বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর কাজকর্ম চলছিল মোটামুটি। মনের মধ্যে ক্ষোভ জমে থাকছিল যদিও।মে মাসের বদ্ধ গরম গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল কিছুটা। এদিকে নিয়োগীজির পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে। অপারেশন করতে হবে। ভিলাই হসপিটালে ভর্তি করা হল। অনেক তর্ক বিতর্কের পরে ভিলাই হসপিটালে ভর্তি হতে রাজি হলেন। এদিকে তেসরা জুন দল্লিরাজহরায় শহীদ দিবস পালন করা হয়। ১৯৭৭ সালের সেই অভিশপ্ত দিন স্মরণ করে প্রতি বছর পালন করা হয় এই শহীদ দিবস। দোসরা জুন ইউনিয়ন ঘর থেকে নিয়োগীজিকে তুলে নিয়ে যাওয়া, তারপর শ্রমিকদের প্রতিবাদ, পুলিশের চরম পদক্ষেপ, গুলি চালনা, ২-৩ জুনে সব মিলিয়ে এগারো জন শহীদ হন। সেই মৃত্যু কি ভোলা যায়? এই শহীদদের স্মৃতিতে ১৯৮৩ সালে শহীদ দিবসে উদবোধন হয়েছিল শহীদ হাসপাতাল। শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর প্রতীক হিসাবে হাসপাতালের দ্বারোদঘাটন করেছিলেন খনির সব থেকে বয়স্ক শ্রমিক লহর সিং এবং আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে সব থেকে বয়স্ক কৃষক হলাল খোর। শ্রমিক-কৃষক জোটের শক্তি টলিয়ে দিতে পারে যে কোনও শাসকের রাজ সিংহাসন। সেদিন শ্রমিক সংঘের প্রচারপত্রে স্লোগান ছিল “তুমনে মৌত দী, হমনে জিন্দগী”। যে কোনও হাসপাতাল ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে তৈরি করে শ্রমিকরাই। কিন্তু শহীদ হাসপাতালের গল্পটাই ছিল অন্য। নিজেদের মাইনের টাকা জমা করে, নিজেদের পরিশ্রমে গড়ে তোলা এই শ্রমিক হাসপাতাল ছিল “মেহনত কশোঁকে লিয়ে, মেহনত কশোঁকা অপনা কারিয়ক্রম।” দিনে খনিতে কাজ আর রাতে হাসপাতাল তৈরির কাজ। শুনতে যত মধুর লাগে তত মধুর নয় আসল জার্নিটা। এই হাসপাতাল গড়ে তুলতে অনেক আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব এসেছে, এমনকি হাসপাতাল জনপ্রিয় হওয়ার পরেও অনেক আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব এসেছে দেশি বিদেশি বহু সংস্থা থেকে। কিন্তু শ্রমিকরা সেই সব প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছে। কারণ ওদের জানা ছিল বাইরে থেকে আসা অর্থ গ্রহণ করার ফল হল ওদের হাত থেকে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া। হাসপাতালের শুরুর দিকে ইউনিয়নের প্রত্যেক সদস্য তাদের একমাসের মাইন্সে কাজ করবার ভাতা আর ঘর ভাড়া বাবদ প্রাপ্য ভাতা চাঁদা হিসাবে দেন। এই টাকার একাংশ দিয়ে কেনা হয়েছিল প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও যন্ত্রপাতি। পরবর্তী কালেও হাসপাতালের কোনও বিকাশ বা বড় যন্ত্রপাতি কিনতে শ্রমিকরাই নিজেরা চাঁদা তুলে টাকার যোগান দিয়েছেন। তাদের হাসপাতালের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। শুভ এত কিছু নিজের চোখে দেখতে পারছে। আউট ডোরে দেখাতে সামান্য কিছু খরচ করতে হত রোগীদের, কিছু বেড ভাড়াও ধার্য করা আছে। সেই সব টাকা থেকে কর্মীদের আর ডাক্তারদের ভাতা দেওয়া হত। শুভ জানতে পারে এমন একটা স্বাবলম্বী চিকিৎসা কেন্দ্রের মডেল শিক্ষণীয় বিষয় বই কি।
পায়ের অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর সুস্থ হতে নিয়োগী শহীদ হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ব্যাস, শুভর পোয়া বারো। হাসপাতালের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলল শয্যাশায়ী নিয়োগীজির সঙ্গে আড্ডা। অনেক গল্প, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, কিভাবে এগিয়ে চলতে হবে তার সুলুক সন্ধান পেতে বেশ লাগছিল শুভ-র। কিন্তু শেখার যে এখনও অনেক বাকি! মনের মধ্যে রাজনীতি করার অদম্য বাসনাটা প্রায়ই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।কিন্তু শুভ লক্ষ্য করেছে সে সব কথা তুললেই নিয়োগীজি যেন কেমন কথা ঘুরিয়ে দেন। শুরু হয় হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে আলোচনা। অপারেশনের কাজ আরও ভালভাবে কি করে করা যায়। মজদুর আর তাদের পরিবারের মধ্য্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা কি করে বাড়ানো যায়, এই সব আলোচনা। শুভ বোঝে এগুলো জরুরী, কিন্তু রাজনীতিও তো জরুরী। সমাজ পরিবর্তনের জন্য। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। নভেম্বর এসে গেলেই বছর শেষের দামামা বেজে ওঠে।
ছোটি যে এরকম একটা কান্ড ঘটাবে সে কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি অলকানন্দা। হাতে বইটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে বাইরে রাখা খাটিয়াটায় বসে পড়ল ও। বইটার অনেকটা অংশই হাওয়া হয়ে গেছে। দিদি দেখে চোখ পাকিয়ে বলল, নে বোঝ ঠেলা। পরের বই নিয়ে পড়তে হলে একটু সাবধানে রাখতে হয়। অলকানন্দা দিন কয়েক হল দিদির সঙ্গে দল্লিরাজহরায় এসেছে। এম এ তে ভর্তি হয়েছে সবে সবে। এখানে সময় কাটে না বলে বইটা চেয়ে এনেছিল ড: মজুমদারের থেকে। সেই ‘ইস্পাত’কেও যে এমন অবলীলায় চিবিয়ে খাবে তা কে জানত! ছোট্ট হরিণ শাবকটা এখানের ইউনিয়নের আশ্রিত। জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয়েছিল কোনও এক সময়ে। তার দোসর হল একটা হাঁস। বলাই বাহুল্য সেও এই ইউনিয়নের ক্যান্ডিডেট। এহেন অসম বন্ধুত্বের জুটি দেখে যতটা ভাল লাগা জন্মেছিল, সে সব এখন মন থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। মনের জানলা বেয়ে ফুরুৎ বলা চলে। ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে আসছে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যেমন হয় সেরকম নানা লোকের নানা কথা কানে আসছে। মজুমদার সাব নাকি ভয়ানক মাথা গরম লোক। বইয়ের এই হাল দেখলে যে কি প্রতিক্রিয়া হবে সে বলা মুশকিল। অলকানন্দা লজ্জায়, উৎকণ্ঠায় এক কোণে জড়ো হয়ে বিভিন্ন সমাধানের কথা ভাবতে লাগল। মনে মনে কথোপকথন অনেক দূর এগিয়েও পড়ল। ভদ্রলোক যদি এতই অবুঝ হন তাহলে ওর কিছু করার নেই। ছোটি যে সর্বভূক সে কি করে জানবে রে ভাই! যা হোক একটা সমাধান বের করল মাথার থেকে। ঠিক করল বলবে, সে কলকাতায় ফিরে গিয়ে ডাক যোগে একটা নতুন বই পাঠিয়ে দেবে। দিদি বলল তুই কি কিরে জানলি এই বইটা ওঁর স্পেশাল কপি কিনা। ওনার কোন প্রিয়জন তো উপহারও দিয়ে থাকতে পারে। অলকানন্দা আর ভাবতে পারে না। এই করে বেলা দুপুর গড়িয়ে এল। ডাক্তাররা এই সময় দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে। তবে ড: মজুমদারকে বেশির ভাগ দিনই বেরিয়ে যেতে দেখে। এখানে ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার চল আছে। অলকানন্দার বুকে কামারশালের হাতুড়ির প্রতিধ্বনি। কতটা অপমান হতে হবে না বুঝে ভিতরে ভিতরে মন শক্ত করতে লাগল সে। নভেম্বরের আলো দুপুরের পর কিছুটা নরম হয়ে আসে। লাল মাটির রুক্ষতা যে কিছুটা হলেও মলিন। শরতের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে যেন হেমন্ত একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কি জানি কি হয়?
চিত্র: ছোটি