আমরা ভারতীয়রা যখন করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য আশঙ্কিত হয়ে আছি, যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বহু লোকের সংসার, জীবন, স্বার্থ, প্রেম, নিরাপত্তা চুরমার করে দিয়ে প্রায় চলে যাবার পথে, ‘পোস্ট কোভিড’ সিম্পটম নিয়ে যখন আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে তখন একই সাথে উঠে আসছে ‘লং কোভিড’-এর আলোচনা। সত্যি করে বলতে গেলে আমাদের দেশে এখনও এই ‘লং কোভিড’ নিয়ে তেমন আলোচনা শুরু হয় নি কারণ আমরা এখনও করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কথা ভেবে থথহরি কম্পমান- পৃথিবীর অনেকে দেশেই যেখানে তৃতীয় ঢেউ পার হয়ে গেছে, জনসাধারণের মধ্যে ভ্যাকসিন যথেষ্ট পরিমাণে দেওয়া হয়ে গেছে তারা কিন্তু এই ‘লং কোভিড’ নিয়ে এর মধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন।
তার আগে আমাদের বুঝতে হবে লং কোভিড বলতে আমরা কী বুঝি? অনেক ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়া ঘটিত অসুখে অসুখ কমে যাবার অনেক পরে সেই অসুখের জন্য শরীরে নানারকম অসুবিধে দেখা দিতে পারে। মজার কথা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অসুখ যখন হয় তা হয়ত খুব সাধারণ হয়েছিল, প্রায় বোঝাই যায় নি কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক পরে শরীরে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা মারাত্মক এবং অনেক সময় তা মৃত্যুকে ডেকে আনে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের থেকে মারাত্মক পরিণতি হিসেবে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা যখন কোভিড-19 অতিমারির প্রায় চলে যাবার ঈঙ্গিত পেতে শুরু করেছেন তখন তাদের মধ্যে এই চিন্তা প্রবল হয়ে উঠছে এই কোভিড কী পরবর্তীকালে স্থায়ী ও মারাত্মক কিছু প্রতিক্রিয়া আমাদের আক্রান্তদের শরীরে রেখে যেতে পারে?
সবাই প্রায় একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, হ্যাঁ পারে। কোভিডে আক্রান্ত হবার অনেক মাস বা বছর পরে আমাদের দেহে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া অন্যভাবে দেখা দিতেই পারে। আমাদের এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রশ্ন হল কেন একটা ভাইরাস শরীর থেকে চলে যাবার পর বা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও আমরা তার ভবিষ্যৎ শিকারের তালিকায় চলে যেতে পারি? এমন উদাহরণ কি আরও আছে?
ভাইরাস যখন আমাদের শরীরে বংশবিস্তার করে তখন তারা আমাদের জিনোমের সাথে তাদের জিনোম মিশিয়ে দেয়। আমাদের কোশকে একই সাথে দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের সাথে সাথে ভাইরাল প্রোটিন তৈরিতেও বাধ্য করে। কখনও কখনও এই মিশ্রিত ভাইরাল জিনোম আমাদের কোশের মধ্যেকার ‘টিউমার সাপ্রেসর জিন’ যা আমাদের ক্যানসার সৃষ্টিতে বাধা দেয় তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়ে কোশের সংখ্যাবৃদ্ধি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে শরীরে টিউমার বা ক্যানসারের সৃষ্টি করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কথা। এদের উপস্থিতিতে আমাদের যৌনাঙ্গে ফুসকুড়ি বা জেনিটাল ওয়ার্ট হয়। তা সেরেও যায়। কিন্তু এদেরই কিছু ভাইরাস আছে যা আমাদের দেহে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অসুখের সৃষ্টি না করলেও তারা মেয়েদের শরীরে সার্ভাইকাল ক্যানসারের সৃষ্টি করতে পারে। একবার কখনও হয়ত সেই মেয়েটি এই ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। এর জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত যেতে হয় নি অথচ এরই প্রভাবে সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে।
শুধু ভাইরাসই নয় ব্যাকটিরিয়ার প্রভাবেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনেস বলে এক ব্যাকটিরিয়া আছে যার প্রভাবে সামান্য গলা ব্যথা বা খুসখুসে কাশি হয়। কিন্তু কিছুদিন বাদে এর প্রভাবে হঠাৎ করে শিশুদের সারা শরীরের অস্থিসন্ধি ফুলে ওঠে, প্রবল জ্বর আসে। যাকে আমরা রিউম্যাটিক ফিভার বলে থাকি। চিকিৎসায় তা সহজে সেরেও যায় কিন্তু বেশ কয়েক বছর বাদে তাদের হার্টের সমস্যা দেখা যায়, যা মারাত্মক ও স্থায়ী। সারাজীবন ধরে আক্রান্তকে এর আঘাত বাঁচিয়ে চলতে হয়। আমাদের ডাক্তারিতে চালু এক কথা আছেঃ স্ট্রেপটোকক্কাস লিক্স দ্য জয়েন্ট বাট বাইটস্ দ্য হার্ট।
এই যে ঘটনাটা ঘটল তাকে বলে ‘অ্যান্টিজেন মিমিক্রি’। স্ট্রেপের কোশের গায়ে যে প্রোটিন থাকে যা কিনা বহিরাগত অ্যান্টিজেন তার সাথে আমাদের হার্টের মায়োসিন প্রোটিনের খুব মিল। তাই আমাদের দেহে সেই ব্যাকটিরিয়া প্রবেশ করলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম তাকে প্রতিহত করার জন্য যখন অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেই অ্যান্টিবডি ব্যাক্টিরিয়াকে নষ্ট করার সাথে সাথে আমাদের হার্টের মায়োসিন প্রোটিনকেও নষ্ট করে দেয়- তাই আমাদের হার্টের বিশেষত হার্ট ভাল্ভের সমস্যা দেখা দেয়। আগের থেকেই যাকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করলে স্থায়ী বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
সারা পৃথিবীব্যপী সকল বিজ্ঞানীরা মনে করছেন করোনাও হয়ত তার ‘প্যানডেমিক’ নিয়ে চলে যাবার পর যখন একটা সিজনাল ইনফেকশন হিসেবে রয়ে যাবে তখন তার প্রভাবে আক্রান্তদের শরীরে কয়েক বছর পরে এমনই কিছু মারাত্মক পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ক্যানসার হওয়াও অসম্ভব কিছু না। একেই বলা হচ্ছে ‘পি.এ.এস.সি.’ (পোস্ট অ্যাকিউট সিকোয়েলি অব সার্স কোভিড-19 ইনফেকশন) বা সংক্ষেপে ‘লং কোভিড’।
এখন প্রশ্ন হল আমরা যারা চিকিৎসক তারা কী এরকম কোনো লক্ষণ আক্রান্তদের শরীরে এখন দেখতে পাচ্ছি? কোভিড তো প্রায় দেড় বছর পার করে ফেলল। যদিও এটা এই মুহূর্তে বলাটা খুবই কঠিন তবে স্বীকার করতেই হবে এরকম রুগি আমরা যে কিছু পাচ্ছি না তা কিন্তু নয়।
অনেকেরই সাত-আট মাস পার হয়ে গেলেও দূর্বলতা কাটছে না। পেটের অসুখ ধরা পড়ছে। সহজে ছাড়ছে না। অথচ আগে সেই মানুষটির পেটের কোনো সমস্যাই ছিল না। আমার অনেক রুগি কোভিডের পর ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। আগে তাদের ব্লাড সুগার একদম স্বাভাবিক থাকত। অনেকেই মনে করেন টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিস হওয়ার কারণ হিসেবে ভাইরাল সংক্রমণের খুব সম্ভাবনা আছে। অনেকে এন্টেরোভাইরাসকে এর জন্য দায়ি করেন। আমার অনুমান ভবিষ্যতে কোভিডের সাথে ডায়াবিটিসের কোনো যোগসূত্র নিশ্চই আবিষ্কৃত হবে।
অনেক রুগি পাওয়া যাচ্ছে যাদের কোভিডের পর কাশি কিছুতেই কমছে না। অনেক মাস পার হয়ে গেছে। কারোর ক্ষেত্রে এক বছর ধরে কাশি কমছে না। হয়ত কোভিড হয়েছিল। টেস্ট হয় নি, বা ধরা পড়ে নি। ফুসফুসে তার প্রতিক্রিয়া রয়ে গেছে। অনেকের চেষ্ট এক্স-রে নর্মাল পেলেও অনেকের ফুসফুসে অল্প জল বা ‘মাইল্ড প্লুরাল ইফিউসন’ পাওয়া যাচ্ছে।
আমার কাছে একটি পঁচিশ বছরের ছেলে দেখাতে এসেছিল যার গত বছর কোভিড হয়েছিল। খুব সামান্য। প্রায় না হবার মতই। অথচ তার পরে এক বছর পার হয়ে গেছে তার গন্ধের অনুভূতি ফিরে আসে নি। ‘ডাক্তারবাবু আমি এই একবছর ধরে যা খাচ্ছি কোনোকিছুরই আমি কোনো স্বাদ পাই না’। বহু ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু আমি তাকে কোনো সাহায্যই করতে পারি নি। আশ্বাস দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। করোনা ভাইরাস আমাদের ঘ্রাণের রিসেপ্টর নাকি আমাদের ব্রেনের ঘ্রাণকেন্দ্রকে আক্রমণ করে, করলে কতটা করে তা নিয়ে ভবিষ্যতে নিশ্চই কাজকর্ম হবে।
তবে ‘লং কোভিড’ আক্রান্তদের সবচেয়ে বেশি যে অঙ্গের ক্ষতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে তা হার্ট। ‘পোস্ট কোভিড’ আক্রান্তদের অনেকেই হার্টের অসুখে মারা গেছে। খুব অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরাও হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠার পর হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। আমার পরিচিত ফরেনসিকের এক ডাক্তারবাবু বলেছেন তারা পোস্ট মর্টেম করতে গিয়ে অনেক বাইশ-তেইশ বছরের পোস্ট-কোভিড ছেলেমেয়েদের পেয়েছেন যাদের হার্ট একদম ফেটে গেছে। অনেকের হার্টে প্রচুর পরিমাণে জল জমে বিরাট আকার ধারণ করে হার্ট ফেইলিওরে মারা গেছে। তাই চিকিৎসিকেরাও মনে করছেন লং কোভিডেও হার্টের ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও সবচেয়ে বেশি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই ধরণের লক্ষণকে বলে ‘হিট অ্যান্ড রান’ রিয়্যাকশন। অনেকদিন আগে কোভিড হয়ে যাবার পরেও গায়ে হাতপায়ে ব্যথা কিছতেই কমছে না। খাবার ইচ্ছে নেই, কাজে উৎসাহ নেই, ডিপ্রেশন, মনে ভয়, ভুলে যাওয়া- এসব লক্ষণ নিয়ে অনেকেই আসছেন। বিশেষ করে বৃদ্ধরা। আমরা এই ধরণের লক্ষণকে বলতে পারি ‘ব্রেইন ফগ’। অন্য সময় হলে হয়ত আমরা এইসব রুগিদের আশ্বাস দিয়েই ছেড়ে দিতাম কিন্তু কোভিড এসে আমাদের অনেক সতর্ক করে দিয়েছে। আমরা এদের সাথে কোভিডের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছি। যদিও আমরা যে এই মুহূর্তে বিশেষ আলাদা কিছু করতে পারছি তা নয় কিন্তু আমাদের এই সতর্কতাটুকু কোভিডের প্যানডেমিক না এলে আসত না।
কোভিডের থেকে পরে আমাদের কখনও ক্যানসার হতে পারে কিনা, আমাদের হার্টের অসুখ, ফুসফুসের ফাইব্রোসিস, ডায়াবিটিস হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে কিনা, তা আমরা এই মুহূর্তে জানি না। তবে কোনো সম্ভাবনাকেই আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না।
এই সময় যে প্রশ্নটা আমাদের সবার মনে, আমার রুগিরা এলেই অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটা করবেন তা হল- ডাক্তারবাবু থার্ড ওয়েভ কি আসছে? তা কি আরও মারাত্মক হবে? সত্যিই এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কেউই সম্ভবত জানেন না। কোভিড এমন এক অসুখ যা সকলকে বারবার ভুল প্রমাণ করেছে। আমরা আশা করতে পারি অগষ্টের শেষের দিকে থার্ড ওয়েভ এলে তা হয়ত খুব মারাত্মক হবে না কারণ আমাদের মধ্যে সেকেন্ড ওয়েভ এত ব্যপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে তা আমাদের সকলের মধ্যেই প্রতিরোধের জন্য উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করে দিয়েছে। শিশুদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি হবে মনে করা হলেও আমার তা মনে হয় না কারণ আগের দুটো ওয়েভ শিশুদের মোটেই তেমনভাবে কব্জা করতে পারে নি।
তবে আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার ভারতের ‘এজ পিরামিডের’ দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব যে আমাদের দেশের ০-১৪ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ। এদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায় নি। কিন্তু এরা নিজেরা আক্রান্ত না হলেও এদের বাড়ির লোকেরা আক্রান্ত হওয়ায় এদের শরীরে উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়।
তাই শেষে যে কথা বলার দরকার তা হল, তৃতীয় ওয়েভের মোকাবিলা করেই আমাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। কোভিড হয়ত তারপর একটা সাধারণ ফ্লু হয়ে রয়ে যাবে কিন্তু ‘লং কোভিড’ আমাদের শরীরে কী কী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে তা এখনও আমাদের জ্ঞানের বাইরে। যাদের কোভিড হয়েছে তারা তাই সাবধানে থাকবেন। ভয় পাবার কিছু নেই, ডিপ্রেশনেরও কিছু নেই কিন্তু শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাকে অবজ্ঞা করাটা হয়ত ঠিক হবে না। কারণ আপনি কোভিড নিয়ে যতটা জানেন আমরা ডাক্তারবাবুরাও আপনার থেকে খুব বেশি কিছু জানি না।
আমিও যেহেতু কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম তাই এই কথাগুলো আমি আপনাদের সাথে নিজেকেও বললাম। সুতরাং এটিকে একটি আত্মসতর্কতামূলক পোস্ট বলতেই পারেন।
(লেখক এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য কোয়ান্টা ম্যাগাজিনের একটি আর্টিকেলের ওপর ঋণী।)