকের একটি ছেলে। খাদ্যনালীতে অবস্ট্রাকশন। চার পাঁচ দিন পাতলা পায়খানায় ভুগছিল। কলেজেরই এক নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রাইভেট চেম্বারে দেখেছেন। প্রেসক্রিপশনে ছিল অনেকগুলো ওষুধ, জীবাণুনাশক, টাইফয়েডের ওষুধ, আমাশার ওষুধ, পায়খানা ঘন করার ওষুধ, সঙ্গে ইলেক্ট্রাল। ওষুধের প্রভাবে রবিবার থেকে পায়খানা পেচ্ছাপ বন্ধ, পেট ফুলতে লাগল। কিন্তু শুভ বাঁচাতে পারেনি ওকে। পাতলা পায়খানার জন্য ওর শরীরে জল নুনের ভারসাম্য একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছিল। যদিও প্রেসক্রিপশনে ইলেক্ট্রাল লেখা ছিল কিন্তু জল আর পাউডারের অনুপাত রোগীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। অথচ শতাব্দীর সেরা ডাক্তারি আবিষ্কার, ডায়ারিয়ায় ওআরএস-এর ব্যবহার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রতিষ্ঠিত। মেডিক্যালের সিলেবাসে ডায়ারিয়ার জন্য বরাদ্দ এক ঘন্টা। অথচ সংক্রামক রোগের মধ্যে ভারতে ডায়ারিয়া অন্যতম। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। এই সব অভিজ্ঞতা সংবেদনশীল শুভকে লক্ষ্যের দিকে আরও ঠেলে দেয়, দৃঢ়তর করে তোলে।
ফিচার চিত্রঃ বেঞ্জামিন মোলায়েজ