কনকনে ঠান্ডায় হাত পা জমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ছত্তিশগড়ের ঠান্ডা আর গরম দুই-ই কলকাতার থেকে অনেকটাই বেশি। ডিসেম্বর মাসে দল্লি রাজহরায় এসে পড়ে সেটা মালুম পাচ্ছে শুভ। কনকনে ঠান্ডা পোশাক ভেদ করে, এমনকি গায়ের চামড়া ভেদ করে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাওয়ার যোগাড়। প্রথম কয়েকদিন বেশ অসুবিধা হতে লাগল ওর। ধীরে ধীরে গা সওয়া হতে লাগল জলহাওয়া, খাওয়া দাওয়া, মানুষজন। শুভ তো এখনও পর্যন্ত জানেই না ওর মাসিক ভাতা কত। হাসপাতালের পাশেই একটা বাড়িতে, তিনটে ঘর—একটাতে শুভ, মাঝখানেরটায় আশীষদা ও চঞ্চলাদি, শেষেরটায় শৈবালদা। দুবেলা ভাত আর ডাল আসে ইউনিয়নের মেস থেকে। খেসারির ডাল আর ভাত। এই ছিল প্রধান খাদ্য। বাকি কিছু খেতে হলে নিজেদের রান্না করে নিতে হবে। সকালের জলখাবারটা আপাতত: সিনিয়রদের পয়সায় হচ্ছে। কপালে মাঝে মাঝে জিলিপি না হলে চপ জুটে যাচ্ছে। দুবেলা আউটডোর, সকাল সাড়ে নটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা, আবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। সকালে আউটডোর শুরুর আগে সবাই মিলে ইনডোরে রাউন্ড দেওয়া, সন্ধ্যাবেলা আউটডোর শেষে আরেকবার রাউন্ড। এখানে এখন মোট পাঁচজন ডাক্তার, সবাই মিলে একসঙ্গে রাউন্ড দেওয়া হয়। একে অন্যের রোগী নিয়ে আলোচনাও হয়। অপারেশন থাকলে সকালে আটটা থেকে, ইমারজেন্সি অপারেশন অবশ্য যেকোনো সময়। অবসর সময়ে একসঙ্গে বসে আড্ডা হয়। শুভব্রত আর আশীষদা আলোচনা করতে থাকে দু’জনে একসঙ্গে মিলে সাফল্যের সঙ্গে অনেক অপারেশন করবে। খুব কম সরঞ্জাম। ১৮ ফুট বাই ১১ ফুটের একটা সাধারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরই অপারেশন থিয়েটার। পাশের একটা ছোট ঘরে অপারেশনের সরঞ্জাম রাখার ব্যবস্থা আছে। অপারেশনের সামগ্রী জীবানুমুক্ত করা হয় ড্রামের অটোক্লেভে। ঘর জীবানুমুক্ত করা হয় অপারেশনের আগের রাত্রে গন্ধক জ্বালিয়ে। অপারেশনের আলো হিসাবে ২০০ ওয়াটের একটা আলো জ্বালানো হয়।সামান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে ফোঁড়া কাটা, চোট লাগলে সেলাই, হাইড্রোসিল, হার্নিয়া, অর্শ, ভগন্দর এইসব অপারেশন দিয়ে শুরু এই অপারেশন থিয়েটারের কাজ। শুভ মনে ভাবে ড: কোটনিস যুদ্ধের ময়দানে এর থেকেও কম সরঞ্জামে কাজ করেছেন। তাহলে তারাই বা পারবে না কেন। শুভ হাউসস্টাফ হিসাবে সার্জারির কাজ অনেকটাই শিখেছে। এবার সেই শিক্ষা প্রয়োগের সময়।
হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শুভ-র ওপর দায়িত্ব পড়ে সার্জারি করার। প্রথম দিন থেকেই ওর আন্ডারে রোগী ভর্তি হতে থাকে। কাকে কি করবে তা বলার জন্য আরএমও, রেসিডেন্ট সার্জেন বা ভিজিটিং ডাক্তার নেই। তাই বাধ্য হয়ে শুভকে পড়াশোনা শুরু করতে হলো। এদিকে আশীষদা কলকাতায় ফিরে গেল বছর পড়ার কয়েক মাসের মধ্যে। বিনায়কদাও গেলেন কোনও এক কারণবশত:। শীত কেটে গিয়ে বসন্ত এসে গেল। দল্লি রাজহরার গায়ে লাগল ফাগুনের আগুন। থোকা থোকা পলাশের লালে, কোকিলের কুহু তানে অলস দুপুর যেন কাটতেই চায় না। একটা নতুন নেশায় পেল শুভকে। হাসপাতালের পিছনের টিলা পেরিয়ে পেছনের মহল্লায় এক ভিডিও হলে হিন্দি সিনেমা দেখা। কিন্তু এসব কিছু চলতে থাকলেও কোথায় যে একটা শূন্যতা মাঝে মাঝে ঘিরে ধরে। মন কেমন করে ওঠে নিজের শহরের জন্য। মায়ের জন্য।
শুভ এখানের পরিস্থতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর তাল খুঁজছে কি করে রাজনৈতিক কাজ কর্মে জুড়ে যাওয়া যায়। সে কি খালি ডাক্তারি করতে এখানে এসেছে? কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে নিয়োগীজি শুভ-র কিছু ভুল দেখলে তীব্র সমালোচনা করেন। অথচ ওই একই ভুল অন্য বুদ্ধিজীবি করলে তিনি কিছু বলেন না। খুব খারাপ লাগে শুভ-র। এ কেমন পক্ষপাতিত্ব। আশীষদা দের সাথে দিব্যি বসে ইউনিয়ন রাজনীতি এসব নিয়ে কথা বলছেন। অথচ ওর বেলাতেই শুধু হাসপাতাল, রুগী, ওষুধ আর চিকিৎসা। মানুষটাকে ঠিক করে যেন চিনতেই পারে না শুভ। একটা কুয়াশায় ঢাকা রাতের মতো। মনে মনে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। এদিকে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। একবার বাড়ি যেতে হয়। মাসিক ভাতা নিয়মিত মেলে না। রাজনন্দগাঁও আর দল্লি রাজহরায় শ্রমিকদের লম্বা হরতাল চলছে। তবু কলকাতায় যাওয়া স্থির করল শুভ। ট্রেনের ভাড়া ছাড়া হাতে আর এক পয়সা বেশি নেই। কাউকে বলাও গেল না সে কথা। ছোট একটা সুটকেস নিয়ে রওনা দিল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। হঠাৎই চোখ চলে গেল রাস্তার ধারের এক মোটর সাইকেল সারাইয়ের দোকানের দিকে। শুভ দেখল বেঞ্চিতে বসে নিয়োগীজি আড্ডা মারছেন দোকানের লোকটার সাথে। শুভ দেখেই হাত নেড়ে ইশারায় কাছে আসতে বললেন। কাছে যেতে বসতে বললেন পাশে। শুভ একটু অপ্রস্তুতই হল। খুব বেশি ক্ষণ বসা যাবে না। এদিকে নিয়োগীজির সেদিকে খেয়াল নেই। বলে চলেছেন অনবরত। শুভ মন দিতে পারছে না সব কথায়। বাসের সময় হয়ে আসছে। উসখুস করতে লাগল সে। এমন সময় একজন সাথী এসে নিয়োগীজির হাতে কিছু একটা এনে দিল। নিয়োগীজি শুভ-র হাতটা ধরে তাতে গুঁজে দিল জিনিসটা। শুভ মুঠো খুলে তাকিয়ে দেখে দু’ হাজার টাকা!
শুভ বাসের জানলায় মাথা রেখে দূরের দিকে চোখ চালিয়ে দেয়। লোকটাকে চিনে উঠতে পারে না। কখনও মনে হয় কঠোর নির্মম, কখনও মনে হয় লোকটার হৃদয় মোম দিয়ে তো তৈরি। সামান্য উষ্ণতায় গলে যাবে, ছড়িয়ে পড়বে নরম ভালবাসায়।