(৯)
এখনও শুভদের গা থেকে নতুনের গন্ধ পুরোপুরি যায় নি। এই বছরের জানুয়ারি মাসে ওদের ক্লাস শুরু হয়েছে এখনও সব কিছু দেখে বুঝে শিখে চলার পর্যায় চলছে। সিলেবাস সম্বন্ধে সিনিয়রদের থেকেই একটা ধারণা পাওয়া গেছে। প্রথম দেড় বছর অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হবে। পাশ করে উঠতে পারলে স্টেথোস্কোপ হাতে পাবে। সেটা ওদের মতো নতুন পড়ুয়াদের কাছে একটা বিশেষ আকর্ষণ। গলায় স্টেথো থাকলে হাফ ডাক্তার হয়েই গেল ধরা যায়। আনাটোমিতে প্রতি বছরই বেশ কিছু পড়ুয়া ফেল করে। এত কিছু জানার পরেও সিনিয়র দাদা দিদিদের অভয় বাক্য শুভ-র মর্মে প্রবেশ করেছে। “কিচ্ছু চিন্তা নেই, আমরা আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরীক্ষার আগে পনেরদিন আমাদের সাথে বসে যাবি। পড়িয়ে দেব।“ শুভ এটাই আপ্তবাক্য বলে মাথায় তুলে নিয়েছে। পড়ার নাম শুনলে এমনিতেই জ্বর আসে ওর। এম সি ডি এস এ-র সদস্য সিনিয়ররা বলেই দিয়েছে এই সিলেবাসের কিস্যু ডাক্তারি করতে গেলে কাজে আসে না তার চেয়ে যেটা কাজে আসবে সেই পড়াটা মন দিয়ে করা দরকার। জীবনমুখী শিক্ষার ভিত গড়ে পিটে না নিলে ডাক্তার হওয়ার কোনও মানে নেই। যে সমাজ তাদের কর্মভূমি সেই সমাজকে বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব তাদেরকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। কিন্তু রাজনীতি? সে তো ভয়ংকর ব্যাপার। বাড়িতে যদি জানতে পারে তা হলে হয়তো পড়াই ছাড়িয়ে দেবে। রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে এই ভয় ঢুকে যাওয়ার একটা সঙ্গত কারণ হয়তো আছে। বিশেষ করে এই দশকের শুরুতে নকশাল আন্দোলনের বাড়বাড়ন্ত, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ও অকালে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, ইমার্জেন্সীর রক্তচক্ষু ও কংগ্রেসী গুন্ডাদের দাপট সব মিলিয়ে ছেলে বা মেয়ে রাজনীতি করছে শুনলে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে এখন মড়া কান্নার রোল উঠে। তাই ছাত্র রাজনীতির কথা বাড়িতে বলা বেশ চাপের। যদিও এম সি ডি এস এ কোনও তথাকথিত মেন স্ট্রীম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধে নি। তবে একাত্তরের প্রভাব প্রচ্ছন্ন ভাবে আছে। যে যা বলে বলুক শুভ-র কিন্তু ব্যাপারটা বেশ লেগেছে। এই যে বিষম সমাজ ব্যবস্থা তাকে চুরমার করে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। সারাদিন কলেজ করে বাড়ি ফিরে শুভ সন্ধ্যে হলেই আবার ব্যাগে চারটি বই পুরে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে মেন হস্টেলে দাদাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। বাড়িতে বলে পড়া দেখতে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে সেখানে চলে এক অন্য পাঠশালা। বিনোদ শুরু থেকেই কলেজে সর্বক্ষণ শুভ-র সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। দুজনের খুব যে কথা হয় তা নয়। তবু বিনোদ শুভকে খুব ভরসা করে। বোধ হয় শুভও। ওর খরচ খরচা চালানোর জন্য কয়েকটা টিউশন জোগাড় করে দিয়েছে শুভ। কলেজের পরে সেই গুলো করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সন্ধ্যেগুলোতে শুভ মনে মনে বিনোদকে কিছুটা মিস করে। ওর কেবলই মনে হয় যারা বিনোদের মতো তাদের ভেতর একটা আগুন আছে। না হলে সম্পূর্ণ একক চেষ্টায় এই জায়গায় উঠে আসা সম্ভব হত না। বিনোদদের আরও বেশি করে এই শোষণ্মুক্ত সমাজের জন্য লড়াইয়ে সামিল হওয়া দরকার। কিন্তু বিনোদের হাত পা বাঁধা। ওকে এই টিউশনিগুলো করতেই হবে। বিনোদের মতো ছেলে তাদের ক্লাসে আরও আছে। জেলাগুলো থেকে অনেকে পড়তে আসে এখানে। প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেও আছে কিছু। কত বৈচিত্র্য! তারা সবাই একদিন ডাক্তার হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় তারা কি ফিরে যাবে তাদের সেই শিকড়ের কাছে? তা হলে আজও গ্রামে গঞ্জে ডাক্তারের এত অভাব কেন? আশীষদারা ঠিকই বলে। চে-র মতো মানুষ আসলে তাদের আদর্শ হওয়া উচিত।
সেদিন কলেজে পৌঁছে ক্লাসের দিকে না গিয়ে সিধে ক্যান্টিনে ঢুকল শুভ। কোণের একটা টেবিলে কয়েকজন বসে আছে। সুভাষদা আর জয়ন্তদা কে চিনতে পারল। ওরা ফাইনাল এম বি বি এসে পড়ে। তাছাড়া বিভাস, আশীষ আর সুমিতা থার্ড ইয়ার। ওদের ক্লাসের অভিজিৎও আছে। আরও কয়েকজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার মধ্যে বেশ কয়েকজন এস এফ আই এর ছেলেও আছে। শুভ এগিয়ে গিয়ে অভিজিৎ এর পাশে বসে পরে। “কি রে দাদুর ক্লাস করবি না?” শুভ জানতে চায় অভিজিতের কাছে। অভিজিৎ মাথা নেড়ে জানায় করবে না। শুভকে দলে টানার জন্য বলে, “বোস বোস ও আর শিখে কি হবে?” এমনিও ফেল ওমনিও ফেল। দাদু মানে ডঃ অমর মিত্র। আড়ালে ছাত্ররা ওই বলেই ডাকে ওনাকে। ধবধবে সাদা পোশাকের জন্য বোধ হয়। ওদের অ্যানাটমি পড়ান। ভদ্রলোক মজাদার। প্রথম দিন অ্যানাটমি ক্লাসে অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে হঠাৎ আওড়াতে শুরু করলেন, “ এ ভাই জরা দেখ কে চলো, আগে হী নেহি পিছে ভী, উপর হী নেহি নীচে ভী……। উনি যখন এই বলে সবে শুরু করেছেন হঠাৎ করে ধড়াম একটা শব্দ। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি অজ্ঞান হয়ে চিত পটাং। স্যার হতচকিত হয়ে গেলেন। অজ্ঞান হওয়ার কারণ কি টেবিলে শোয়ানো মড়া নাকি স্যারের গান! হাসি চাপতে পারে নি ওরা। যা হোক শুভ-রও ওই আপ্রন ট্যাপ্রন, জুতো টুতো পরে ক্লাসে যাওয়ার মুড নেই। টেবিল নং ওয়ান, টেবিল নং টু ……… মৃতরা অপেক্ষায় থাক। শুভ জানতে চায় না দেহ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পেশিগুলোর ইতিহাস ভূগোল। মুক্ত পেক্টোরালিস কিংবা কেফালিক ভেইন। কি হবে হিজিবিজি চারটে ফালতু জিনিস শিখে। তার থেকে এই ক্যান্টিন সব সময়েই চা আর রাজনীতির তরজায় গরম মুচমুচে হয়ে থাকে। মাঘের শীতের রেশ বাঘের গায়ে আর শুভ-র গায়েও লেগে আছে। শুভ গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়। যদিও এখন কলেজ ইউনিয়ন এম সি ডি এস এ-এর দখলে। শুরুর দিকটায় এস এফ আই ওদের সঙ্গে কিছুদিন ছিল । কিন্তু এখন আলাদা হয়েছে। তবে বিশেষ বিরোধ যে আছে তা নয়। গত সাত আট বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অরাজকতা চলেছে তাতে করে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ না বাড়িয়ে বরং ব্যবস্থাটা মসৃনভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। রাজ্য রাজনীতি এখন তাই দাবী করে। কংগ্রেসী আমলের গুন্ডামী সহ্য করতে করতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সি পি আই এম কে সুযোগ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। নীতিগত দিক থেকে তারা সর্বহারার পাশে দাঁড়াবে এই ভরসা মনে। সবার অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের নীতি নির্ধারিত হবে। কিন্তু কাজে কি তা হচ্ছে? শাসকের আসনে বসে কোথায় যেন দাঁত নখ বেরিয়ে যাচ্ছে সরকারের। এ নিয়ে গত ক’দিন ধরে কলেজে একটা উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। ক্যান্টিনে বসে কথা হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। স্বাধীনতার পর কেটে গেছে তিরিশ বছর তবু বাঙলার অবস্থার কোনও উন্নতি নেই।
ভোটে জেতার আগে বাম দলগুলোর উদ্বাস্তুদের প্রতি যে সহানুভূতি ছিল এখন ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ করে সুর বদলে গেছে। এ বছরের শুরুতেই ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়ের লিখে ফেলেছে ওরা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কলকাতা ও আশেপাশে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু ওখান থেকে আসা নিম্ন বর্গীয় হিন্দুদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল মানুষের বাসের অনুপোযোগী দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে। এও ছিল একরকম। ক্রমাগত বাম ফ্রন্টের বুদ্ধিজীবীরা এদের হয়ে লড়াইয়ে নামেন ও এদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার আবেদন জানাতে থাকেন তৎকালীন সরকারের কাছে। বছর পাঁচেক আগে (’৭৪ সালে) এসব নেতাদের অনেকেই শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেন। মরিচঝাঁপিতে প্রস্তাবিত সুন্দর একটা জনবসতি গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ’৭৭ সালে ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট সরকার। উদবাস্তু নেতা সতীশ মণ্ডল মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে স্মরণ করালেন তাঁদের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তখন পাশার ছক বদলে গেছে। তিনি শাসকের পদে আসীন হয়ে তখন বলে বসলেন “সরকার আপনাদের কোনও সহযোগিতা করবে না। আপনারা যদি নিজেদের উদ্যোগে সুন্দরবনে নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারেন, করুন। আমার পুলিশ আপনাদের বাধা দেবে না।“ বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো এই সর্বহারার দল সেদিন এ কথায় উদ্যম হারায় নি। বরং সরকারের এই কথায় প্রায় তিরিশ হাজার শরণার্থী গত বছর মার্চ মাসে দলে দলে এসে আশ্রয় নেন মরিচঝাঁপিতে। আভি আয়া কাহানী মে টুইস্ট। নমঃশুদ্র জাতির এই খাটিয়ে লোকগুলো ছ’মাসের মধ্যে সেখানে একটা আস্ত জনবসতি গড়ে তুলল। স্কুল, হাসপাতাল, পানীয় জলের টিউবোয়েল, মাছ চাষের অভিনব সব পদ্ধতি। অহং এ আঘাত! সরকারী সাহায্য ছাড়া, পার্টির আনুকূল্য ছাড়াই জঙ্গলের মধ্যে অশিক্ষিত, ছোট জাতের লোকগুলো একটা সুসংগঠিত জনপদ বানিয়ে ফেলল!
এরা যে কোনও মূহূর্তে বাম শাসনের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে অতএব নির্দেশ জারি হল। ব্যাক টু দন্ডকারণ্য। কিন্তু তা যে হওয়ার নয়। পরিশ্রমে গড়ে তোলা বসতি কি ছেড়ে যেতে বললেই ছাড়া যায়। তারা জেহাদ ঘোষণা করে। সেই কারণে জানুয়ারী মাসে সেখানে অবাধ গণহত্যা চালায় বাম সরকার। মেয়েরা এবং শিশুরা কেউই ছাড় পায় নি সরকারের পোষা পুলিশ নামক গুন্ডা বাহিনীর হাত থেকে। এম সি ডি এস এর তরফ থেকে এই ঘটনার নিন্দা করা হয় সোচ্চারে। তখন শুভ সবে সবে কলেজে ঢুকেছে।