দিকচক্রবালে মাথা তুলে দাঁড়ানো রাজহরা পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য অস্ত গেল। গোধূলির রক্তিম আভা তখনও আকাশের গায়ে লেগে আছে। হাওয়ায় দুপুরের তাপ এখনও লঘু হয় নি কিছুমাত্র। গরমের দাবদাহে ক্লান্ত গাছপালা পশুপাখী। এমন একটা সময়ে লাল ধুলো উড়িয়ে এক পাল ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরছে বারো- তেরো বছরের এক ছেলে। ছাগলগুলোকে রীতিমতো দৌড় করিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে সে। যেন খুব তাড়ায় আছে। পথে জগদীশের সঙ্গে দেখা হলে ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল আজ মিটিং ক’টায় আছে। জগদীশ ওর আগ্রহ দেখে হেসে ফেলল। পুচকে ছোকরাটাও মিটিং কখন হবে জানতে চায়। নতুন কমরেড আসাতে ওদের আন্দোলন যে জোরদার হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নতুন সংগঠনের নাম হয়েছে “ছত্তিসগড় মাইনস শ্রমিক সংঘ”। সুদামার বাপ মা দু’জনেই এখানকার লোহা খাদানে কাজ করে। ওরা ঠিকাদারী মজদুর। ঠিকাদারের কাছে যারা কাজ করে তারা পাকা চাকরির শ্রমিকদের মতোই খাটে বটে কিন্তু তাদের মতো সুযোগ সুবিধা কিছুই পায় না। বোনাস বলো কি মাইনে পত্তর সবেতেই খালি ফাঁকি। তাই মাস দুয়েক হল ওরা এই অসম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মাঠে নেমেছে। একুশ দিনের হরতাল করেছে, লাল ময়দানে জমায়েত হয়ে। নারা লাগিয়েছে। তারপর ওরা নিয়ে এল লোকটাকে।
একদিন অন্ধকারে মশাল হাতে নিয়ে গ্রামের কয়েকজনকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে সুদামাও পিছু নিয়েছিল ওদের। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখেছিল লোকটাকে। আরেব্বাস! ইয়া লম্বা চেহারা। ঠিক যেন মজদুর লাগে না। কিন্তু পরণের জামাকাপড়ের হাল শোচনীয়। সুদামা শুনেছে লোকটা দানিটোলা খাদানে পাথর ভাঙার কাজ করত। তার মানে তো মজদুরই হল। নতুন কমরেডকে ঘিরে বসেছিল গোটা তিরিশেক লোক। তার বাপও ছিল সেখানে। সুদামা কান পেতে শুনেছিল আত্মারাম চাচা, বলে উঠল, “কমরেড হামারা মজদুর ঝোপড়ি মে রহ কর কাম করতে হ্যায়, লেকিন বারিশ মে জব ঝোপড়ি ভিগ যাতা হ্যায় তো বহুত দিক্কত হোতা হ্যায়, কেয়া ঝোপড়িকে মাররামত্তি কে লিয়ে কোম্পানি হামে সালানা শ’ রূপেয়া নহি দে সকতা হ্যায়?” বাকিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। তখন ওর বাপ বলে উঠেছিল, “ ঔর এক বাত ভী হ্যায় কোম্পানি কভি কভি কাম কে লিয়ে বুলাতে হ্যায় ফির কহতে হ্যায় কাম নহী হ্যায়। উস দিন হমে কুছ তো পগার মিললা চাহিয়ে না?” তারপর স্বগতোক্তির মতো বলেছিল, “নহী তো ক্যায়সান চালাইস ঘর পরিবার”! সুদামা ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়েছিল তাই বাপের বুক চেরা দীর্ঘশ্বাসটুকু যেন শুনতে পেয়েছিল ও। তারপর কানে এসেছিল জলদ গম্ভীর স্বর। যেন বারিশ হওয়ার আগে মেঘ গুরু গুরু করে ওঠল। বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল ওর। “আপকা ইয়ে মাঙ্গ জায়েজ হ্যায়। হম ইসকে লিয়ে লড়েঙ্গে জরুর। লেকিন………। এবার ওরা ধন্দে পড়ে। মোংলু তাকায় জগদীশের দিকে, জগদীশ তাকায় ধানীরামের দিকে, ধানীরাম তাকায় সোনু দাস এর দিকে। সোনু তাকায় সামারুর দিকে। কি বলতে চায় লোকটা।
শংকর বলে ওঠে, “এক বাত আপলোগো কো ভী সমঝ না চাহিয়ে। কেবল সংঘর্ষ সে কাম নহী চলেগা। আপ কো বদলনে কা কাম ভী করনা পড়েগা। আপনে আপ কো ভী ঔর ইয়ে সমাজ কো ভী।“ অনপড় লোকগুলো কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এ কী কথা বলছে রে বাবা লোকটা। ওরা আবার কি বদলাবে? ওরা জানে “হরতাল করব, কাম বন্ধ করব তা হলে মজদুরী বাড়বে।“ কী বা আছে ওদের জীবনে যে ওরা বদলাবে! গায়ে পড়ার কাপড় জোটে না ঠিক করে। পেটের খাবার জোটে না। দিনরাত খাটো আর মদ খেয়ে না পাওয়ার দুঃখ ভুলে থাকো। এর মধ্যে আবার বদল এল কোথা থেকে। শংকর ওদের বোঝায় প্রকৃতি আমাদের যা কিছু দিচ্ছে সব কিছু সবার জন্যে দিচ্ছে তাতে কোনও ভেদ নেই। যেমন এই ঝর্নার জল, রোদ, বৃষ্টি, চাঁদের আলো। “ফির ভেদ ভাও কোন বানায়া?” ওদের মাথায় এবার বুদ্ধি খেলে। সমস্বরে বলে ওঠে, “ইনশান নে বানায়া।“ শংকর বলে চলে, “ ইনশান নে জো সমাজ বনায়া উসমে হ্যায় ভেদ ভাও”। ওরা মাথা নাড়ে, ঠিক কথা। “আপ লোগ দিনরাত মেহনত করতে হো, লেকিন রোটি, কাপড়া মোকান নহী মিলতা হ্যায়।“ ওরা মাথা নেড়ে এ কথাতেও সায় দেয়। “ইনসান কী তরহ জিন্দেগী জিনা হ্যায় তো আপকো ইয়ে সব কে লিয়ে লড়না হোগা, লেকিন উসকে সাথ সাথ আপনে আপকো বদল না হোগা। নেহি তো ইয়ে লড়াই কোই কাম কা নহী ………সুদামা সেদিন চুপিচুপি পালিয়ে এসেছিল ওখান থেকে।
তার ঠিক দু’দিন পর। দল্লিরাজহরা উত্তাল হল শ্রমিকের স্লোগানে স্লোগানে। মর্যাদার লড়াইয়ে নেমে ওরা আত্মবিশ্বাসের সাথে ফিরিয়ে দিল বোনাসের টাকা। দালাল নেতাদের সই করা চুক্তি মানবে না তাই ৭০ টাকা বোনাসের বদলে ৫০ টাকা বোনাস নিল। জিততে ওদের হবেই। “ হর জোর জুলুম কে টক্কর মে হাম মজদুরো কা নারা হ্যায়………” আকাশ বাতাস মুখর হয়ে ওঠল শ্রমিকের প্রতিবাদে। ওরা যে সংখ্যা, ওরাই সংখ্যা ওরাই তো স্টীল প্ল্যান্টের চাকা সচল রেখেছে। তাই নতি স্বীকার করতে হল ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের ম্যানেজমেন্টকে। সরকারি অফিসারের সামনে সি এম এস এস এর সঙ্গে চুক্তি করে ওদের দাবী দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হল মালিক পক্ষ। কিন্তু সরল মতি আদিবাসী মানুষগুলো তো জানত না শিক্ষিত বলে যারা বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায় তারা ওদের মতো নয়। তারা কথার দাম বোঝে না তারা কেবল মুনাফা বোঝে। গরীব শ্রমিক আত্মসম্মান বজায় রাখতে কুড়ি টাকা কম নিতে পারে কিন্তু পুঁজির মালিকদের চুক্তি মেনে টাকা দিতে বুক কাঁপে। তাই যখন শ্রমিকরা ঠিকাদারের কাছে ঘর মেরামতির টাকা আনতে গেল ঠিকাদার বেমালুম মানা করে দিল। বেইমানি!
ওরা ফিরে এল। ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এল দল্লি রাজহরার বুকে। কালো অন্ধকার তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে গ্রামগুলোর ছোট্ট ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে টেমির আলো যেন জোনাকির মতো ইতি উতি জ্বলছে। সে আলো শুধু তার অস্তিত্বই জানান দিতে পারে ঘোচাতে পারে না এই জমাট বাঁধা অন্ধকার। অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অভাবের অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকে মানুষের অধিকার। যে অধিকারের লড়াই লড়বে বলে আজ এখানকার খনি শ্রমিকরা সংগঠিত হয়েছে। তারা চেয়ে আছে ওই লোকটার দিকে। যে লোকটা কোন আসামের ন’ গাও থেকে সময়ের স্রোত বেয়ে ওদের অন্ধকার জীবনের পথে আলোক বর্তিকা হয়ে এসে পড়েছে, যার দু’চোখে মাখানো সমাজ বদলের স্বপ্ন। কিছু কিছু মানুষ এমন জন্মায় যারা আলো জ্বেলে দেয় অন্যের জীবনে, যাদের সংস্পর্শে এসে বদলে যায় আরও অনেকের জীবনের গতিপথ।
সন্ধ্যের আলোচনা শেষ করে যে যার ঘরে ফিরে যায়। সুদামাও ঘরে ফিরে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। হঠাৎ জীপের আওয়াজে সচকিত হয়ে ওঠে ওদের গ্রাম। রাত তখন বেশ ঘন। পুলিশ! জীপের আওয়াজ এসে থামল ইউনিয়নের ঝোপড়ির সামনে। দুটো ভ্যানে করে পুলিশ এসেছে লোকটাকে তুলে নিয়ে যেতে। মনে মনে একটু হাসে সে। নির্বিকার গিয়ে গাড়িতে ওঠে। জেলে যাওয়া তো আর এই প্রথম নয়। জেলের ছোট্ট কুঠুরী কি পারবে তার আকাশ ছোঁয়া সংকল্পকে ভরে রাখতে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু হাসি দেখে গা জ্বালা করে ওঠে ডিউটিতে থাকা অফিসারের। ভয় পাওয়াতে পারে না বলে রাগে সারা শরীর রি রি করে ওঠে। এদিকে জীপের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে মজদুরদের। ওরা ছুটে আসে। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে জঙ্গলের পথে অপসৃয়মান জীপের দিকে। ওরা যে ধরে নিয়ে যাচ্ছে লোকটাকে। মাঝ রাতে আবার উত্তাল দল্লি রাজহরার মাটি, মানুষ, গাছপালা, পশু পাখি, স্লোগানে স্লোগানে আটক করেছে ওরা আরেকটা পুলিশের গাড়িকে। সুদামার ঘুম ভেঙে যায় চিৎকারে। ঘুম চোখে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঘিরে থাকা শ্রমিক তখন তাদের নেতার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার। বন্দুকের আওয়াজে সচকিত হয়ে ওঠে খনি খাদানের দেশ। একটা রাতচরা পাখি তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে আকাশে উড়ে যায়। গাছেরা উদ্বাহু হয়ে ইনসাফ চায় আকাশের কাছে, গ্রহ তারকাদের কাছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এক নারী আর এক বালকসহ সাত জন। খাদান শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রথম শহীদ। লাল মাটিতে মিশে যায় তাদের লোহিত ধারা। অনুসুইয়া বাঈ লাল সেলাম, সুদামা লাল সেলাম, জগদীশ ভাই লাল সেলাম……… শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না। পুলিশের গুলি খতম করতে পারে না ওদের। ওরা যে সংখ্যা, ওরাই সংখ্যা। পুলিশকে ঘিরে রাখে ওরা। দাবী একটাই কমরেড শংকর গুহ নিয়োগীকে মুক্তি দিতে হবে। পুবের আকাশে লালের ছোঁয়া লাগে। এক নতুন ভোরের স্বপ্নে বিভোর ওরা। আর একটা দিন নতুন সংগ্রাম নিয়ে হাজির হবে ওদের জীবনে। তার নাম আগামী কাল।