জানুয়ারির ১০ তারিখে (২০২৩) বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে (একসময়ে পাঠক সংখ্যা ৩০,০০,০০০ অব্দি ছিল) একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে “The Coming Collapse of the U.S. Health Care System” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনের শুরুতে খানিকটা বর্ণনার ঢং-এ বলা হয়েছে – “সকাল ৪টে বাজে, এবং আপনি জেগে উঠলেন যেন বুক ভেঙ্গে যাবে এরকম এক ব্যথা নিয়ে। আপনার পরিবার ৯১১ নম্বরে (ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য আমেরিকার সার্বজনীন নম্বর) ফোন করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশিক্ষিত প্যারামেডিকেরা (চিকিৎসকের সাহায্যকারী বাহিনী) চলে এল এবং ডায়াগনোসিস করল এটা হার্ট অ্যাটাক। তারা আপনাকে জানাল, আপনাকে ৪৫ মিনিট দূরে নিয়ে যেতে হবে কারণ গত কয়েক মাসে ২টি স্থানীয় হাশোপাটাল বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি হাসপাতালে এসে পৌঁছনোর পরে দেখা গেল অস্বাভাবিক রকমের ঠাসাঠাসি ভিড় এবং হাসপাতাল থেকে জানানো হল আপনার জন্য হাসপাতালে কোন আইসিইউ বেড খালি নেই। কারণ স্টাফের অভাবে ৫০% আইসিইউ বেড ব্যবহার করা যাচ্ছেনা, অন্য বেডগুলো ইমার্জেন্সি রোগীতে ভর্তি। এরকম দুঃস্বপ্নের রাত অতিমারি-উত্তর সময়ে আমাদের দেশের হেলথ কেয়ার দেবার ক্ষেত্রে নিতান্ত পরিচিত ঘটনা। পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ যেখানে আধুনিকতম চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে এবং সর্বাধুনিক আবিষ্কার রয়েছে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় এরকম কোন মারাত্মক “প্রত্যাশা” নেই।” এটুকু পড়ার পরে যেকোন পাঠকের মনে হতে পারে – এ তো আমেরিকা নয়, ভারতের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি দেখছি!
ওই প্রতিবেদনে পরে বলা হল, “অতিমারি-উত্তর এরকম দুঃস্বপ্নের কারণ বহুবিধ। যেভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত পেশাদারদের যেভাবে দেখা হত ও মূল্যায়ন করা হত, অতিমারির পরিণতিতে এ অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। অতিমারির উত্তুঙ্গ সময়ে এদেরকে বীর হিসেবে গণ্য করা হত, যারা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে কমিউনিটিকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্নরকম। নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায় ৭,০০০ নার্সের ধর্মঘট শোচনীয় অবস্থার প্রতীকী প্রকাশ।” পরিশেষে বোলা হয়েছে, “আমরা যদি স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য বিনিয়োগ না বাড়াই এবং মানুষকে মূল্য দিতে না শিখি, তাহলে এই সুড়ঙ্গের শেষে কোন আলোর রেখা দেখতে সমর্থ হব না।” আমাদের অভ্যস্ত কানে এ কথাগুলো যেন দৈব বাণীর মতো শোনায়।
এ প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে, “প্রতিদিন আমরা শুনতে পাচ্ছি যে গোটা দেশ জুড়ে হাসপাতালগুলোর অনেক মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। হাসপাতালগুলো ওবস্টেট্রিক, শিশুচিকিৎসা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের জরুরী বিভাগ বন্ধ করে দিচ্ছে হাসপাতাল বাঁচানোর জন্য।” এখানে মনে রাখতে হবে, আমেরিকার অধিকাংশই প্রাইভেট এবং কর্পোরেট হাসপাতাল। মানুষ নয়, মুনাফাই এদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। “স্টাফের অভাব এই সংকটের সূচনা করেছে। অতিমারি-উত্তর অবস্থায় হাসপাতালে স্থায়ী স্টাফের পরিবর্তে অস্থায়ী, কাজ-চালানোর মতো স্টাফদের নিয়োগ করা হচ্ছে। অল্পদিনের চুক্তিতে নিযুক্ত এই স্টাফদের (locum staff) ক্ষেত্রে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময় পায়না।” আমাদের বাংলায় কিংবা ভারতবর্ষে আদুরে “পার্মানেন্ট কন্ট্র্যাকচ্যাল” নামের নতুন ধরনের যে নিয়োগ পদ্ধতি চালু হয়েছে তার সাথে আমরা চমৎকার মিল খুঁজে পাচ্ছি। সংকটের কোন সীমা, দেশ কিংবা ভৌগোলিক পরিধি নেই বোধহয় – মাত্রা এবং গুণগত প্রভেদ ছাড়া।
এ প্রতিবেদনে কার্যত কয়েকটি বিষয়কে জ্বলন্তভাবে সামনে এনেছে – (১) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব – আমেরিকার ৪৫ মিনিটের পথ অতিক্রম করার মাঝে যে কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, (২) সর্বক্ষণের চিকিৎসকের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে ডাক্তার নিয়োগ শুরু হয়েছে, এবং, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, (৩) স্বল্পকালীন চুক্তিতে ডাক্তার নিয়োগের ফলে “চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময় পায়না”।
এখানে দুয়েকটি তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের একটি হিসেব অনুযায়ী আমেরিকায় ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে ফ্যামিলি প্রাকটিস, জেনারেল প্র্যাকটিস বা ওখানকার গ্রামীণ প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে ভীষণরকম অনীহা দেখা যাচ্ছে। নীচের গ্রাফ থেকে সেটা বোঝা যাবে।
(সূত্রঃ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন – NEJM)
ভারতেও তো আমরা একই চিত্র দেখতে অভ্যস্ত। এর জন্য শেষ অব্দি এর খেসারত দিতে হয় কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষকে – যাদের কাছে স্বাস্থ্যের কোন সুযোগ পৌঁছয় না। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং মানুষের জন্য নিবেদিত চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মী এদের কাছে নিষ্ঠাভরে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৪২ কোটি মানুষের দেশে এ প্রয়াস সমুদ্র থেকে এক আঁজলা জল তুলে নেবার মতো। কিন্তু এসব সত্বেও এদের নিরলস প্রচেষ্টা লাগাতার চালু থাকে। কোভিড-উত্তর সময়ে এ চেহারা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মিডিয়ায় আছড়ে পড়া লাগাতার “স্বাদু” খবরের প্রচারের জেরে এগুলো পেছনে চলে যায়। আমাদের “বন্দে ভারত” এক্সপ্রেস আছে, “টুকরে টুকরে গ্যাং” বা “আর্বান নক্সাল” আছে, আছে “লাভ জিহাদ” কিংবা হেট স্পিচ”। আছে সর্দার প্যাটেলের বিশাল মূর্তি। আছে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে কোটি কোটি টাকার রসালো কাহিনী। আছে ইতিহাসের পরিবর্তে ইতিহাস নিয়ে নিত্যনতুন গালগ্লপ, ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং পুনর্নিমাণ। এর মাঝে মানুষের ন্যূনতম স্বাস্থ্যের সুযোগ কথা বলার সময় কোথায়? কে বলবে? কেন বলবে? স্বাস্থ্য রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট দেয়না। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রটিকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি প্রায়-পূর্ণত কর্পোরেটদের হাতে – শিক্ষার মতই। ক্রমাগত রাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নিচ্ছে।
কোভিড অতিমারি ও তার পূর্বকালের জনস্বাস্থ্যের টুকরো চিত্র
ল্যান্সেট-এর মতো জার্নালে (এপ্রিল ২, ২০২০) প্রকাশিত হচ্ছে “Why inequality could spread COVID-19”। এ প্রবন্ধে বলা হচ্ছে – “কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে অসমান প্রতিক্রিয়া খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে … কোভিড-১৯-এর পুরো ফলফল এখনো আমাদের দেখা বাকী আছে … বিশ্ব অর্থনীতি যতবেশি করে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে প্রবেশ করছে সরকারের তরফে ‘bailout’ বা বাঁচিয়ে তোলার প্রোগ্রাম তত বেশি করে প্রাধান্য দিচ্ছে শিল্প ও শিল্পপতিকে। কিন্তু আমাদের অপ্রতুল সম্পদ ব্যবহারের জন্য সে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার যা অসাম্যকে অতিরিক্ত বৃদ্ধি করার পরিবর্তে কমিয়ে আনবে।”
এরকম এক প্রেক্ষাপটে মূল করোনা আখ্যানে প্রবেশের আগে আমরা কয়েক দশক আগের আন্তর্জাতিক চিত্র একবার দেখে নেবো, বর্তমান সময়কে বোঝার জন্য। এ ইতিহাসের কয়েকটি মূল বিষয়ে প্রথম থেকেই আমাদের নজরে রাখতে হবে আমাদের বর্তমানের মূল্যায়নেরর জন্য।
(১) ১৯৮১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ কংগ্রেসের ৩৪তম অধিবেশন বসেছিল জেনেভাতে, ৪-২২ মে, ১৯৮১ সালে। সে সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমাদের অবশ্যই অসামান্য আধুনিক হাসপাতাল প্রয়োজন।” তাঁর পরবর্তী বক্তব্যই ছিলো, “স্বাস্থ্যকে মানুষের কাছে পৌঁছুতে হবে। কেন্দ্রাভিমুখী হবার বদলে প্রান্তাভিমুখী হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা।” আরও বললেন, ”স্বাস্থ্য কোন পণ্য নয় যা পয়সা দিয়ে কেনা যায় কিংবা এটা কোন ‘সার্ভিস’ নয় যা দেওয়া হবে। “এটা জানার, বেঁচে থাকার, কাজে অংশগ্রহণ করার এবং আমাদের অস্তিত্বসম্পন্ন হবার চলমান একটি প্রক্রিয়া”। আরও বলেছিলেন, “আমাদের স্বাস্থ্যসেবা শুরু হবে সেখান থেকে যেখানে মানুষ রয়েছে, সেখান থেকে যেখানে রোগের সমস্যার শুরু”। আধুনিক সময়ের পূর্ণত পণ্যায়িত ঝকমকে, চোখ-ধাঁধানো স্বাস্থ্য পরিষেবার (স্বাস্থ্য নয় কিন্তু, এই ভুল করবেন না) যুগে ৪০ বছর আগের এ উচ্চারণ এবং উপলব্ধি বৈপ্লবিক বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
(২) ক্লিনিক্যাল হেলথ তথা ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং পাব্লিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্য এ দুয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক – দুটি আলাদা দর্শনের জগৎ। আমরা আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৫-৭ বছর বা তার বেশি সময় ধরে যা শিখি তা হল একজন ব্যক্তি রোগীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কি করে চিকিৎসা করা যায়। এখানে জনস্বাস্থ্য বা জনতার স্বাস্থ্য একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে পাস করে বেরনো চিকিৎসক সমাজের মানসিক অবস্থানে এবং সামাজিক দর্শনে ক্লিনিক্যাল হেলথের ছাপ রয়ে যায় কিংবা এ ছাপ রয়ে যায় চিকিৎসকের চেম্বারে অথবা সরকারি কিংবা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগীর চিকিৎসার মাঝে – এক দুর্মর ছাপ। পাবলিক হেলথ এখানে দুয়োরাণী। একটা উদাহরণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে ভারতে ৩০,০০,০০০-এর বেশি মানুষ মারাত্মক এবং মারণান্তক সিলিকোসিস রোগে ভুগছে। এ রোগ আমাদের প্রায় পড়ানো হয়না বললেই চলে। এ রোগ দরিদ্র হবার রোগ, দারিদ্র্যের অভিশাপের রোগ – কৃষিতে সংকুলান না হবার জন্য পেটের দায়ে খাদানের কাজ কিংবা বিভিন্ন ক্রাশার নিয়ে কাজ করার রোগ।
ক্লিনিকাল হেলথের শিক্ষা আমাদের কাছে এ রোগকে অদৃশ্য (invisible), অশ্রুত (indiscernible) করে রেখেছে। একে দৃশ্যমানতা বা visibility এবং শ্রুতিসীমা বা discernibility-র স্তরে তুলে আনার প্রচেষ্টা কি আমরা চালাবো? এরকম আরও অনেক রোগের কথা বলা যায়। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় অ্যাসেবেস্টোসিস রোগে (সিলিকোসিস ধরনের একটি রোগ) বছরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। এ নিয়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল (NEJM) পত্রিকায় ১৫ আগস্ট, ২০১৯, সংখ্যায় বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হল “A Most Reckless Proposal – A Plan to Continue Asbestos Use in the United States”। আমরা কবে পারবো এরকম এক পদক্ষেপ নিতে? আমেরিকায় ৪০,০০০ মানুষের জন্য মান্য মেডিক্যাল জার্নালে খবর হয়। আমাদের এখানে করোনার মতো অতিমারিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে অগণন মৃত্যুর মতো ঘটনা ছাড়া এসব “ফালতু” ও “অবান্তর” মৃত্যুগুলো আমাদের গোচরেই আসেনা। কোন পদক্ষেপ তো অনেক কষ্ট-কল্পিত ব্যাপার।
(৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোন বিকল্প কোনভাবেই অধুনা ভারত সরকার প্রস্তাবিত Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারেনা। ঐতিহাসিকভাবে জনস্বাস্থ্যের আতুর ঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অন্তত ২০০ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনে ও ধাপে এটা প্রমাণিত। এখানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা হয় মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগের, যাদেরকে অবহেলাভরে দেওয়া হয়েছে “neglected tropical diseases” বা “গরম দেশের অবহেলিত রোগসমষ্টি”। Do We Care গ্রন্থের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন – “একটি হার্ট সার্জারি, কানের একেবারে অন্তর্ভাগে “ইমপ্ল্যান্ট” বসানো কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য অর্থ পাওয়া সহজলভ্য, কিন্তু সহজলভ্য নয় প্রয়োজনীয় এবং একেবারে প্রাথমিক ডায়াগ্নোসিসের জন্য, কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় এ শিক্ষার জন্য, রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য, বৃদ্ধদের দেখাশোনা এবং যত্নের জন্য, স্কুলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং বয়ঃসন্ধির যত্নের জন্য, অথবা communicable (যেমন ডায়ারিয়া, টিবি, শ্বাসকষ্টের রোগ) কিংবা non-communicable (যেমন ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক) রোগগুলোর যে সরাসরি কারণ (যেমন দূষিত পানীয় জল, দূষিত পরিবেশ বা বায়ু) সেগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য, কিংবা অর্থের জোগান নেই অ্যাক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সামান্য জ্বরের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সাপে কাটা রোগীর জন্য – যে বিষয়গুলো দরিদ্র মানুষের জন্য নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ”। (পৃঃ ২৪-২৫) HWC এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাইনা, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যা ১৯৪৮-এ “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির সুপারিশে যা জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
(৪) ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য – এই দুটি ধারণার মাঝে ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “equitable access to basic health services” অর্থাৎ, স্বাস্থ্যের বুনিয়াদি সুযোগের জন্য সবার সমান প্রবেশাধিকার থাকবে। এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য কি সরকারি বা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে।
এখানে ইংল্যান্ডের সুবিদিত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কথা একবার স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের প্রতিটি বাড়িতে একটি লিফলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। লিফলেটে বলা হয়েছিল –
“Your new National Health Service begins on 5th July. What is it? How do you get it?
It will provide you with all medical, dental, and nursing care. Everyone—rich or poor, man, woman or child—can use it or any part of it. There are no charges, except for a few special items. There are no insurance qualifications. But it is not a “charity”. You are all paying for it, mainly as taxpayers, and it will relieve your money worries in time of illness. There are no insurance qualifications. But it is not a “charity”. You are all paying for it, mainly as tax payers, will relieve your money worries in time of illness.”
এর পরে আর বলার কি থাকতে পারে?
Lancet জার্নালে ২৪ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে – ২০১৮-তে সবচেয়ে বেশি রেভেন্যু দেয় এরকম ১০০টি সংস্থার মধ্যে ৬৯টি হল কর্পোরেট সংস্থা, ৩১টি সরকারি সংস্থা। (“From primary health care to universal health coverage – one step forward and two steps back”, Lancet, August 24, 2019, pp. 619-621) পূর্বোক্ত প্রবন্ধে দুটি মনোযোগ দেবার মতো পর্যবেক্ষণ আছে – “UHC, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপরীতে, রোগের ক্ষেত্রে যেগুলো সামাজিকভাবে নির্ধারণ করে সেই “social determinants of health” এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে থাকে”। এবং “কেয়ার” বা যত্নের পরিবর্তে “কভারেজ” (coverage) এই শব্দটি স্বাস্থ্যের সীমায়িত পরিসর বোঝায়, এবং বোঝায় যে একটি ইন্সিরেন্স স্কিমে কতগুলো নাম (সবার নাম নয়) তালিকাভুক্ত হবে।
আরও বিপজ্জনক হল UHC-র ইন্সিউরেন্স-নির্ভর মডেলকে প্রোমোট করা হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য কম অর্থ বরাদ্দ এবং অন্যান্য জনস্বাস্থ্যের প্রোগ্রামকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত করে”। প্রসঙ্গত মনে রাখবো ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এত ঢক্কানিনাদের পরেও জিডিপি-র ১-১.৫%-এর মধ্যে। ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটির বেশি। এবার মাথাপিছু গড় ব্যয় কতো হিসেব করুন। শুধুমাত্র চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায় – এ সংখ্যা ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। (National Health Policy 2017, 2015)
(৫) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৮-এর আলমা-আটার ঘোষণাপত্রে হু-র তরফে হ্যাফডান ম্যালারের অধিনায়কত্বে স্পষ্টত “New International Economic Order (NIEO)”-এর ধারণা উচ্চারিত হয়েছিলো। দেশের সম্পদ বিতরণের ব্যাপারেও সেখানে আলোচনা হয়েছিলো। পৃথিবীর ১৩০টির বেশি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেসব দেশে, অর্থাৎ পৃথিবীর এক বড়ো সংখ্যক দেশে, এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিক্যাল সিলেবাসও তৈরি হচ্ছিলো। সহজেই বোঝা যায়, দৃষ্টিকোণ এবং পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে মেডিক্যাল সিলেবাস এবং শিক্ষার ধরণও বদলে যাবে।
আলমা-আটার ঘোষণাপত্রকে কোন কোন গবেষক স্বাস্থ্যের জগতে Magna Carta-র সাথে তুলনা করেছেন (Magna Carta for health)। ১৯৮০-র দশক থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দা এবং নিওলিবারাল অর্থনীতির উত্থানের ফলে হু কোণঠাসা অবস্থানে চলে যেতে লাগলো। ইংল্যান্ডের থ্যাচার এবং আমেরিকার রেগান হু-কে হুমকি পর্যন্ত দিতে শুরু করে। হু-কে দেওয়া এদের অনুদান প্রায় বন্ধ করে দেয়। হু-র অপরাধ হল ১৯৭৭-এ “এসেনশিয়াল মেডিসিনস প্রোগ্রাম” নেয় যেখানে জেনেরিক ড্রাগস (দামী ব্র্যান্ডের পরিবর্তে) ব্যবহার করার বিধান দেওয়া হয়। প্রত্যাশিতভাবেই দানবীয় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো এর প্রবল বিরোধিতা করে। ১৯৮১ সালে আবার এক বিপত্তি ঘটালো হু – International Code for Marketing Breast Milk Substitutes-এর নীতি নিল! মায়ের বুকের দুধের বদলে বেবি ফুডের প্রচারক ও উৎপাদক নেসলের মতো কোম্পানির (যে একটি মাঝারি সাইজের মধ্যবিত্ত দেশ কিনে রাখার ক্ষমতা রাখে) রোষানলে পড়লো, এদের সঙ্গী হিসেবে রইলো এদের দ্বারা প্রভাবিত আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো।
একটি গবেষণাপত্র (“(Re-)Making a People’s WHO”, প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ পত্রিকায় জুলাই ১৬, ২০২০, সংখ্যায়) অনুযায়ী যেসব দেশ হু-র পরামর্শ শুনেছে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে জোর দিয়েছে তারা তুলনায় কোভিড-১৯ আক্রমণে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – যেমন, জার্মানি, ভিয়েতনাম, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফিনল্যান্ড।
নিওলিবারাল অর্থনীতি, অতিবৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা, নিওলিবারাল অর্থনীতির বাহক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং পৃথিবীর বড়ো রাষ্ট্রগুলোর চাপে হু নিজের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।
এখানে আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়তে পারে, হ্যাফডান ম্যালারের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে আলমা-আটা-য় গ্রহণ করা “Declaration of Alma-Ata – International Conference on Primary Health Care”-এর কথা যেখানে প্রথমবারের জন্য আক্ষরিক অর্থে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হল বিশ্ববাসীর সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা (comprehensive primary health care) সুনিশ্চিত করার কথা এবং সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান গৃহীত হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় যা বলা হয়েছিল তার মূল কথা ছিল – পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে। এবং এজন্য যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তে স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে।
“সকলের জন্য স্বাস্থ্য”, “স্বাস্থ্য আমার অধিকার” এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা”-র ধারণা ১৯৭৮ থেকেই নিঃসাড়ে বদলাতে শুরু করে। প্রথমে আসে “সিলেক্টিভ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (বেছে নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা)”, তারপরে এলো GOBI (growth monitoring, promotion of oral rehydration, promotion of breast feeding, immunization) এবং পরবর্তীতে খুব খোলাখুলি ভার্টিকাল বা রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রাম। কমিউনিটির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি জীবন্ত ও সক্রিয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রোগ্রাম পরিত্যক্ত হল। এর বিষময় ফল আমরা এই অতিমারির সময়ে প্রত্যক্ষ করছি।
ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (এপ্রিল ৭, ২০১৮) “WHOse health agenda? 70 years of struggle over WHO’s mandate”-এ বলা হল – “The 1990s heralded a defanging (বিষ দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া) of WHO. The international health field was transmogrified into global health, whose “shared” agenda opened the floodgates to business.” আজকের ২১৫টি দেশ আক্রান্ত হবার পরেও জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে “opened floodgates to business” (ব্যবসার বাঁধ খুলে দেওয়া)-এর ফলে কে বেশি লাভ করবে।
নেচার-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে (“হাউ কোভিড হার্ট দ্য ফাইট এগেইন্সট আদার ডেঞ্জারাস ডিজিজেস”, ২১ এপ্রিল, ২০২১) দেখানো হয়েছে – ভারতে লকডাউন ঘোষণা হবার পরে প্রতিমাসে টিবি রোগী সনাক্তকরণ উদ্বেগজনকভাবে ৭০% হ্রাস পেয়েছে। ২০২১-এর মার্চ অব্দি, হু-র হিসেব অনুযায়ী, চিকিৎসা না-হওয়া এবং সনাক্ত না-হওয়া বিশ্বব্যাপী টিবি রোগীর সংখ্যা অন্তত ১০,০০,০০০। ফলে অনেক বেশি করে টিবি সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। ২০২০-তে সম্ভবত ৫০০,০০০ টিবি রোগী মারা গেছে।
পোলিয়ো রোগীর সংখ্যা ৫৫৪ (২০১৮) বেড়ে ১,২১৬ (২০২০) হয়েছে। শিশুদের রুটিন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম মাসের পর মাস বন্ধ হয়ে গেছে। PLoS জার্নালের একটি সম্পাদকীয়তে (“নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেসঃ দ্য টেন-থাউজ্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”, এপ্রিল ২৭, ২০১০) – “১১টি নিউক্লিয়ার শক্তিসম্পন্ন দেশের নিউক্লিয়ার সমরাস্ত্র তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের যা ব্যয় করে তার একটি অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ (১/১০,০০০ ভাগ) ব্যয় করলে অবহেলিত রোগগুলিকে নির্মূল করা যেত, এবং বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে এগনো যেত।”
ভারতের ক্ষেত্রে, ২০১৬ সালে সংসদীয় কমিটির প্যানেল রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ১০,১৮৯ জন মানুষের জন্য ১ জন সরকারি ডাক্তার, প্রতি ২,০৪৬ জনের জন্য সরকারি হাসপাতালে একটি বেড বরাদ্দ এবং প্রতি ৯০,৩৪৩ জনের জন্য একটি সরকারি হাসপাতাল – এই হচ্ছে সেসময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যের চিত্র। ২০২০ সালের মার্চ মাসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩৭ কোটি মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৭,১৩,৯৮৬টি। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ১০০০ ভারবাসীর জন্য ০.৫টি করে বেড। বিহারে আবার এই সংখ্যা ১০০০-এ ০.১১, দিল্লিতে ১.০৫ – বৈষম্য সহজেই চোখে পড়ে। এরসাথে যুক্ত করতে হবে, হু-র দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, এইমস থেকে পাস করে বেরনো ৫৪% ডাক্তার বিদেশে পাড়ি দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্যকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। করোনা পরবর্তী সময়ে জনসমাজের গর্ভ থেকে এ দাবী আরও জোরদার হয়ে ওঠা দরকার।
আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে অতিবৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি Merck-এর তদানীন্তন প্রধান কর্মকর্তা Henry Gadsden বিখ্যাত Fortune পত্রিকার প্রতিনিধি W. Robertson-কে জানিয়েছিলেন (Forune, March, 1976) – “I want us to be like Wrigley’s and sell to everyone.”
তুলনাটি বড়ো কৌতুকপ্রদ। Wrigley কোম্পানি, আমাদের অনেকেরই জানা, আমেরিকার একটি বিখ্যাত বাবল গাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি। Gadsden-এর আক্ষেপ হল যে বাবল গাম-এর মতো ওষুধকেও সবার কাছে বিক্রী করতে পারলেন না! অতঃ কিম্? এরপরে শুরু হল সুকৌশলী এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে রোগ বা অসুখ বিক্রী করার নিরন্তর, ধারাবাহিক ও হিংস্র একটি উপাখ্যান লেখার ইতিহাস। সে ইতিহাসের সানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে Ray Moynihan এবং Alan Cassels-এর লেখা Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients (Allen Unwin, 2008) পুস্তকে। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই বইটি দেখবেন।
অধুনা একটি অতি জনপ্রিয় চালু বিষয় হল “whole body check-up”। যে বিশাল সংখ্যক রোগী প্রধানত দক্ষিণ ভারতে পাড়ি জমান চিকিৎসার জন্য তাদের জন্য অ্যাপোলো হাসপাতাল বোধহয় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক এরকম একটি প্যাকেজ চালু করে। রোগীদের চিন্তায়, মননে এবং বোধে ধীরে ধীরে সংক্রামিত হতে থাকে একবার whole body check-up করে ফেলতে পারলে রোগ নিয়ে আর দুর্ভাবনার বিশেষ কিছু থাকে না। একটু নজর করলে বুঝবো মানুষের স্বাভাবিক সুস্থতার মাঝে একটি “পরিহার্য বিপন্নতা” বোধের জন্ম হচ্ছে, মানুষ নির্ভর করতে শুরু করছে আরো বেশী বেশী পরিমানে মেডিসিনের জগতের ওপরে, যাকে আমরা বলছি medicalization of life।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (৯ জুন, ২০১৪) প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় এবং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্পাদকীয়-র শিরোনাম – “General health checks don’t work: It’s time to let them go”। এতে বলা হয়েছিল – “People who accept an invitation to a health check tend to have higher socioeconomic status, lower cardiovascular risks, less cardiovascular morbidity, and lower mortality than others.” অর্থাৎ সচরাচর যারা এ ধরণের চেক-আপ করাতে যান তারা অর্থনৈ্তিকভাবে সুস্থিত অবস্থায় থাকার ফলে বিশেষ কিছু শারীরিক সমস্যার সম্ভাবনা সাধারণভাবে কম। Danish Inter99 Trial-এর একটি বড়ো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের এক-ই সংখ্যায়। ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত ৩০-৬০ বছর বয়সী ৫৯,৬১৬ জন মানুষের ওপরে এ সমীক্ষা করা হয়েছিলো। সমীক্ষার সিদ্ধান্ত – “A community based, individually tailored intervention programme with screening for risk of ischaemic heart disease and repeated lifestyle intervention over five years had no effect on ischaemic heart disease, stroke, or mortality at the population level after 10 years.”
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেমস গলব্রেথ তাঁর “A Perfect Crime: Inequality in the Age of Globalization” (Daedalus , Winter, 2002, Vol. 131, No. 1, pp. 11-25) প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে ১৯৮০-র দশকের পর থেকে নিওলিবারাল অর্থনীতি পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং অসহায়তা বাড়িয়ে তুলেছে। সে প্রবন্ধে গলব্রেথ জানিয়েছিলেন – “It has been, it would appear, a perfect crime. And while statistical forensics can play a small role in pointing this out, no mechanism to reverse the policy exists, still less any that might repair the damage.”
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেবার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত এবং সহস্রাধিবারের বেশি উদ্ধৃত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”। মূল প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে (Volume LIII, Number 5, ডিসেম্বর, pp. 941-973)। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তখন অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল ৯ পৃষ্ঠা।
অ্যারো তাঁর অবস্থান প্রবন্ধের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন – “the subject is the medical-care, not health. The causal factors in health are many, and the provisio of medical care is only one.” এরপরে তিনি “analysis of the medical-care market”-এ প্রবেশ করেন। বলেন – “in the analysis of the medical-care market is comparison between the actual market and the competitive model…” ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ আনেন অ্যারো – “It is frequently observed that widespread medical insurance increase the demand for medical care.” এক অদ্ভুত যুক্তি জালের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম – একদিকে, ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ এলো স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ প্রসঙ্গও চলে এলো। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি যে পণ্য দুনিয়ার অন্যক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয় – একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও ঊদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্যক্ষেত্রে দেখা যাবেনা। তাঁর অভিমত – “The economic manifestations of this taste are to be found in individual donations to hospitals and to medical education, as well as in the widely accepted responsibilities of government in this area.” KFC, Nike কিংবা অ্যাডিডাসের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখতে পাবোনা।
বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টর ইন-ডোর রোগীর ৮০% এবং আউটডোর রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যখাতে ৭০% ভাগ খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হয়, মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। AIIMS-এর মতো সরকারী ভর্তুকী পুষ্ট আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের শতকরা ৫৪ জন পাড়ি দেয় বিদেশে, এদেশে থাকে না।
আমেরিকান অর্থনৈতিক দর্শন তৈরি করে নেয় চিকিৎসা পণ্যের বাজার। সরকারী হাসপাতাল পড়ে থাকে হতদরিদ্রদের জন্য। ভারতবর্ষে আমরা আমেরিকান মডেলকে অনুসরণ করছি, ইউরোপের “ওয়েলফেয়ার স্টেট”-এর মডেল নয়। কিন্তু
২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির আমরিকায় ১৮% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করার পরেও ওখানকার মানুষ স্বাস্থ্যের সবচেয়ে অসুখী দেশের একটি। স্বাস্থ্যের মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪% বরাদ্দ প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। সমগ্র চিকিৎসক সংখ্যার ৩০%-এরও কম নিযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে।
Lancet-এ ২০১৪ সালের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্যের লক্ষ্যসীমায় পৌঁছুন হল “an achievement that has the potential totransform health systems, especially for the poorest people.” রাষ্ট্রহীন মানুষেরা যাদের মধ্যে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, প্রমাণপত্রহীন পরিযায়ী মানুষ অথবা যাদের জন্মের নথিভূক্তি অস্বীকার করা হয়েছে, এদেরকে রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান কর্তাব্যক্তিরা “without legal entitlement to any rights to health care” বলে মনে করেন। (“What does universal health coverage mean?”, Lancet January 18, 2014, pp. 277-279) মানুষ হিসেবে এরা বেঁচে আছে অথচ স্বাস্থ্যের অধিকার নেই! এ এক বিচিত্র ছলনা – কে নেবে এ সমাধানের দায়িত্ব? এখানে আরেকটি প্রবন্ধের কথা বলবো যেখানে দেখানো হয়েছে নতুন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো প্রাথমিকভাবে ধনীদের কাছে পৌঁছয়, এবং পরবর্তী সময়ে তা চুঁইয়ে পড়ে দরিদ্রদের মাঝে। (“Universal health coverage: friend or foe of health equity?”, Lancet June 25, 2011, pp. 2160-2161)
ভারতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এখনো ২%-এর কম – প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। ফলে সহজেই অনুমেয়, কি অতি সামান্য পরিমাণ অর্থবরাদ্দ পড়ে থাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ খাতে খরচের চিত্রটি একবার দেখে নেওয়া যাক।
জুলাই, ২০১৯-এ Patient-Centerd Primary Care Collaborative নামের একটি স্বাধীন আমেরিকান সংস্থা এক রিপোর্ট তৈরি করে – “Investing in Primary Care” শিরোনামে। সে রিপোর্টে বলা হয় – “সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ক্রবর্ধমান প্রামাণিক তথ্য এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য কাঠামোতে শ্রেষ্ঠতর স্বাস্থ্যের ফলাফল লাভ করা যায়, অধিকতর স্বাস্থ্যের ন্যায্যতা (health equity) পাওয়া যায় এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচ হয়। তবুও, এসমস্ত শক্তিশালী প্রামাণ্য তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও – যেমন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগীরা বেশি বেশি করে চায় এবং নীতিনির্ধারকেরাও একে অস্বীকার করতে পারেনা – প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জগতটি আমেরিকাতে লাগাতারভাবে নিতান্ত অপ্রতুল ফান্ডিং পায়। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয় তার মাত্র ৫-৭% ব্যয়িত হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশে (যেমন OECD – ৩৭টি বাজার অর্থনীতি-নির্ভর দেশের একটি সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় আমেরিকার দ্বিগুণেরও বেশি – ১৪%।”
শেষ কথা
সর্বশেষ বিপদ সংকেত হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও কর্পোরেটদের থাবা ঢূকে পড়েছে। এখনও অবধি অবহেলিত এ ক্ষেত্রটিতেও এদের কুটিল নজর এসে পড়েছে। ১২ জানুয়ারি, ২০২৩-এ NEJM-এ প্রকাশিত হয়েছে – “Corporate Investors in Primary Care – Profits, Progress, and Pitfalls”। এখানে বলা হয়েছে – “On July 21, 2022, Amazon announced plans to acquire One Medical — a primary care practice with nearly 200 locations serving more than 700,000 patients — for $3.9 billion.” আরও বলা হল – “An overarching revenue strategy underlies investors’ appetite for primary care … Between 2010 and 2021, the total capital raised for private investment in primary care in the United States increased by a factor of more than 1000 — from $15 million to $16 billion.”
এর কয়েকবছর আগে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পত্রিকায় “The Role of Private Equity in Driving Up Health Care Prices” শিরোনামের (২৯ অক্টোবর, ২০১৯) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল – “Private investment in U.S. health care has grown significantly over the past decade thanks to investors who have been keen on getting into a large, rapidly growing, and recession-proof market with historically high returns. Private equity and venture capital firms are investing in everything from health technology startups to addiction treatment facilities to physician practices. In 2018, the number of private equity deals alone reached almost 800, which had a total value of more than $100 billion.”
ভারতেও কি এরকম এক মডেল অনুসৃত হবে অদূর ভবিষতে? কারণ ভারতে কর্পোরেট আধিপত্যের নতুন যুগে ইউরোপীয় নয়, আমেরিকান মডেল অনুসৃত হচ্ছে প্রায় সর্বক্ষেত্রে। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য (যারা Oxfam-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী জিএসটির ৬৪% জোগান দেয়) কি পড়ে থাকবে? যে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ (অন্তত) নিজেদের পকেট থেকে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করার দরুন “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”-এর ফাঁদে পড়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যায়, সে সংখ্যা কি আরও বৃদ্ধি পাবে? বিবিসির ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩-এর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম – “Richest 1% own 40.5% of India’s wealth, says new Oxfam report”। বিচারের ভার পাঠকের হাতে তোলা রইলো।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে জীবন্ত করে তোলা আজ বড্ডো জরুরী।
ভীষন জরুরী এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা, শিক্ষা দূর্নীতি বিষয়ে বড় হালকা পর্যবেক্ষণ, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভা চলছে স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং অর্থনীতি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে,কোবিড ভ্যাকসিনেসনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও মৃত্যু নিয়ে ফাইজার প্রধান সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে বৈঠকখানায় পালিয়ে যান, যেমন মোদী সরকার ভ্যাকসিন পরবর্তী মৃত্যু দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন।লন্ডনে আমাজন একেবারে মনুষ্য বিহীন দোকান খুলেছেন এভাবেই নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হবে বিশ্ব জুড়ে।
সময়োপযোগী এবং বিশ্লেষণী লেখা। নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুল দুই টার্গেট শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে বৃহৎ পুঁজির কব্জায় আনা কারন এই দুটিই হল inelastic commodity – যাদের ডিমান্ড অন্যান্য দ্রব্য বা সার্ভিসের মতন দাম বাড়লে কমে না বরং অনেক ক্ষেত্রে তার ডিমান্ড বেড়ে যায়। ১৯৭০ থেকে নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাড়-বাড়ন্তের ফলে কি ভাবে জনস্বাস্থ্যের বাজাকরণ এবং পাব্লিক হেলথ্ কেয়ারকে নষ্ট করা হচ্ছে তা লেখক সুন্দ্র ভাবে তুলে ধরেছেন।