আমরা যে কী চাই সেটাই আমরা ঠিক করে জানিনা।
খিদে, ঘুম, কামের বাইরেও মানুষের নানারকম অনুভূতি রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জোরদার অনুভূতি সম্ভবত ভালোবাসা। অহেতুক ভালোবাসা। শর্তহীন ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা তীব্র কষ্ট দেয়। আবার সে ভালোবাসার জোরে কষ্টের দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়া যায়।
মানুষে মানুষে কতরকম সম্পর্ক হয়। বাবা- মায়ের সাথে সম্পর্ক, ভাই- বোনের মধ্যে সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক। এই একরৈখিক সম্পর্কগুলো আমাদের চোখে পড়ে। সহজে সবাই মেনে নেয়। সবাই মেনে না নেওয়া সম্পর্কও মাঝে মাঝে উঁকি মারে। সেগুলো নিয়েও লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু অতটা কলমের জোর আমার নেই। যারা সত্যিকারের কথাশিল্পী তাঁরা সেসব নিয়ে লিখবেন। আমি সাহিত্যিক নই। কিন্তু এটুকু বুঝি এই ‘মানা’ বা ‘না মানা’ সম্পর্কগুলির পেছনে একটাই চালিকা শক্তি- সেটা ভালোবাসা। কাম নয়, মোহ নয়, মায়া নয়- একমাত্র ভালোবাসাই একটা সম্পর্ককে বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখে। আর এটা অনেক সময়ই পাশাপাশি থাকার সময় বোঝা যায় না। বোঝা যায় ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললে।
আমার এসব জটিল বিষয় নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা নেই। সেই চেষ্টা করলে নিশ্চিত ছড়িয়ে ফেলব। আমি বরঞ্চ গল্প শোনাই। দুটো ছোটো ছোটো গল্প।
আমার একজন রোগী ছিল, যে একটি বিরল ও জটিল রোগে আক্রান্ত। রোগটির নাম “ডুচেন মাস্কুলার ডিস্ট্রফি”। ছেলেটির বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি মাইনের চাকরি করেন। মা গৃহবধূ।
ছেলেটি ছিল মা বাবার আদরের একমাত্র সন্তান। তাকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য তাঁরা সাধ্যের বাইরে গিয়েও ভর্তি করেছিলেন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ক্লাস সেভেন অবধি সব ঠিক ঠাকই চলছিল। সমস্যা শুরু হলো তারপর। ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যেতে শুরু করল। পায়ের মাংস পেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশ হাঁটা অসম্ভব হয়ে উঠল।
কাছাকাছি কয়েক জায়গায় দেখানোর পর ওনারা ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণভারত গেলেন। যাবতীয় সঞ্চয় খরচ করে ছেলের চিকিৎসা শুরু করলেন। সেখানে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়ল। এবং এটাও জানলেন এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ডুচেন মাস্কুলার ডিস্ট্রফি একটি জীন গত অসুখ। যা বহন করে X ক্রোমোজোম। স্বাভাবিক ভাবেই এই রোগ কেবল মাত্র ছেলেদের হয়। সাধারণত ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এই রোগ শুরু হয় এবং ২৫ পেরোনোর আগেই রোগী মারা যায়।
কিন্তু ভালোবাসা কবেই বা যুক্তির কথা শুনেছে। বাড়ি ফিরেও কলকাতার বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। যে টুকু সঞ্চয় ছিল, সব শেষ করে কর্পোরেট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কিন্তু ছেলেটির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকল। ধীরে ধীরে বিছানায় আবদ্ধ হয়ে গেল। দুই পা ক্রমশ বেঁকে ভেতর দিকে ঢুকে যাচ্ছে, আর শরীরের উপরের অংশ অস্বাভাবিক ভারী হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছেলেটির হাত পা নাড়ানোর সম্পূর্ণ ক্ষমতা চলে গেল।
এই অবস্থায় ছেলেটির বাবা মা ভবিতব্যকে কিছুটা মেনে নিলেন। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে খুব দ্রুতই বাস্তবে ফিরে আসতে হয়। ফিজিও থেরাপি বাদে বাকি চিকিৎসা বন্ধ হলো। ছেলেটির মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হতো। প্রথম প্রথম ওর বাবা কোলে করে আমার কাছে নিয়ে আসতেন। কিছুদিনের মধ্যে ছেলেটির ওজন এতো বেড়ে গেল, কোলে করে বাড়ি থেকে বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তখন ওর বাবা বা মা এসে পরিস্থিতি বলে ওষুধ নিয়ে যেতেন। খুব বাড়াবাড়ি হলে আমি চেম্বার সেরে দেখতে যেতাম।
ছেলেটির সে সময় হৃদযন্ত্রের সমস্যাও ধরা পড়েছে। হাত পায়ের মাংসপেশির মতো হৃদপিণ্ডের মাংসপেশিও ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে কার্ডিও মায়োপ্যাথি। বুঝতে পারতাম, ছেলেটির আর বেশিদিন আয়ু নেই। ওর বাবা- মাকে বোঝাতে চাইতাম, কিন্তু তাঁরা বুঝতে চাইতেন না।
অবশেষে একদিন ছেলেটি চলে গেল। খুপরিজীবী ডাক্তারদের পালানোর কোনো জায়গা নেই। মা বাবার হাহাকারের মধ্যেই তাঁদের একমাত্র সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শোনাতে হলো। মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাবা দেওয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কাণ্ড করলেন। দু-চারজন প্রতিবেশীর সাহায্যে তাঁদের সামলালাম। ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে চলে এলাম।
ভেবেছিলাম তাঁরা আর আসবেন না। আমার কাছে তাঁদের আসার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু মাস দুয়েক বাদেই তাঁরা একটি তেরো- চৌদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে হাজির। পাঁচদিন ধরে জ্বর, কিছুতেই কমছে না। তাঁরা একটি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ভালোবাসার মানুষটি চলে গেছে, কিন্তু ভালোবাসা রয়ে গেছে।
পরের গল্পটা আগেও শুনিয়েছি।
এক বৃদ্ধা তার বয়স্ক স্বামীকে নিয়ে আসতেন। বৃদ্ধ স্বামীর ফুসফুসে ক্যানসার। এখানে ওখানে অনেক ঘুরে হতোদ্যম হয়ে শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এসে পৌঁছেছেন।
বৃদ্ধ টোটো করে আসতেন। টোটো থেকে নামতে পারতেন না। বাড়ির চেম্বারের সামনের রাস্তায় টোটো দাঁড়াত। আমি রাস্তায় গিয়ে দেখতাম।
দিন দিন তাঁর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। বৃদ্ধা প্রতিবারই আমাকে জিজ্ঞাস করতেন ‘কেমন আছে? আগের থেকে একটু ভালো লাগছে না?’
প্রথম প্রথম ওনাদের ছেলেও আসতেন। পরে শুধু বৃদ্ধাই রোগীকে নিয়ে আসতেন। এসব রোগে যেমন হয়, বৃদ্ধ খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছিলেন। কয়েকদিন বাদে তিনি আর টোটোতেই উঠতে পারতেন না। তখন বৃদ্ধা একাই আসতেন। বলতেন, ‘ওনার বুকের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। রাত্রে খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। ওষুধ লিখে দাও না।’
সাদা কাগজে ওষুধ লিখে দিতাম। একজন মৃত্যুপথযাত্রীর অসহায় স্ত্রীকে যেটুকু সান্ত্বনা দেওয়া যায়। অবশেষে একদিন বয়স্ক ভদ্রলোক মারা গেলেন। আমিই ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম। দিন সাতেক পরেই সেই বৃদ্ধা এসে হাজির। এসে বললেন, ‘দুদিন ধরে তো উনি কিছুই খাওয়া দাওয়া করছেন না। কিছু একটা ওষুধ লিখে দাও না বাবা।’
আমি অবাক ভাবে চেয়ে বললাম, ‘কার জন্য ওষুধ লিখব?’
‘কেন, যার জন্য লেখ।’
‘কিন্তু তিনি তো আর নেই ঠাকুমা।’
‘নেই মানে, আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন? আমার হাড়-মাস জ্বালিয়ে একেবারে খাক না করে কোথাও যাবেন না। দাওনা বাবা কিছু একটা ওষুধ লিখে।’
সেদিন বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠালাম। কিন্তু কয়েকদিন পরে বৃদ্ধা আবার এলেন। এবার অন্য সমস্যা নিয়ে। ওনার স্বামীর নাকি ঘুম হচ্ছে না। সেবারও বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠানোর পরে আবার এলেন এবং নিয়মিত আসতে থাকলেন। এখনও আসেন। তিনি এতোটাই নিয়মিত আসেন, যে আজকাল আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, বৃদ্ধার স্বামী জীবিত আছেন। রীতিমতো স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়।
‘কী হয়েছে ঠাকুমা?’
‘উনি যে একেবারেই পায়খানা করছেন না। তিনদিন আগে শেষ পায়খানা করেছেন। তুমি আগে একবার একটা মোমবাতির মতো ওষুধ লিখে দিয়েছিলে। ঢুকিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে একটা আছে। ওইটা একটা দিয়ে দেখব কি?’
‘হ্যাঁ, দিয়ে দেখেন। যদি না হয় তখন এসে বলবেন।’
আমার অনুভূতি ভুল হতে পারে (এবং সেটা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট)- তবু মনে হয় প্রিয় মানুষ জীবন থেকে চলে যেতে পারে, কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসা কোনোদিনও চলে যায় না। নানা রূপ ধরে বারবার ফিরে আসে। এই তুচ্ছ জীবনে একমাত্র ওর জন্যই তুচ্ছতাকে অতিক্রম করা যায়।