(৮)
তখন শীতের দিন। জঙ্গল জুড়ে শুকনো পাতার মর্মর শব্দ যেন হাহাকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে উপত্যকা জুড়ে। বাতাসে হিমের পরশ। এ সময়ে লাল মাটির এই দেশ যেন রুখু শুখু হয়ে যায় ঠান্ডার দাপটে। শংকর সে দিন আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল জঙ্গলের মধ্যে। শুকনো পাতার খস খস শব্দ কেমন এক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। মনের মধ্যে অনেক পরিকল্পনা পাক খাচ্ছে। এত মানুষের বিশ্বাসের দাম দিতে পারবে তো সে! আন্দোলন করে এখন শ্রমিকদের বেতন যথেষ্ট ভাল হয়েছে কিন্তু সেই তুলনায় কি তাদের জীবনের মান বেড়েছে? এখানের আদিবাসীরা আগে ঘরে তৈরি মহুয়ার রস খেয়ে মাতাল হত। সরকার মহুয়া থেকে মদ বানানোর ওপর রোক টোক লাগালো। ওরা নিজেদের জন্য মদ বানাতে পারবে। কিন্তু মদ বিক্রি করা যাবে না। এখন এই সব এলাকায় লাইসেন্সড মদের দোকান খুলেছে। আর শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা পয়সা যাচ্ছে মদের দোকান ঘুরে শেঠেদের পকেটে। এই সব ভাবতে ভাবতে শংকর যখন লাল পাহাড়ের পাঁক দন্ডী বেয়ে নীচে নেমে আসছে হঠাৎ করেই চোখ গেল নীচের সারিবদ্ধ ঘরগুলোর সামনের জটলার দিকে। ব্যাপার কি? ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের উপাধ্যক্ষা কুসুমের বাচ্চা হবে। কিছু অসুবিধে ছিল। আজ ধানীরাম আর কয়েকজন মিলে কুসুম বাঈকে বি এস পি হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। তবে কি খারাপ কিছু ঘটল? শংকর দ্রুত নামতে থাকে ওপর থেকে। কাছে আসতেই কানে আসে মেয়েলি কান্নার আওয়াজ আর জনতার গুঞ্জন। শংকরকে দেখা মাত্র ধানীরাম হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। “বি এস পি কে হাসপাতাল হম মজদুর মন মিলকে বানাই হোবো কা না, ফির আজ হাম মজদুর ভর জাগা নাহি হ্যায় ইলাজ করনে কা।” ধানীরাম কান্না জড়ানো গলায় যা যা বলতে থাকে তার সার মর্ম হল পেটে যন্ত্রণা উঠলে পোয়াতি কুসুমকে নিয়ে ওরা ছুটেছিল বি এস পি-র হাসপাতালে কিন্তু সেখানে ডাক্তার আদিবাসীদের শরীর ছুঁতে ঘেন্না পায়। তাই কুসুমকে যথা সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মরতে হয়েছে। এ ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও এমন খবর পেয়েছে শংকর। চিতার আগুন গন গন করে জ্বলে ওঠে। সে আগুনে ঝলসে যায় ওদের আত্মসম্মান। ওদের মেহনতে তৈরি হাসপাতালে ওদেরই কোনও অধিকার নেই। ‘কমরেড তুমি বলে দাও আমরা কি করব………” লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জোড়া জোড়া চোখ। অসহায়তা আর অপমানে ভিজে গেছে সে চোখের পাতা। একে একে ওরা দানা বাঁধতে থাকে। দশ হাজার মেহনতী মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায় বি এস পি হাসপাতালের সামনে। না, তারা হাসপাতাল ভাঙচুর করে নি। ডাক্তার বা নার্সদের গায়ে হাত তোলে নি। শুধু আত্মমর্যাদার যে লড়াইয়ে তারা নেমেছে সেই লড়াইয়ের দায়িত্ব স্বীকার করে সেদিন তারা শপথ নিল মা বোনেদের জন্য তারা একটা প্রসূতি ভবন গড়ে তুলবে।
আর যেন কোনও কুসুম বাঈকে প্রাণ হারাতে না হয়। “হস্পাতাল বানেগা, জরুর বানেগা।“ বলে কি এরা? এই অশিক্ষিত, আদিবাসী মজদুরের দল হাসপাতাল বানাবে, স্কুল খুলে বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবে! ওরা কি তবে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার সংগ্রামে সামিল হতে চলেছে। এও কি সম্ভব? এতকাল যারা শুধু দারিদ্র, অশিক্ষা আর অস্বাস্থ্যের চোরা বালিতে ডুবে মরছিল তারা গড়বে নয়া ছত্তিশগড়!
ইতিমধ্যে দল্লী রাজহরাতে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার মহিলা বাহিনী তৈরি হয়েছে। খোলা হয়েছে সতেরোটি বিভাগ—– শিক্ষা, সঞ্চয়, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, নেশাবন্দী, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক বস্তি উন্নয়ন বিভাগ, মেস বিভাগ, নির্মাণ বিভাগ, আইন বিভাগ, লাইব্রেরি বিভাগ, ইত্যাদি ইত্যাদি। আন্দোলন আর সংঘর্ষ তাদের দৈনিক রোজগার বাড়িয়েছে কিন্তু জীবন যাত্রার মান বাড়াতে পারে নি। তাই শুরু হল এক নতুন পথ চলা। দল্লী রাজহরার শ্রমিকরা এক দৃষ্টান্তমূলক নির্মাণের ইতিহাস গড়ে তুলল ছত্তিশগড়ে। এ লড়াই মানুষের মতো মানুষ হওয়ার লড়াই। কোথাও গিয়ে এক হয়ে যায় এই লড়াইগুলো………বরিস পলেভয়, শুভব্রত, শংকর ওরফে ধীরেশ, আত্মারাম, কলকাতা, সাইবেরিয়া, দল্লী রাজহরা সব যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
ওরা বুঝল ওরাও ধাক্কা দিতে পারে। দল্লী-রাজহরার শ্রমিক বস্তিগুলোতে সাফাইয়ের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। শ্রমিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আবর্জনা সাফ করা জরুরী কিন্তু ম্যানেজমেন্টের এ ব্যাপারে কোনও হুঁশ নেই। অগত্যা হাত লাগালো ওরা। মেয়ে মরদ, যুবক, বাচ্চা সবাই জুটে সব ময়লা এক জায়গায় জড়ো করল। তারপর খনিতে মাল বওয়ার তেরোটা ট্রাকে করে সে সব জঞ্জাল নিয়ে গিয়ে ফেলে এল মাইনস ম্যানেজারের কোয়ার্টারের সামনে। “ইঁট কা জবাব পাত্থর সে”। লাল সবুজের জোর বাড়ছে। কাজেই ধমকি দেওয়া হল মজদুর বস্তি সাফাইয়ের ব্যবস্থা করা না হলে কুছ পরোয়া নেহি। ওরাই সাফ করে আবর্জনা ম্যানেজমেন্টকে উপহার দিয়ে যাবে। আস্পর্দা দেখো ছোটলোকগুলোর।
এভাবেই ঝড় উঠল দল্লী-রাজহরার বুকে, লাল সবুজ পতাকার ঝড়। সেই ঝড় আছড়ে পড়ল আশেপাশের জেলাগুলোতেও। বাইলাডিলা পাহাড়ের বুকে তখন মেঘেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে। ‘বাইলাডিলা’ অর্থাৎ কিনা ষাঁড়ের পিঠের উঁচু হয়ে থাকা কুঁজ। সেই পাহাড়ের কোলে লোহা খনি থেকে চলে খনন। সাপ্লাই হয় ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টে। মজদুর ভাইদের পেটে লাথ মারতে উঠে পড়ে লাগল ম্যানেজমেন্ট। খনির কাজে পূর্ণ মেশিনীকরণ আনতে চায় তারা যাতে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বাড়াতে হবে ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে এই বন জঙ্গলের খনিজ সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে মানুষগুলো, যারা এখানকার ভূমিজ সন্তান তাদের অস্তিস্ব বিপন্ন করে এই ব্যবসার বুনিয়াদ পোক্ত হয় কি করে? মেশিন আবিষ্কার হয়েছে মানুষের জীবন সুশ্রী, সুন্দর, সহজ করে তোলার জন্য। সেই মেশিন যদি গরীব দেশের সাধারণ মানুষকে প্রতিস্থাপিত করে তাদের জীবন বিপন্ন করে তোলে তবে তো তা মানব জীবনে ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজির জয় সর্বত্র। শিল্পপতির উদার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। অগত্যা গুলি ছুটল। প্রতিবাদ রুখতে মুজদুর জমায়েতে জনতা সরকারের পুলিশ লাগামছাড়া আক্রমণ চালাল। সদ্য কংগ্রেসী অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে দম নিচ্ছে ভারতের জনতা, ভরসা করে জনতা সরকারকে বসিয়েছে মসনদে। কিন্তু শাসকের স্বরূপ দল মত নির্বিশেষে এক। তারা সাধারণ মানুষকে মই বানিয়ে ভোটে জিতে ক্ষমতার শীর্ষে চড়ে বসে তারপর দমন নীতি চালায় যথেচ্ছ। দল্লী-রাজহরা ছুটল বাইলাডিলার বিপদে পাশে দাঁড়াতে। এই ছুটে আসাতেই একমাত্র জোর ওদের। ওরা এক জোট হলে ক্ষমতার ভিত নড়ে ওঠে। বাইলাডিলা পাহাড়ও যেন একটু নড়ে বসে। ওর বুকে যে মেঘেরা খেলা করে বেড়াচ্ছিল তারা সব জমাট বেঁধে বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে উপত্যকা জুড়ে। বৃষ্টি মানে শস্য, বৃষ্টি মানে জীবন। জোট বাঁধা জল বিন্দুরা নেচে বেড়ায় জয়ের আনন্দে, আর ওরাও। কিন্তু ওদের কমরেড বোঝালো এই বিপদ কিন্তু ওদের জীবনেও আসন্ন। মেশিনের সাথে মানুষের লড়াই অবধারিত। তাই প্রস্তুত হও ভাই সকল। সে সময়ে ছত্তিশগড় ছিল মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সাতটা জেলা নিয়ে। তার মধ্যে পাঁচটা জেলায় —–দুর্গ, বস্তার, রাজনাদ গাঁও, রায়পুর, বিলাসপুরে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সংগঠন ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কুছ তো হ্যায় ইয়ে ইনশান মে, কুছ আলগ সা, কুছ বহুত হি খাস। ওরা কানাকানি করে নিজেদের মধ্যে। করবেই নাই বা কেন? এর আগে কেউ কখনও ওদের জীবন নিয়ে এমন করে তো ভাবে নি, ভাবায় নি। আগে ইউনিয়ন মানে ওরা বুঝত বোনাস দাবী করা, ওভারটাইম আদায় করা, কখনও কারখানায় কোনও আক্সিডেন্ট হলে ক্ষতিপূরণ দাবী করা। কিন্তু ওদের নিজেদের জীবন যে ওরা নিজেরাই গুছিয়ে তুলতে পারে সেই কথাটা এই লোকটা আসার আগে কেউ তো বলে নি। শংকর গুহ নিয়োগী ওদের জীবনে যেন বৈশাখের কালো ঝড় হয়ে এল। গলে পচে যাওয়া সিস্টেমকে ভেঙ্গেচুরে দিল, আর সেই ধ্বংসের বুকে গড়ে উঠল নির্মাণ। “সংঘর্ষ ঔর নির্মাণ”—- মজদুরোঁ কে জীবন মে দো পাইয়া।
এরপরের অধ্যায় এক অভূতপূর্ব বদলের ইতিহাস। কলকাতা শহরের বুকে এক ঝাঁক তরুণ ডাক্তার যখন বদলের অভিপ্রায় নিয়ে আওয়াজ তুলেছে সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তখন ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত খনি এলাকায় এক দল মেহনতী মানুষ নিজেদের হাসপাতাল বানানোর স্বপ্ন দু চোখে মেখে দিনের পর দিন রাত জেগে গেঁথে চলেছে একেকটা ইট। সে ইটের গায়ে লেপটে যায় তাদের ঘাম, তাদের আশা ভরসা, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।