সক্কাল সক্কাল সবে হাজিরা খাতায় সইসাবুদ সেরে সারাদিনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি.. ওয়ার্ড থেকে ফোন..
– শিগগির আসুন ডক্টর। খুব খারাপ বাচ্চা এসেছে..
পিপিই গলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি মাসখানেকের বাচ্চা আপাদমস্তক হলুদ, নাড়ির গতি ক্ষীণ, শ্বাসের অবস্থাও ভালো নয়। সারারাত ভালো করে দুধ টানতে পারে নি।
এসব অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরে আসা আর ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে ফিরে আসা প্রায় সমান। আমাদের লড়াই শুরু.. বাকি সময়টায় দু’জন ডাক্তার, দুজন নার্সিং স্টাফ, একজন স্বাস্থ্যকর্মী ক্রমাগত চরকিবাজি খেতে শুরু করলেন.. আড়াই কেজির শরীরে নল ঢুকে গেল শরীরের অজস্র জায়গায়..
ভেন্টিলেটরের অ্যালার্ম বাজছে.. আমরা চেঁচিয়ে যাচ্ছি দিদি স্যালাইন বোলাস.. অ্যাড্রিনালিন..ডোপামিন.. অক্সিজেনটা বাড়ান.. ক্যালসিয়াম.. টিউবটা দেখে সাবধানে..
দিদিরা সিরিঞ্জের পর সিরিঞ্জ ওষুধ বানাচ্ছেন.. কখনও ইনফিউশন পাম্প ঠিক করছেন, কখনও শ্বাসনালীতে হাওয়া দেওয়ার ব্যাগ সামলাচ্ছেন। তারই মধ্যে কাগজপত্র রেডি করা, বাড়ির লোকের সাথে কথা বলা। মোটামুটি কথাটথা বলে যা বোঝা গেল, বাচ্চার সমস্যার শুরু তার আগের দিন থেকে। শোনার পরেই ‘এত দেরি করে আনলে কেন’ বলতে যাচ্ছি.. ঢোঁক গিলে নিলাম বাচ্চার বাবার কথায়। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তারা আসছে। লকডাউনে গাড়িঘোড়া পাওয়া মুশকিল। সারারাত এ গাড়ি, ও গাড়ি করে কোলকাতা এসে পৌঁছেছে।
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া। দীর্ঘশ্বাসও আজকাল পিপিই পেরিয়ে বাইরে আসে না।
হঠাৎ বাচ্চার হার্টবিট বন্ধ! বুকে চাপ দিয়ে, ওষুধ দিয়ে কোনোমতে হার্ট আবার চালু হ’ল। আবার ভেন্টিলেটরে দেওয়া হ’ল। কিছুক্ষণ বাদে নাক-মুখ থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করলো। তারপর আরও বার দু’য়েক হার্ট অ্যাটাক আর অগুনতি ওষুধের উৎপীড়ন..
না। কারো প্রশংসা শোনার আশায় এ গল্পের অবতারণা নয়। বাচ্চাটা বাঁচে নি। আমাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে সন্ধের দিকে বাচ্চাটার বুকের ধুকপুক থেমে যায়। মারীর পৃথিবীতে মাত্র চার হপ্তা পাঁচশো কোটির হাওয়ায় ভাগ বসিয়েছিল খুদে শরীরটা।
মৃত্যু সংবাদ দিতে গেলেই আজকাল মনে হয় নিজের মুন্ডুটা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সবরকমের সতর্কতা কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরেও ‘মৃত্যু’ মানেই মোটামুটিভাবে ‘চিকিৎসার গাফিলতি’। সবকিছু জানিয়ে বলতে শুরু করলাম.. এবং, আবারও অবাক হলাম। এবং, আবারও ঢোঁক গিললাম।
– সব দেখছি ডাক্তারবাবু। আবনারা সকাল থেক্যা অনেক কচ্ছেন। যা কচ্ছেন অ্যার বেশি আর কী করা যায়.. মোদের ভাগ্যে নাই আর কী করব..
অভিঘাতটা দুম করে এসে লাগলো! আজকাল মৃত্যু মানেই ঝামেলা, ভাঙচুরের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে হয়। স্যোশাল মিডিয়ায় ফলাও করে লেখা হয় বগলের তলায় ইঞ্জেকশন দিয়ে ভেন্টিলেটরে থাকা মৃত মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে টাটকা রেখে টাকা আদায় করা হয়। সেগুলো অগুনতি মানুষ বিশ্বাস করেন এবং চিকিৎসক নামক ‘অসুর’ প্রজাতিটির নামে জীবন্ত-পিন্ডদান করে থাকেন। সেসব দেখেশুনে গা সয়ে গেছে। আগে আগে বলার চেষ্টা করতাম এভাবে মৃত মানুষকে ভেন্টিলেটরে রাখা যায় না। ভেন্টিলেটর শুধুই বিভিন্নভাবে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকানোর মেশিন। বলতে বলতে হাঁফিয়ে গেছি। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সবাই মোটের ওপর আর কিছু না হলেও ডাক্তারিটুকু আগাপাশতলা বোঝেন। তাই, হেরে যাওয়া দিনে কেউ আঙুল না তুললে চমকে উঠি। কথা বলতে পারি না। দরদরিয়ে ঘেমে যাই..
বাচ্চার বাবার খর্বকায়, ক্ষীণতনু সন্ধের আবছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে.. কেন জানি না অকারণে চশমায় বাষ্পের ভিড়..
অভ্যস্ত হাতে লিখে ফেলি মৃত্যুর কারণ। আড়াই কেজির শরীর এখন শুধুই একটা ডেথ সার্টিফিকেট! আমার কলমের একটা আঁচড়ে আইনত সে জীবনের অধিকার হারালো।
আমাদের ইমোশনাল হ’লে চলে না। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে এসেই অন্য কাউকে প্রফেশনাল দক্ষতায় বলে দিতে হয়, “নাঃ! আপাতত চিন্তার খুব একটা কিছু দেখছি না। দেখা যাক, একটু অবজার্ভেশনে থাক..”
আজকাল টিভি দেখি না, খবরের কাগজ ওল্টাই না, স্যোশাল মিডিয়ায় আসি না বললেই চলে। জীবন বলতে মাস্ক-গ্লাভস-স্যানিটাইজার-পিপিই। সমাজের কাছে প্রত্যাশা বা সমাজের প্রতি দায় কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। একটা সময় চিৎকার করে বলতে চাইতাম জয়ের দিনে যতটা ঘাম আর শ্রম থাকে, পরাজয়ের দিনে বরং তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে। নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা সে সব চিৎকারের প্রয়োজনীয়তা ভুলিয়েছে।
ঠান্ডা, স্পন্দনহীন, নীলচে শরীরের মৃত মাছের মতো ঘোলাটে, স্থির চোখের মণির দিকে তাকিয়ে ‘ইস যদি..’ টুকু ছাড়া মারীর দেশের সাথে আপাতত হেরোদের কোনও সম্পর্ক নেই…
আপনাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা গুলি আমাদেরকে অন্য ভাবে চিন্তা ভাবনা করতে সাহায্য করে। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন
আপনার লেখা গুলো অনেক কে শেয়ার করি। শুধু আপনাদের রোগী সম্বন্ধে অনুভূতি বোঝানোর জন্য। ভালো লেখা। আবার ও লিখবেন। আপনারা জিতবেন, এ লড়াই জেতার লড়াই। মানুষ ঠিকই আপনাদের বোঝে। না বোঝার ভান করে ভদ্রবেশ ধারী ধান্দাবাজ রা। আমাদের কাজ হলো অগণিত মানুষ মধ্যে লেখাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে মানুষ রাস্তা ঘাটে মুখোশ ধারী গুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে। আমি নিয়মিত পাঠক। ভালো থাকবেন, থাকতেই হবে।