একটি নতুন কথা শিখলাম। শিখলাম এক প্রাক্তন আমলার ভাষণ থেকে। স্বনামধন্য এই আমলা সুন্দর বাংলা বলেন। শুধু এই সুন্দর বাংলা বক্তৃতা শোনার জন্যই ওনার কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। উনি বললেন, ইংরেজী Retreat কথাটির বাংলা হল এই সিংহাবলোকন। যদিও গুগলে লেখা হয়েছে, পশ্চাদপসরণ। এই শব্দটি আমার যথাযথ মনে হয় না। সিংহ যখন ধীর পায়ে এগিয়ে চলে, মাঝে মাঝে ঘাড় কাত করে পিছন দিকে দেখে। কেন দেখে, বা কী দেখে আমার জানা নেই। কিন্তু জীবনের প্রধান দুটি ধাপ পেরিয়ে এসে, এখন আমারও এ ভাবে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখার সময় হয়েছে।
প্রথম দুটি বড় ধাপ হল , ছাত্র জীবন আর কর্ম জীবন। এখন এসে পৌঁছেছি অবসর জীবনে। ঘাড় কাত করে পিছন দিকে তাকালে এখন তো দেখছি, সদ্য পেরিয়ে আসা চাকরী জীবনটা।
প্রায় তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা। যেটুকু মনে আছে তাই লিখতে গেলে, চারটে না হোক একটা ধর্ম গ্রন্থের সমান তো হবেই। আজ লিখতে শুরু করলে পরের লোকসভা নির্বাচনের আগে লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু পড়বে কে? আমার মত একটা অকিঞ্চিৎকর সরকারী চাকুরের গল্প শোনার লোক নেই। প্রথম সরকারী চাকরীতে ঢোকার কথা তো মনে থাকেই। আমি যখন চাকরী করতে ঢুকি তখন বাম আমল একেবারে তুঙ্গে। আজ নাকি একজন নেত্রীর ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না; সে সময় তেনাদের ইচ্ছা ছাড়া সরকারী কর্মচারী বাতকর্মও করতে পারত না। মেদিনীপুরে আমার বন্ধু, অধুনা প্রয়াত ডা ভোলা রায় আমাকে এক জেলা স্তরের নেতার কাছে নিয়ে গেলেন। উনি খুব আন্তরিকতার সাথে আমাকে মেদিনীপুরের কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে দেবেন, বললেন। আমার নিজের স্বার্থের থেকেও আমার কিছু কিছু জনসেবার কাজেই আমাকে দরকার ছিল। তার বছর দুই আগে থেকেই আমি আর ঐ বন্ধু ভোলাদা মেদিনীপুরের কুষ্ঠ আশ্রম আর লায়ন্স ক্লাব নিয়ে মেতে ছিলাম। সে সময় দু বারে একশের বেশী কুষ্ঠ রোগীর চোখের অপারেশন করে আমরা বেশ হৈ হৈ ফেলে দিয়েছিলাম। তখনও যেহেতু সরকারী চাকরীর চক্করে ঢুকিনি, জানতাম না ঐ রকম জনসেবার থেকে নেতাদের পায়ে তেল দেওয়ার দাম অনেক বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্রথম চাকরী হল, মেদিনীপুরে থেকে পাঁচশ মাইল দূরে। ভোলাদা তো ভাবতেই পারেননি আমি মেদিনীপুর ছেড়ে চলে যাব। চাকরীতে ঢুকেই প্রথম দিন সন্ধ্যায়ই বুঝে গেলাম, ওখানকার বামপন্থী ডাক্তার সংগঠনের নেতার ইচ্ছা ছাড়া ওখানে কিচ্ছু হয় না। যে প্রশাসনিক পদে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাজ করার কথা, সেখানে চাকরীতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় দিনে আমাকে বসিয়ে দেওয়া হল। আর যাদের ঐ দ্বায়িত্ব নেওয়ার কথা তারা শুধুই নেতার পদলেহন করে বছরের পর বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াল। প্রতিটা নিয়মই সাধারণ বুদ্ধিতে যা ঠিক মনে হয় সেই ভাবেই তৈরী। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে ভেবে, পদে পদে সে সব স্বাভাবিক নিয়ম কানুন লঙ্ঘন করা হয়। আর তাতে নেতাদের কিছু সুবিধা হলেও, আসল কাজের জায়গায় বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। নিজের সুস্থ চিন্তা ভাবনা কাজে লাগিয়ে যতটা পারা যায় কাজ সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়া ধান্দাবাজ সহকর্মীদের সামলানো কঠিন। নানান অসুবিধা, অন্যায় সামলে একটা একটা দিন পের করেছি। তাতে আর যাই হোক, দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া আর কিছু হয়নি। গোটা পাঁচেক কর্মচারী ইউনিয়নের ঝক্কি পোহাতে পোহাতে একদিন, চুলোয় যাক এ চাকরী বলে, সব ছেড়ে দিয়ে বসে ছিলাম মাস দুই। নেতারা কিন্তু তোমার ম্যাও তুমি সামলাও বলে মিটিমিটি হেসেছিল। এবং অবশ্যই নিজের ম্যাও নিজেই সামলেছিলাম। ঐ সময়, আমার পুরোনো অভ্যাস মত, বনের মোষ তাড়ানোর কাজ আবার শুরু করছিলাম। একটি নাটকের দলের লোকেদের রাজি করিয়ে, তাদের একটা ঘরে, সপ্তাহে একদিন করে, দু টাকায় চোখ দেখা শুরু করলাম। ওদের দিয়ে, স্কুল বাড়ীতে চোখের অপারেশন করা শুরু করলাম। ওরা কিন্তু আমার এই মোষ তাড়ানোর কাজ দেখে বেশ উৎসাহ পেয়ে গেল। সেখান থেকে এক অদ্ভুত যোগাযোগ হয়ে গেল। ওদের পরিচিত এক ছোট মন্ত্রীর মাধ্যমে, রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের চোখের ডাক্তার হয়ে চলে এলাম। সে এক মজার ব্যাপার হয়েছিল। ডাক্তার সংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে, চামচা সকল, কোন ভাবেই অংক মেলাতে পারল না। ইউনিয়নের নেতার পদলেহন না করেও কি করে এ লোকটা এত তাড়াতাড়ি জেলা হাসপাতালে এসে গেল, এ একটা ধাঁধা হয়ে গেল। আজও আমি ঐ মন্ত্রীকে চোখে দেখিনি। আবার এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়ার জন্যই, আমিও হয়তো অনেক যোগ্য লোককে অতিক্রম করে এগিয়ে গেছলাম। একটা বদলির দরখাস্ত জমা করে তার একটি প্রতিলিপি বন্ধুদের হাতে দিয়েছিলাম; আমার কাজ ছিল ঐ পর্যন্ত। একটা কথা ততোদিনে বুঝে গেছি, পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।
তারপর তো ছেলের অসুখের জন্য চলে আসতে বাধ্য হলাম। কলকাতার কাছের হাসপাতালে এসেও দেখলাম, নেতাদের সু নজরে না থাকলে বিপদ আছে। তাই সব মিছিলে না গেলেও সময় মত চাঁদা দিয়ে দিতাম। কত কমবয়সী সহকর্মীর নির্লজ্জ পদলেহন দেখলাম। নিজের কাজটা করে যাওয়া ছাড়াও বনের মোষ তাড়ানোর বদ অভ্যাস থেকে গেল। এবার অবশ্য সে জন্য কোন সুযোগ নিতে হয়নি। একেবারে এক সহকর্মী দাদার ব্যক্তিগত একটা চিঠির দৌলতে, কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে চলে এলাম। এখানেও চাঁদাটা সময়মত দিতে হয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, এরকম এক নেতার চোখে পড়ার জন্যই, আমার মোষ তাড়ানোর কাজটা আসল জায়গায় এসে পৌঁছেছে। ঠিক যখন আমার সেই কাজটা একটা রাস্তা পেয়েছে, তখনই রাজ্যে পট পরিবর্তনের সূচনা হল। পুরনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। নতুন জমানার নেতা মন্ত্রীর সাথে দেখা করার কথা মনেও আসেনি। কিন্তু আমার এই সাপের কামড়ের কাজটা এতোটাই ব্যতিক্রমী ছিল যে, নেতারা এটার কথা ভাবেইনি। সত্যিই কি তাই? না কি এই কাজটা করে লাখ লাখ টাকা রোজগারের সুযোগ নেই বলেই এটা নিয়ে কেউ ভাবেনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে গিয়ে শুধুই নেতাদের সাথে আমার কি সম্পর্ক ছিল তাই মনে পড়ছে কেন? আসলে সময়টা তো রাজনীতির সুনামির সময়। আমার একটা রাজ্য স্তরের স্বীকৃতিও আমার বন্ধুরা ঐ চামচে বাজী করে পাওয়া মনে করে। এটাই বোধহয় ফিরে ফিরে দেখি। কাকে কবে তেল দিয়েছি, খোঁজার চেষ্টা করি বোধহয়। চাকরী থেকে অবসরের পরও ঐ একটা কাজের জন্য লোকে ডাকছে। এটাই আসলে ফিরে ফিরে দেখি। এ দেখার মধ্যে কোন গ্লানি নেই। আছে শুধুই কিছু কাজ করে যাওয়ার আনন্দ।