সকাল থেকে বেশ কয়েক জায়গায় চোখে পড়ল ছবিটা। ক্যামেরার লেন্সে ধরা বাস্তব নয়, নেহাতই শিল্পীর কল্পনায় ফুটে ওঠা এক রেখাচিত্র। তবু সে ফুটিয়ে তোলে অজস্র অনুভব আর কথা। এই জরা- মৃত্যুর অস্থায়ী টাইমলাইনে তাদের কোনও পাললিক শিলায় লিখে রাখতে পারি কী না দেখা যাক।
______________________________________________
গল্পের ছলেই একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে। ভূতাত্ত্বিকভাবে এ গ্রহের টাইমলাইনকে ভাগ করা যায় তিনটি প্রধান মহাযুগ (Era), তাদের অন্তর্গত বিভিন্ন যুগ (Period) এবং যুগের ভেতর নানান কাল (Epoch) হিসেবে।
তিনটি মহাযুগ হ’ল প্যালিও, মেসো এবং সিনোজোয়িক। প্রতিটি মহাযুগের প্রান্তে ঘটে গেছে একেকটি মাস- এক্সটিংশন। প্রসঙ্গত, এ ধরায় এখনও পর্যন্ত মোট পাঁচখানা মাস- এক্সটিংশন ঘটেছে এবং খুব সম্ভবত ছ’নম্বরটি অনগোয়িং। এগুলো টাইম স্কেলে এতই সুদীর্ঘ একেকটা ইভেন্ট যে আমরা সেই ইভেন্টের ভেতর বসে থাকলেও তা নিয়ে (বৈজ্ঞানিক) বক্তব্য রাখার ধৃষ্টতা দেখাতে পারি না।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক্সটিংশনটি ঘটে প্যালিও আর মেসোর মাঝে, আজ থেকে পঁচিশ কোটি বছর আগে। ধ্বংস হয়ে যায় তৎকালীন পৃথিবীর প্রায় ৯৬% প্রাণ। এই ধ্বংসস্তূপের পরেই মহাজীবনের নিয়মে আবার প্রাণ আসে, শুরু হয় মেসোজোয়িক। তারই তিনটি যুগ হ’ল যথাক্রমে ট্রায়সিক, জুরাসিক এবং ক্রেটেশিয়াসঃ সহজে বললে ডায়নোসরদের যুগ। শেষ হয় মোটামুটি সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে। আকাশ থেকে একদিন সকালে ঝরে পড়ে নেমেসিস। দু’টো জীবন তার আগের রাতেই ভেবেছিল প্রচুর সময় আছে তাদের কাছে। সময়! তারা জানত না, সময়ের কাছে আমরা থাকি, উল্টোটা নয় কখনও। তারপর সকাল পেরিয়ে অনন্ত রাত– ধ্বংস হয় প্রায় কুড়ি কোটি বছর বিস্তৃত, এ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, ‘ইনএভিটেবল’ একটি সময়কাল। আর, দু’টো জীবনের নিভৃত উপন্যাস।
জীবনের নিয়মেই আবার ধ্বংসস্তূপের পরে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে সবুজ। সিনোজোয়িক। অবশেষে গোটা সাতেক ইপক পেরিয়ে, বরফশীতল দিন পেরিয়ে রোদ ওঠে হলোসিনে। এই তো সেদিন, সাড়ে এগারো হাজার বছর আগে। ম্যানফ্রেড ম্যামথ আর স্যাবর-টুথ দিয়োগোদের দিন শেষ হয়, তুন্দ্রায়- সাভানায় শুরু হয় আমাদের পথচলা।
পরের অংশে যাওয়ার আগে সময়ের এই ধারণার অতীত স্ট্রেচকে বোঝার জন্য একটা ছোট্ট উদাহরণ রেখে যাই। আমাদের সবার চেনা (জুরাসিকের) আর্কিওপ্টেরিক্স আর (ক্রেটেশিয়াসের) টিরানোসোরাস রেক্সের মধ্যে সময়ের যা দূরত্ব, টিরেক্স আর আইফোনের মধ্যে দূরত্ব তার চেয়ে বেশ কিছুটা কমই। আর হ্যাঁ, শিল্পবিপ্লবের আড়াইশো বছর হয়নি এখনও…
______________________________________________
বৈজ্ঞানিকভাবে হলোসিন হলেও দার্শনিক বা নিতান্ত যৌক্তিকভাবে বর্তমান ইপকটির নাম অ্যানথ্রোপোসিন। শুধুই মানুষ। তার মন কেমনের গল্প ছাড়া, রক্তাক্ত বিজয়গাথা ছাড়া, প্যাস্টেলের বিমূর্ত অনুভব ছাড়া, গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ থেকে শুরু করে ISS-এর সঙ্গে একই কক্ষপথে ঘুরতে থাকা মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য ছাড়া স্থলে- জলে- অন্তরীক্ষে আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই!
এবং বাইরের বাস্তবতায় অ্যানথ্রোপোসিন যতখানি সত্যি, আমাদের ভেতরে বসে থাকা নিজেকে, জীবনকে এবং এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করার অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তার চেয়েও অনেকখানি বেশি সত্যি।
অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক, অর্থাৎ এ পৃথিবী এবং তার সমস্ত হাসি-কান্না-গান শুধু আমারই জন্য। আমার চেতনাই প্রাইমারি, তাতেই সেজে উঠছে সামান্য আকাশ। আমার দেখার স্পেকট্রামটুকুই সব, তাতেই ধরা আছে মহাবিশ্বের সমস্ত রঙ। আমার অস্তিত্বটুকুই শ্রেষ্ঠ, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে ‘এত আনন্দ- আয়োজন’।
আসলে এই বিষণ্ণ আত্মকেন্দ্রিকতা আসে আমরা কিছুতেই সময়ের এই বিহ্বল স্ট্রেচ এবং আকাশগঙ্গার নীচে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা উপত্যকার দিকে তাকাই না বলে। টাইম- স্পেসের এই মহাকাব্যিক বহমানতায় নিজেকে দেখতে শিখলে আমরা আরও নম্র হতাম, আর্দ্র হতাম। অন্যকে এবং নিজেকে কম দাগিয়ে দিতাম, জীবনকে বোঝা হিসেবে না বয়ে তার পাশে ভাসতে পারতাম আরেকটু বেশি স্থিতিশীলতায়।
আমাদের কাছে সময় নয়, সময়ের ভেতরেই আমরা থাকি। আর পড়ে থাকে পৃথিবীকে দেখার জন্য আমাদের ব্যর্থ আয়না। তাতে শিলার ভেতর ছাপ রাখা অন্য জীবন আর তার ভালোবাসাকে দেখায় যেন যুদ্ধের অবয়ব– ঠিক আমরা গোটা জীবনকে যেভাবে দেখি, দেখতে ও দেখাতে শিখি।
যেদিন বুঝতে শিখব, মানতে শিখব অঝোর বৃষ্টির ভেতর একটা ফুল আমাদের জন্য ফোটে না, গভীর অরণ্যের নীচে অবহেলায় পড়ে থাকা এক বেনামী ফার্ণের পাতায় প্রথম সূর্যালোক আমাদের জন্য এসে পড়ে না অথবা একজোড়া রঙীন পাখি আমাদের জন্য দিগন্তের দিকে উড়ে যায় না সেদিন আরও পাললিক হব আমরা। থামতে শিখব, ভালোবাসতে শিখব আরও। হয়ত অ্যানথ্রোপোসিনও শেষ হবে সেদিন। আবার অন্য মহাদেশ, অন্য বরফপ্রান্তর, অন্য জীবন।
আমাদের গভীরতম ভালোবাসার জীবাশ্মকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর পরে কোনও জীব তার মিউজিয়ামে যুদ্ধরত হিসেবে সাজিয়ে রাখুক, আমরা কেউই চাই না…