আমাদের অধিকাংশ ভয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা মনের জমিতে প্রোথিত। সেখান থেকে রসদ জোগাড় করে ফুলে ফেঁপে উঠে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বৃক্ষে পরিণত হতে তার আধবেলাই যথেষ্ঠ। অলকানন্দার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হল না। মনে মনে প্রচন্ড অপমাণিত বোধ করতে লাগল সে। কারণ বৃক্ষ তখন ডালপালা ছড়িয়েছে এবং কাল্পনিক কথোপকথনে ড: মজুমদারকে অসভ্য আচরণ করা একজন বদরাগী ডাক্তার বলে ধরে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করার সব রকম স্ট্রাটেজি নিয়ে ফেলেছে। বাস্তবে কিন্তু এসব কিছুই হল না। শুভ সব শুনে মুচকি হেসে বলল, ছোটি তা হলে ইস্পাত হজম করারও ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এরপর যেটা হল সেটা অন্তরের অন্দরমহলের কথা। সেসব বাইরে প্রকাশ করার এক্তিয়ার আমার মতো সাধারণ লেখকের নেই। সেকথা কবি লেখেন, ঘটনার অনেক আগে বা অনেক পরে। কিংবা যখন এসব ঘটে চলেছে দল্লি রাজহরায় তখন কলকতায় বসে কবি হয়তো লিখেছেন অলকানন্দার কথা। অলকানন্দারা থাকেন সাধারণ মেয়ে হয়ে অথচ শক্তি যোগান অসাধারণ কোনও কাজে। কবি লেখেন:
অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারি নি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো অতল; করেছিলে;পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল — ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
— ‘পড়ে রইল যে!’পড়েই থাকত – সে – লেখা তুলবে বলে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।
শুধু কি কবিই ভাসলেন?
(কবি–জয় গোস্বামী)
এদিকে শুভ-র মনের খুঁত খুঁত কিছুতেই যেতে চায় না। কিছুতেই বৃহত্তর আন্দোলনের সাথে নিজেকে জড়াতে পারছে না। নিয়োগীজি যেন শুভ-র কাজের সামান্যতম ত্রুটি সহ্য করতে পারেন না। নির্মম সমালোচনা করেন। অথচ একই ত্রুটি অন্যের বেলা তিনি গ্রাহ্যও করেন না। একদিন সিধে এই প্রসঙ্গ তুলে শুভ এই ব্যবহারে পার্থক্য কেন তার কারণ জানতে চাইল। তিনি জবাব দিয়েছিলেন খুব স্পষ্ট করে। যারা তাঁর এই মূহূর্তের সহযোদ্ধা তাদের প্রতি যে ব্যবহার তিনি করেন সেটা অবশ্যই যাদের তিনি ভবিষ্যতের সহযোদ্ধা ভাবেন তাদের থেকে আলাদা হবেই। ভবিষ্যতের সহযোদ্ধার ভুল ত্রুটি শোধরানোর জন্য তীব্র সমালোচনা তিনি করবেনই। যাই হোক একদিন সুযোগ এসে গেল আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেওয়ার। খবর এল ঠিকেদারের লোকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধেছে। শুভ-র রক্ত ফুটতে শুরু করল। আন্দোলনের এ সুযোগ ছাড়া যাবে না। কিছু সাথী নিয়ে সে রওনা দিল ঘটনাস্থলে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা তার কাছে আন্দোলন আর রংবাজী সমার্থক। শ্রমিকদের লড়াই এ সামিল হওয়ার এ সুযোগ সে ছাড়তে নারাজ। কিন্তু নিয়োগী খবর পেয়েই ছুটে এলেন সেখানে। শুভকে সেই মূহূর্তে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সে নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব হল না। কিন্তু কেন? প্রচন্ড ক্ষোভে অন্তর দগ্ধ হতে লাগল। তাকে নিশ্চয় যোগ্য মনে করেন না শঙ্কর। এছাড়া আর কোনও কারণই খুঁজে পায় না সে। আজ ডিউটি শেষে ইউনিয়ন অফিসে যাওয়ার জন্য কিছুতেই মন সায় দিল না। কিন্তু কিছু ক্ষণ পড়ে ডাক এল। নিয়োগী কথা বলতে চান। সেদিনের সন্ধে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। চোখ খুলে গেল শুভ-র। ইউনিয়ন অফিসে যেতে নিয়োগী যত্ন করে কাছে ডেকে বসালেন। “আপনারা হিরো নন। আসল সংগ্রাম জনগণের”….. নিয়োগী বোঝালেন বিপ্লবী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য শ্রমিকদের লড়াইয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। এ লড়াই তাদের অধিকারের লড়াই। কাজেই সংগ্রামের ভূমিকায় তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। শুভ বুদ্ধিজীবি। তাই তার কাজ সে লড়াই এ নেতৃত্ব দেওয়া নয়, বরং তাকে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের বিজ্ঞানে শ্রমিকদের শিক্ষিত করা, নিজের বিষয়ে (শুভ-র ক্ষেত্রে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান) মানুষকে শিক্ষিত করা। এই নতুন পথের ঠিকানা দেখানোর কাজ করতে যেন একটা দীপ জ্বেলে দিলে নিয়োগী। শুভ- র মনের যত মেঘ এক নিমেষে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল তার উত্তপ্ত হৃদয়ে। নেতৃত্বের এই অসাধারণ নমুনা যেন বিরল নীল প্রজাপতির মতো। ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে যা এক অসামান্য নিদর্শন। শুভ পছন্দমত কাজ শুরু করল ডাক্তারি ছাড়া। শ্রমিক নেতাদের স্টাডি সার্কেল নেওয়া, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, শহীদ হাসপাতালের দেওয়াল পত্রিকা স্বাস্থ্য সঙ্গবারির দায়িত্ব। তারপর প্রতি দুই মাসে সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা গুলোর উপর বুকলেট বার করা লোক স্বাস্থ্য শিক্ষামালা নামে। লোকশিক্ষা গ্রন্থমালায় সমাজ বিজ্ঞানের নানান বিষয়, অতীত সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে ছোট ছোট বুকলেট প্রকাশ। সময় যেন কম পড়তে লাগল। তার সঙ্গে চলল চিঠি লেখা।
এদিকে শল্য চিকিৎসার দায়িত্ব শুভ- ই পালন করতে লাগল। প্রাথমিকভাবে ছোটখাটো অপারেশন হতে থাকল। যেমন ফোঁড়া কাটা, চোট সেলাই, হাইড্রোসিল, অর্শ ইত্যাদি। বড় অপেরেশন সে ভাবে হয় নি। এ বছরের শুরুর দিকে একদিন ইমার্জেন্সীতে এল এক বাচ্চা রোগী। তিন বছর বয়স। ইন্টেস্টাইনে অবস্ট্রাকসন আছে। অবস্থা এমন এই মূহূর্তে তাকে কোথাও দূরে পাঠানো যাবে না। ক্ষুদ্রাংশের এক জায়গা খানিকটা পচে গেছে। তখনই অপারেশন করতে হবে। সেই অপারেশন নির্বিঘ্নে সেরে ছিল সে। Intestinal clamp ছাড়াই সেই অপারেশন করেছিল শুভ। একজন সহকারী দু’হাতের দুই আঙুল দিয়ে অন্ত্রের দুই প্রান্ত চেপে ধরেছিল যাতে রক্ত, মল না বেরিয়ে পরে অন্ত্রের খোলা মুখ দিয়ে। পচা অংশ বাদ দিয়ে ফের জোড়া লাগানো হয়েছিল। এই সব সাফল্য শুভ-র কনফিডেন্স বাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমাগত। কিন্তু ডাক্তারের জীবনে কি শুধুই সাফল্য থাকে? যখন সে অসফল হয় তখন একজন মানুষের জীবনের দাম চুকিয়ে দিতে হয়। সেই গ্লানি বইবার ক্ষমতা না থাকলে যে ডাক্তারদের মন অপরাধ বোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শুভ কি পারবে সেই ভার বহন করতে?