আদিবাসী মানুষের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার নিয়ে শুরু হল চাপান উতোর। পরিবেশের উপর খনি এবং শিল্পায়নের প্রভাব থেকে চোখ সরিয়ে রেখে যখন বলা হতে লাগল এখানকার ভূমিজ সন্তানদের কারণে জঙ্গল লোপ পাচ্ছে। আইন ও বন নীতি বনবাসীদের পেটে লাথ মারতে উদ্যোগী হল। তখন CMSS পরিবেশ সম্বন্ধে উদ্যোগ নিতে শুরু করল। ইউনিয়নের এক নতুন শাখা গঠন হল। সেই শাখা ‘অপনা জঙ্গল কো পহচানো’ নাম দিয়ে এক নতুন আন্দোলন শুরু করল। এই কর্মসূচী মারফত নিজেদের জঙ্গলের উপযোগী গাছগুলিকে বেছে নিয়ে রোপণ করা হতে লাগল। বাঁশ, শাল, মহুয়া, আম, জাম, কাঁঠাল, শিরীষ, বেল, সেগুন, নিম ইত্যাদি ছিল প্রধান। চন্দন, কাজু, বিভিন্ন ধরণের ইউক্যালিপ্টাস যেগুলো সাধারণত: বৃক্ষ রোপনে লাগানো হয় সেগুলো ছোট জঙ্গলে লাগানো হতে লাগল। এই ভাবে ধীরে ধীরে আজ এখানে ইউনিয়নের এক নিজস্ব জঙ্গল তৈরি হয়েছে। ইউনিয়নের লাগানো গাছগুলি এখন বেড়ে উঠেছে এবং এলাকায় সবুজের অংশ অনেকটা বেড়েছে। গাছগুলোতে বোর্ড লাগানো হয়েছে। তাতে গাছের স্থানীয় নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, ওই গাছ কোন পরিবারভুক্ত সে সব লেখা হয়। স্কুলের পড়ুয়ারা এই উদ্যোগ থেকে তাদের উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারে।
শংকর আজকাল ভীষণ ব্যস্ত থাকে। আগেও সে ব্যস্তই ছিল। কিন্তু ইদানীং তার নাওয়া খাওয়ার সময়টুকুও নেই যেন। কেবলই মনে হয় যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করে যেতে হবে। তার সময় ফুরিয়ে আসছে। শংকর জানে ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের অসম বিকাশের কারণ অগণিত। তবে এটা ঠিক যে হরিজন এবং আদিবাসীরা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ শ্রেণী। যেহেতু এই দুটি শ্রেণী ছত্তিশগড়ের জনসংখ্যার 60-65% নিয়ে গঠিত, তাই পুরো অঞ্চলটাই ব্যাপকভাবে পিছিয়ে। ছত্তিশগড়ের জনগণের এবার সংগ্রামের সময় এসেছে। ভিলাই নিয়ে ভাবিত সে। ভিলাইয়ের চারপাশে ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এক গাদা রি-রোলিং ইস্পাত কারখানা, যারা টিঁকে আছে ভিলাই ইস্পাত কারখানা থেকে চুরি ও তার দুর্নীতির ওপর। তিরিশ বছর ধরে এখানকার প্রতিষ্ঠিত পাঁচ জন শিল্পপতির সম্পত্তির পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই শিল্পগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা কেমন? এখানে শ্রমিক নিয়োগ ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টা সম্পূর্ণ কতৃপক্ষের খেয়াল খুশির ওপর নির্ভর করে। যে ঠিকাদারদের অধীনে তারা কাজ করে তারা বেশির ভাগই এই অঞ্চলের গুণ্ডা। কাজেই এই ঠিকা শ্রমিকদের কোনও প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও নেই। ভিলাইয়ে ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের মজুরী তুলনায় অনেক বেশি। তাই ভিলাইয়ে জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম যে টাকা প্রয়োজন তা জোটে না ঠিকা শ্রমিকদের কপালে। অস্থায়ী এই শ্রমিকদের বারবার বদলি করা হয়। জায়গা বদলের কারণে এরা ঘন ঘন দুর্ঘটনার শিকার হন। শংকর চেয়েছে এই ঠিকা শ্রমিকরা সংগঠিত হোক। হলও তাই। শিল্পপতিদের যাবতীয় হুংকার অগ্রাহ্য করে জড়তা কাটিয়ে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতৃত্বে প্রগতিশীল ইঞ্জিনীয়ারিং শ্রমিক সংঘ গড়ে উঠল। কয়েক হাজার শ্রমিক একসঙ্গে ভিলাইয়ের ত্রিশটি শিল্প সংস্থায় ইউনিয়ন গড়ে তুললেন। মিছিল, ধর্মঘট এসবের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবী তুলে ধরতে লাগলেন। শ্রমিকদের এই শক্তি বৃদ্ধি শিল্পপতিদের রাতের ঘুম কেড়ে নিল। নেমে আসতে লাগল আঘাত। ইউনিয়নের নেতা, ও সদস্যদের নির্মমভাবে আঘাত করা হয়েছে এমনকি সাংবাদিকদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না।
এই আন্দোলন শুরু করার আগে এলাকায় সংগঠনের পরিচিতি প্রয়োজন ছিল। তাই ১৯৮৯ এর লোকসভা নির্বাচন ও ১৯৯০ এর বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থী দেয় ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী না হয়েও সেই নির্বাচনগুলোতে ম্যানেজারের দায়িত্ব এসে পড়ে শুভ- র ওপর। একদিকে ডাক্তারি, অন্যদিকে ইলেকশনের জন্য কর্মসূচী নির্ধারণ, আবার আর একদিকে লেখালিখি। এই সব নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ল শুভ। এত কিছুর মধ্যেও তবু চিঠি লিখতে ভোলে না সে। অলকানন্দার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ বজায় থাকে। আসলে জীবন তার নিজস্ব খাতে বয়ে চলে। সামনের বাঁকে কি অপেক্ষা করছে তার তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে যাওয়া যৌবনের ধর্ম।
তেমনই বয়ে চলল শুভ-র জীবন।