গত রাতে পুলিশের গুলিতে সাত জন ঢলে পড়েছে মৃত্যুর বুকে তবু ওরা দমে নি একরত্তি। আটক করে রেখেছে পুলিশ বাহিনীকে। দাবী একটাই ওদের নেতাকে মুক্তি দিতে হবে। চারদিকে লাল সবুজ পতাকার ঢেউ তখনও উদীয়মান সূর্যের ছটায় জ্বল জ্বল করছে। “নয়া আঞ্জোর” অর্থাৎ কিনা ভোরের সূর্যকিরণ এসে পড়ল সার বেঁধে শোওয়ানো মৃতদেহের ওপর। বালক সুদামার নিথর দেহখানার দিকে তাকিয়ে ছত্তিশগড় মাইনস শ্রমিক সংঘের সদস্যদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। রাত জাগা চোখগুলো রুদ্ধ কান্নায় লাল হয়ে উঠেছে। কি পেয়েছে ওরা জীবনে? সারা দিন হাড় ভাঙা খাটুনীর পর ফিরে এসে রান্নার আয়োজন। সেও শুধু ভাত। প্রতিদিন তরকারি জোটে না কপালে। কোন উৎসব হলে তবেই ভাত তরকারির বিলাসিতা। রাতের রান্না করা বাসি ভাত খেয়ে পরের দিন কাজে যাওয়া। তেরো ঘণ্টার হাড় ভাঙা খাটুনি।ঘরের বাচ্চাগুলো বাপ কে চেনে না ঠিক মতো। কারণ বাপ যখন কাজে যায় বাচ্চা ঘুমায় আর রাতে যখন কাজ থেকে ফেরে তখন তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাজেই দিনের পর দিন তারা দেখে না জন্মদাতাকে। এই দুঃসহ জীবনের বোঝা বইতে বইতে ওরা ক্লান্ত। তবুও শোষণ শেষ হয় না। অত্যাচারিত হতে হতে ওদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আজ মরিয়া ওরা। এতদিনে ওদের জীবনে একজন এসেছে যে ওদের কথা শোনে, বোঝে। ওদের বিপথগামী সংগ্রামের রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। যে ওদের মানুষের মতো বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। মৃতদের পরিবারের স্বজন হারানোর কান্নার বিলাপ ভোরের আকাশকে ভারি করে তোলে। বেলা ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। সূর্য যখন মাথার ওপর চড়েছে আচমকাই আবার বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে ওদের ঘিরে ফেলে। পুলিশের গুলিতে আরও চার জন শ্রমিক লুটিয়ে পড়ে দল্লিরাজহরার মাটিতে। অবশেষে আটক পুলিশদের উদ্ধার করে নিয়ে যায় ওরা। কিন্তু এত সহজে হার মানবে না, মাথা নোয়াবে না ওরা। যে এগারো জনের প্রাণ গেছে তাদের রক্তের দাগ এখনও লেগে আছে এখানের মাটিতে। লাগাতার ধর্মঘট চলতে থাকে। শ্রমিকের দাবীতে উত্তাল তখন দল্লী-রাজহরার আকাশ বাতাস। “কামানে ওয়ালা খায়েগা ঔর লুটনে ওয়ালা যায়েগা”……
হর জুল্ম হর অত্যাচার
জুঝেঙ্গে হম বার বার,
(—ফাগুরাম যাদব)
আজ উনিশ নম্বর দিন। ওরা আজও নিজেদের অবস্থান থেকে এক চুল নড়ে নি। অগত্যা কোম্পানির তরফ থেকে ডাক পড়ল। গতকাল রাতে শংকর ছাড়া পেয়েছে। পুলিশ চেয়েছিল এন কাউন্টারে খতম করে দিতে কিন্তু শংকরের অসীম সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জোরে এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে সে। আজ সকাল হতেই শংকর আত্মারাম আর দু’ একজনকে নিয়ে ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের কর্তৃপক্ষের সাথে মিটিং এ বসল। শ্রমিকদের দাবীদাওয়া যা ছিল তার অনেকগুলোই মেনে নিতে বাধ্য হল তারা। ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের জীবনে এই জয় তাদের আত্মমর্যাদার লড়াই, মানুষের অধিকারে বাঁচার সংগ্রামকে যেন নতুন দিশা দেখাল। আসলে শাসক ভেবেছিল মজদুরদের প্রতিবাদী আন্দোলন গুলির আঘাতে চূর্ণ করে দেবে। ওরা ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু হায় রে দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে মৃত্যু ভয় ওরা কবেই জয় করে ফেলেছে। তাই গুলির আঘাতে যখন ওদের ভাই, বোন সন্তান লুটিয়ে পড়েছে তখন সেই শহীদের রক্ত দল্লী-রাজহরার মাটিতে বিপ্লবের বীজ পুঁতে দিল নতুন করে। ওরা প্রশ্ন করতে শুরু করল। ওদের দেশ ছত্তিশগড়, যার মাটিতে ফলে সোনার ফসল, যার মাটির নীচে লুকিয়ে আছে অগাধ খনিজ সম্পদ। কি নেই সেখানে? লোহা আছে,চুনা পাথর আছে, কয়লা আছে, ইউরেনিয়াম, ডলোমাইট আছে, সোপ স্টোন, কোয়ার্জ কি নেই সেই ভান্ডারে। প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে তার ভূমিপুত্রদের জন্য। গোটা অঞ্চল জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি, শাল, মহুয়া, শিরীষ সেগুন, বাঁশ কি নেই সেই বনলক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। তবু, ওরা ভূমিজ সন্তান হয়ে আজ হত দরিদ্র কাঙাল হয়ে থাকবে? শেঠ,, বেনিয়া, ঠেকাদার, সরকারি অফিসারদের অত্যাচার আর কতদিন সইবে? ওরা প্রশ্ন করতে শুরু করল। গত ২ রা জুন আসন্ন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। আর না এবার ওদের স্বাধীনতার লড়াই লড়তে হবে। মুক্তি চাই। শোষণ থেকে মুক্তি, দমন থেকে মুক্তি, অত্যাচার থেকে মুক্তি। শহীদের বুক থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের টীকা মাথায় এঁকে ওরা শপথ নেয় ওরা এক নতুন ছত্তিশগড়ের জন্ম দেবে, যে ছত্তিশগড় হবে শোষণ মুক্ত ছত্তিশগড়, যেখানে কৃষক-শ্রমিক জোট বেঁধে তৈরি করবে এক সমাজবাদী সমাজ। তাই ওরা চেয়ে থাকে ওদের নেতার মুখের দিকে।
শংকর উপলব্ধি করে শুধু চলতি ধারার ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতি করে এই মানুষগুলোর জীবন বদলানো সম্ভব নয়। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে সে। ১৯৫৮ সালে ভিলাই ইস্পাত কারখানা গড়ে ওঠে। একটা স্বপ্ন তখন চারিত হয়েছিল ছত্তিশগড়ের মানুষের মধ্যে। বিকাশ আর উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে সেখানে, কিন্তু এখানের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন যাপনের মান আজও নিম্নগামী। অথচ ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টকে কেন্দ্র করে অনেক সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা একই থেকে গেছে। ছত্তিশগড়ের লোকের কাছে বি এস পি এখন শ্ত্রু পুরী। ইউনিয়ন নেতাদের গদ্দারী, শিল্পপতিদের অত্যাচার আর নিপীড়নে ত্রস্ত সেখানকার আদিবাসী জীবন। তাদের জীবনের সার্বিক কোনও উন্নতিই ঘটে নি এত বছরে। ভিলাইয়ের দক্ষিণে বস্তার অবুঝমার অঞ্চলে মারিয়া আর মুরিয়া উপজাতির বাস। রক্ত আমাশায় তাদের হাজার হাজার মানুষ আজও মারা যায়। উত্তরে মান্দলে বাইগাদের বাস। আদিম জীবনে অভ্যস্ত বাইগারা পুরাতত্ত্ব দপ্তরের স্যাম্পেল হয়ে রয়ে গেছে। পুব দিকে রায়পুর জেলায় পিথোরা-বাসনা-সরাইপল্লী সে সব জায়গায় আজও শ্রমদাস হয়ে জীবনভর খেটে চলেছে মানুষ। পশ্চিমে রাজনন্দ গাঁও, যেখানে মানুষ খরা আর দুর্ভিক্ষের কারণে বিপর্যস্ত। দল্লী-রাজহরার দূরত্ব ভিলাই থেকে একশো কুড়ি কিলোমিটার মতো। তবে কারা এই বিশ বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে? এখানকার পাঁচজন শিল্পপতির প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় হাজার কোটির ওপরে। শাহ, জৈন কেডিয়াদের পেট মোটা হচ্ছে আর হত দরিদ্র ভূমিপুত্ররা গরীব থেকে আরও গরীব হচ্ছে। অথচ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে এই সব শিল্পগোষ্ঠীর কারখানাগুলোতে দু’ হাজার শ্রমিক কাজ করলে তার মধ্যে হয়তো একশো জন স্থায়ী কর্মী। বাকিরা ঠিকা কর্মী। তাদের ঠিকাদাররা সবাই এসব অঞ্চলের স্থানীয় গুন্ডা। এই শ্রমিকদের তাই নিজের অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলার কোনও অধিকার নেই। তাকে অনেক কাজ করতে হবে এখানে। এগার জন শহীদের এই আত্মবলিদানের ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে কৃষক শ্রমিক একজোট হয়ে লড়তে হবে। চিন্তামগ্ন ক্লান্ত শংকর খাটিয়ায় শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। রাতের তারা ঝলমলে আকাশে তখন একাদশীর এক ফালি চাঁদ ঝুলে আছে। নিস্তব্ধ বনচর ভেদ করে এক ঘাই হরিণীর চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতা চিরে খান খান করে দেয়। শিরিষের কোটরে বাসা বেঁধে থাকা পেঁচাটা নিঃশব্দে এসে বসে গাছের ডালে। শিকারের খোঁজে জ্বল জ্বল করে ওঠে তার দু’ চোখ।