হাঁটুর ঠিক নিচে ছড়ে যাওয়া একটা দাগ আর একটা কাঠের চেয়ারের হাতল নিয়েই আজকের কথকতা।
প্রথমটা এক বন্ধুর মায়ের গল্প যাকে কাকিমা বলে ডাকি , আর দ্বিতীয়টা নিজের বাপ ঠাকুর্দার সরি ঠাকুর্দার বাপের। কাকিমা বেড়াতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ। দেশের বাড়ির নস্টালজিয়া। সেখানেই ঘটনাটা ঘটে। মামুলি তুচ্ছ ঘটনা। রিক্সা উল্টে গিয়ে কাকিমা আহত হন। একাই ছিলেন।রাস্তার লোক জন ধরাধরি করে এই বিদেশি মহিলাকে কাছের এক ডাক্তার খানায় নিয়ে যায়। ডাক্তার বাবু ভারত থেকে বেড়াতে এসেছেন শুনে অন্য রুগীদের ফেলে সবার আগে কাকিমার ট্রিটমেন্ট করেন, একটা পয়সাও নেন নি। ওনার ভাষায়, “মেহমান এর কাছ থেকে পয়সা নেওয়া যায় নাকি”।
দ্বিতীয় ঘটনাটা তুচ্ছ হলেও একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব-এর নাম জড়িয়ে। বাবা মা একসাথে বেড়াতে গেছেন বাংলাদেশ। নিজেদের পৈতৃক ভিটা ইত্যাদি সেই টুর এর অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ ছিল, যেমনটা হয় আর কি। সেই সব ভিটে মাটি ঘর দোরের বর্তমান মালিক খুব সমাদরে অভ্যর্থনা জানালেও সেই সময়ের কোনো স্মৃতি বাবা মার মনে জেগে ওঠে নি। খালি একটা কাঠের চেয়ার দেখিয়েছিলেন সেটা নাকি তাঁর আব্বা হুজুর বিক্রি না করে যত্নে রাখতে বলেছিলেন। মালখানগরে যেদিন গান্ধীজি আসেন তার আগের দিন তাঁকে বসতে দেওয়ার জন্য আমার ঠাকুর্দার বাবা ওই চেয়ারটি কিনে আনেন। গান্ধীজি তাতে আধ ঘণ্টা বসেছিলেন। সেই প্রথম আর সেই শেষ। আর কেউ বসে নি অতে। বর্তমান মালিক সযত্নে রক্ষা করছেন সেই চেয়ার। বাবার ভাষায়, “চেয়ারটায় হাতলে হাত বুলিয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল”।
বাংলাদেশ মানে আমার কাছে সেই ডাক্তারবাবু, বাংলাদেশ মানে আমার কাছে সেই বাড়িওয়ালা চাচা যিনি চেয়ারটা রেখে দিয়েছেন এক ভাবে, বাংলাদেশ মানে আমার কাছে কেবল কয়েকজন অসভ্য অভদ্র মানসিক অসুস্থ ক্রিকেট প্রেমী (?) নন যারা ভারত হারলে আনন্দে নৃত্য করেন। আর ভারত মানে আমার কাছে সেই কাকিমা, বাংলাদেশী সেই ডাক্তারের সহৃদয়তার কথা বলতে গিয়ে আজও যার চোখ ছলছল করে, ভারত মানে আমার কাছে আমার বাবা, চেয়ারের হাতলের স্পর্শ নিয়ে যিনি আজও বুঁদ হয়ে আছেন, ভারত মানে আমার কাছে সেই মানুষগুলো নয় যারা বাংলাদেশ থেকে কম পয়সায় একটু ভালো চিকিৎসার জন্য আগত অসুস্থ মানুষদের বয়কটের ডাক দেয়।
ঘৃণা বিদ্বেষের চাষকে উৎসাহ দিয়ে যে পৃথিবীর জন্ম দিতে চাইছেন কেউ কেউ সেই পৃথিবী আমার মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পৃথিবী নয়। আমার পৃথিবীতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া থাকবে না যে বেড়ায় আটকে গিয়ে ঝুলে ঝুলে কোনো বাঙালি কিশোরীর মৃত্যু হবে। উগ্র ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের অভিশাপ যেন বাঙালিকে কোনোদিন গ্রাস না করে। পৃথিবীর সব বাঙালি আমার ভাই বোন। আমরা সবাই বিদেশি উপনিবেশবাদী আর তাদের দেশীয় দোসরদের চক্রান্তের শিকার হয়েছি একবার, আর হতে চাই না। দেখাই যাক না, ভালোবাসা আর ঘেন্নায় মধ্যে এই লড়াইতে কে জেতে।
ভালোবাসা💕🙏😢