শুভ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ক্ষয়াটে চেহারার একটা ছেলে তার দিকে ইঙ্গিত করে হাত নাড়ছে। অগত্যা দাঁড়াতে হল। “কি রে আজ ভর্তি হলি?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো সে শুভ-র দিকে। শুভ বিরক্ত হল। জানেই যখন তখন জিজ্ঞাসা করার কি আছে? তবু শুভ বুঝতে না দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। বোঝাই যাচ্ছে সিনিয়র দাদা হবে। প্রথমদিনই চটিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে একটু আলাপ করাই ভাল। শুভ মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায় ওর দিকে। শুভ সুদর্শন তার ওপরে লম্বা, পোক্ত চেহারায় একটু বেপরোয়া ভাব আছে। তুলনায় সামনের জন কিছুটা ছোটখাটো। পরণে একটা হাওয়ায় শার্ট আর প্যান্ট। নিতান্ত সাদামাটা চেহারার ছেলে। শুভ সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে শুভ-র কাঁধ ছুঁল। “চল ভাই একটু চা খাওয়া যাক, কি নাম তোর?” শুভ নাম বলতে গিয়ে তোতলামিটা কন্ট্রোল করে। ছেলেটি সে বিষয়টা খেয়াল করল কি? শুভ বুঝতে পারে না। ছেলেটি বলে ওঠে,” আমি, ফোর্থ ইয়ার, আমার নাম আশীষ।“ দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে। “চল তোকে একটা স্পেশাল জায়গায় নিয়ে যাই, আজ আমার তরফ থেকে তোকে একটা জলপান উপহার দেওয়া যাক”। শুভ একটু কিন্তু কিন্তু করে বটে তবে ইতিমধ্যেই পেটে ছুঁচোরা চু কিত কিত খেলতে শুরু করেছ। সিনিয়র দাদা ডাকলে না বলতে নেই। মনে মনে নিজেকে বোঝায়। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেল এম জি রোডের মুখটায়। একটা পুরনো রেস্তরাঁয় ঢুকে বসল ওরা। নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চ আর টেবিল। লাল পর্দা ঢাকা বেলজিয়াম কাঁচ লাগানো জানলা দেখলে বোঝা যায় বহু পুরনো দোকান। কাঁধে গামছা ঝোলান বেয়ারা আসতে আশীষ আঙুল দেখিয়ে তাকে ইঙ্গিত করল,“ দুটো ডিমের ডেভিল আর দুটো চা” । কথায় কথায় শুভ-র সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানল আশীষ। বাবা কি করে, ওরা কোথায় থাকে, কোন স্কুলে পড়ত ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সেই মোক্ষম প্রশ্নটা করে বসল শুভকে। “ডাক্তারি পড়বি কেন?’ চোখের দিকে তাকিয়ে আশীষ যখন সরাসরি এই প্রশ্নটা করে বসল, শুভ-র গাটা কেমন শির শির করে উঠল। আশীষের চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। শুভ সম্মোহিতের মতো উত্তর দিল, “জানি না তো।“ আশীষ হো হো করে হেসে ওঠে। “জানিস না কি রে? পড়বি তুই আর জানবে কি পাশের বাড়ির বৌদি?” কু ইঙ্গিত করার সময় চোখ মটকায় ছেলেটা। শুভ কথা খুঁজে না পেয়ে একটু বোকার মতো হাসে। নাহ ছেলেটার চেহারা দেখে যত সাদামাটা মনে হয়েছিল তত সাদামাটা নয় মোটেও। শুভ মনে মনে ভাবে বলবে, “কেন পয়সা, পসার এসবের জন্য ডাক্তার হব।“ শালা কম পড়তে হয়েছে এই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য। দু’ চোখের পাতা এক না হওয়া সে রাতগুলো কি এমনি এমনি বৃথা হয়ে যাবে? কিন্তু কিছু না বলে ডিমের ডেভিলে কামড় লাগাল। আশীষ মাথা নাড়ে। “বেশ বেশ, তবে বল কার পয়সায় ডাক্তার হবি ?” শুভ এবার আর দেরি করে না। চট জলদি উত্তর বেরিয়ে আসে মুখ থেকে,”কেন বাবার পয়সায়!” শুভ তো বোঝে নি এই মোক্ষম প্রশ্নটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। তার জীবনের পথ বয়ে যাবে এক অনিশ্চিত অক্ষরেখার পথ ধরে। আশীষ অবাক হয়ে শুভ-র কথাই আবার বলে, “বাবার পয়সায়! কত মাইনে দিবি রে বাবার পয়সায়? ন’শো টাকা? জানিস তোকে পড়াতে মোট কত খরচ হবে?” আশীষ ঝোঁকের মাথায় বলে চলে, জানিস এক একটা ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে সরকার কত ভর্তুকি দেয়? সে সব টাকা আসে পাবলিকের পয়সা থেকে।“ আশীষ একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করে, “পাবলিকের পয়সায় ডাক্তার হবি আর পাবলিকের জন্য কাজ করবি না!” শুভ একটা কথার পিঠে এতগুলো কথা একদম আশা করে নি। বলতে কি চায় এই আশীষ বলে ছেলেটা। শুভ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ততক্ষনে ডেভিল পেটে চালান করে চায়ে চুমুক দিয়েছে। আশীষ ঘন স্বরে কেটে কেটে বলে, “কলেজে এসে একদিন আমাদের ইউনিয়ন রুমে আয়। অনেক কিছু জানতে পারবি। বুঝতে পারবি। ডাক্তার কেন হবি সেটা না জানলে ডাক্তারি পড়ার কোনও মানেই নেই।“
শুভ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরেছিল। চলন্ত বাসে বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা তাকিয়ে দেখেছিল, মিছিলের শহরে কাতারে কাতারে সাধারণ লোক চলেছে। এই সব সাধারণ লোক যারা “পাবলিক” তারা কেবল জনগণনার সংখ্যা হয়ে থেকে যায়। কানে বাজতে থাকে আশীষদার কথাটা, “পাবলিকের পয়সায় ডাক্তারি পড়বি আর পাবলিকের জন্য কাজ করবি না!”
সময়টা ভীষণ উত্তাল। ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে এক কালো অন্ধকার ছায়া নেমে এল ১৯৭৫ সালে। দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকারের ওপর চরম আঘাত হানা হল। নতুন মিসা আইনে গ্রেফতার করা চলল বিরোধী প্রতিবাদী সংগঠনের মানুষজনকে। ২১ মাসের এই দমবন্ধ অবস্থা কাটিয়ে নতুন নির্বাচন কেন্দ্রে এবং রাজ্যে। পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু ক্ষমতা এই শব্দটার মধ্যে যেন মিশে গেছে, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সব স্বৈরাচার। যে স্বৈরাচারের পৃষ্ঠ ভূমে জন্ম নেয় লুঠেরা ক্যাপিটালিস্ট শক্তি যারা লুঠ করে বনজঙ্গল, খনিজ সম্পদ, ধ্বস্ত করে আদিম জন জীবন। আদিবাসী ভূমিজ জনগণ যদি এই লুঠতরাজের প্রতিবাদ করে তাহলে তাদের ওপর চরম আঘাত নেমে আসে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বার বার যুগে যুগে দেশকাল ভেদে। শুধু মুখ পাল্টে পাল্টে যায়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের দাউ দাউ আগুন নিভে গেলেও ছাই চাপা হয়ে তা ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকল কিছু মানুষের মননে। তারা এক শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখে, দেখায় তাদের পরবর্তী উত্তরাধিকারীকে।
সে রাতে শুভ’র ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। ছট ফট করতে করতে কখন ঘুমিয়েছে জানতে পারে নি। ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখল জেঠুর নীল রঙের আম্বাসাডার গাড়িটা খুব ছোট হয়ে গেছে। এত ছোট যে শুভ চেষ্টা করেও তাতে ঢুকতে পারল না।
চলতে থাকুক। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম…..
ভালো লাগছে, পরবর্তী কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম