আজ, সাতই নভেম্বর, মাদাম কুরির জন্মদিন। তাঁর কথা প্রায় সকলে জানেন, মোটামুটি বিশদেই জানেন। কাজেই খুব বেশি বলার মতো কিছু নেই।
হয়ত কিছুই লিখতাম না, কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তা তেজষ্ক্রিয় রশ্মি তার প্রয়োগ এসব নিয়ে করেকম্মে খাই – তাই মনে হলো, আর কিছু না হোক, নেহাৎ কৃতজ্ঞতাবশে হলেও দু’চার কথা লেখা উচিত। অতএব তাঁর গবেষণা বিষয়ক জটিল কথাবার্তায় না গিয়ে স্রেফ তাঁর জীবন নিয়ে কয়েকটা ছোট ছোট কথা বলব –
১. হেনরি বেকেরেল প্রথম রেডিওঅ্যাক্টিভিটি অর্থাৎ তেজষ্ক্রিয়তা প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটা বুঝে ওঠার পেছনে মেরি কুরির অবদান অনস্বীকার্য। ঠিক কোথা থেকে এই তেজষ্ক্রিয় রশ্মি আসছে, রাসায়নিক বদল ছাড়াই এমন শক্তি বিকিরণ সম্ভব হচ্ছে কী করে, এই বিকিরণ থার্মোডায়নামিক্সের মূল শর্তগুলোই লঙ্ঘন করছে কিনা, এসব নিয়ে অনেক সংশয় ছিল। মেরি কুরি-ই সর্বপ্রথম অনুমান করেন – এই তেজষ্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিজস্ব ধর্ম।
সেই সময়ের বিচারে তা ছিল এক আশ্চর্য উদ্ভাবনী চিন্তা। কেননা পরমাণুই যে ক্ষুদ্রতম কণা, সে নিয়ে কারোরই সংশয় ছিল না। মেরি কুরির প্রস্তাব সত্যি হওয়ার অর্থ, সেই তত্ত্বের মূল ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যাওয়া এবং পরমাণু মাত্রেই যে স্থিতিশীল নয়, তা মেনে নেওয়া।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা যাক, রেডিওঅ্যাক্টিভিটি নামটিও তাঁরই দেওয়া।
২. তেজষ্ক্রিয়তার স্বরূপ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে সেই তত্ত্বকে পরীক্ষার ভিত্তিতে যাচাই করা দেখা, সব পর্যায়েই মেরি কুরির ভূমিকা ছিল প্রধান। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় তাঁর নামটি বাদ পড়ে যাওয়ারই কথা ছিল – যেতও, যদি না স্বামী পিয়ের কুরি রুখে না দাঁড়াতেন। পিয়েরই বলেন, তেজষ্ক্রিয়তার তত্ত্ব থেকে শুরু করে তা যাচাই করার পরীক্ষার ডিজাইন – পুরোটাই মেরির মস্তিষ্কপ্রসূত। এমনকি পিয়েরকে বাকি গবেষণা ছেড়ে এই গবেষণায় টেনে আনার কাজটিও মেরি কুরিই করেন। সেই মেরিকে নোবেল পুরস্কার থেকে বাদ দেওয়া বড় অন্যায় হয়ে যাবে। অতএব, প্রথম মহিলা হিসেবে নোবেল পুরস্কারের অধিকারী হন মেরি কুরি (সঙ্গে ছিলেন বেকেরেল এবং পিয়ের কুরি)।
৩. নোবেল জুটলেও পুরস্কারের সভায় নোবেল কমিটির তরফে ভাষণে বাইবেল উদ্ধৃত করা হয় –
ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করে বললেন, পুরুষ একা থাকবে, তা ঠিক নয় – সুতরাং আমি তার সহকারী-সঙ্গিনীও সৃষ্টি করলাম।
এমন বার্তার নিহিতার্থ, অর্থাৎ মেরি যে পিয়ের কুরির স্রেফ সঙ্গিনী-সহযোগীর বেশী কিছু নয়, এই ভ্রান্ত অবজ্ঞা মেরিকে তাড়া করেছিল বহু বহুবছর।
৪. একদিকে নিছক স্বামীর সঙ্গিনী, আরেকদিকে মা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, দুই পরস্পরবিরোধী অভিযোগের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
প্রথম সন্তান আইরিন জন্মানোর সময় প্রসব সরল হয়নি। মেরি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিজের অসুস্থতা এবং সদ্যোজাতের দেখাশোনা – তাঁর অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক শ্বশুরমশাই এসে বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ না করলে মেরির পক্ষে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে যেত।
তার পরেও সহকর্মীর মুখে শুনতে হয়েছিল – আইরিনের মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে সময় না দিয়ে তুমি বসে বসে রাদারফোর্ডের পেপার পড়ছ, এটা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু।
৫. পিয়ের আচমকা মারা যাওয়ার পর আইরিন এবং ইভ, দুই কন্যাসন্তানকে সিঙ্গল মাদার হিসেবে বড় করেন তিনি। ইভ তখন একেবারে দুধের শিশু। সঙ্গে চলতে থাকে নিজের গবেষণাও। মনে রাখা জরুরি, মাদাম কুরির গবেষণা ছিল ল্যাবরেটরি নির্ভর – এবং মানসিক শ্রমের পাশাপাশি শারীরিক শ্রমও সেখানে সমান জরুরি।
দুই মেয়েই পরবর্তী জীবনে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন। আইরিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। ইভ সুলেখিকা সাংবাদিক – এবং চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন। দুজনেই নিজের জীবনে মায়ের ভূমিকা বারবার স্মরণ করেছেন – ইভ কুরির লেখা মায়ের জীবনী তো এককথায় মাস্টারপিস। (সে বইয়ের চমৎকার ঝরঝরে বাংলা অনুবাদও হয়েছে। পড়ে দেখতে পারেন।)
অবশ্য যিনি নিজের বিয়ের গাউন এমন করে বানান, যাতে কিনা সেটি বিয়ের পর ল্যাবে পরে আসা যায়, তাঁর পক্ষে যে সব দিক গুছিয়ে রাখা সম্ভব হবে, সে নিয়ে অবাক হওয়ার কী আছে!!
৬. পিয়ের মারা যাওয়ার পর মেরি কুরি তাঁর পদে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। উইডো পেনশন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন – কিন্তু মেরি কুরি সহজ পথ কখনোই বাছেননি। নতুন পদে যোগ দেওয়ার পর মেরির প্রথম ক্লাস শুনতে ভিড় উপচে পড়ে। তার মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা তো ছিলই, সঙ্গে এসেছিলেন শিল্পী সাংবাদিক ও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও। কিন্তু সবাইকে অবাক করে, কোনোরকম শোক বা স্মৃতিচারণের দিকে না গিয়ে মেরি শুরু করেন – গত এক দশকে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলোর কথা যদি বলি, তাহলে মানতেই হবে, পদার্থ আর বিদ্যুতের ব্যাপারে আমাদের এত দিনকার ধারণাগুলো আমূল বদলে যাওয়ার পথে।… একদম আবেগহীন নো-ননসেন্স বিজ্ঞানের কথা।
৭. দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার যখন তিনি পান, ঠিক সেসময় এক জুনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঘিরে প্রবল হইচই বিতর্ক। মহিলা বিজ্ঞানীর ব্যক্তিজীবনের এমন চাটনি খবর – কে আর ছাড়বে!! বিতর্ক তখন এমনই তুঙ্গে, নোবেল কমিটি তাঁকে অনুরোধ করেন, পুরস্কার নিতে যাতে তিনি সশরীরে হাজির না হন। মেরি উত্তর দেন, পুরস্কারটা দেওয়া হচ্ছে তাঁর গবেষণাকে, যার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, অতএব পুরস্কার তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করবেন।
ব্যক্তিজীবন ও বিজ্ঞানের গবেষণা, ব্যক্তিগত আবেগ ও গবেষণাগারে অক্লান্ত অন্বেষণ – মেরি কুরি কখনোই দুটোকে মিশিয়ে ফেলেননি।
৮. বিশ্বযুদ্ধের সময় এক্স-রে মেশিন নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দৌড়াদৌড়ি করে যেভাবে যত প্রাণ তিনি বাঁচিয়েছিলেন, তার তুলনা কোনও প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর জীবনীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার। অনুমান করা হয়, তাঁর নিজের জীবনের শেষ হয় যে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায়, যা কিনা সংশয়াতীতভাবে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের কুফল, তার কারণ কোনও প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছাড়াই ওই যুদ্ধের সময় এক্স-রে মেশিন নিয়ে কাজ। কেননা যদিও তিনি রেডিয়াম নিয়ে সারাজীবন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন এবং তা থেকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও তাঁর হয়েছিল (ছানি, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি), তবু অল্পপরিমাণ রেডিয়াম থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয় রশ্মির অস্থিমজ্জার গভীরে গিয়ে ক্ষতিসাধন করার মতো ক্ষমতা থাকার কথা নয়।
৯. অনেকেই মাদাম কুরির জীবনের অন্তিম পর্যায় বা তাঁর সারাজীবনের বিভিন্ন অসুস্থতার কথা স্মরণ করে বলেন – তেজষ্ক্রিয়তার বিপদ বিষয়ে তিনি অসচেতন ও অসাবধান ছিলেন।
কিন্তু কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রাথমিক গবেষণার দিনগুলোর পরেই তিনি তেজষ্ক্রিয়তা যে ক্ষতিকারক, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন। এবং রেডিয়েশন প্রোটেকশন বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু সেসময় প্রতিরোধী ব্যবস্থা তেমন মজবুত ছিল না – সবধরনের সাবধানতা অবলম্বনের সুযোগ ছিল না, বিশেষত যেকথা আগেই বললাম, তাঁর বড় ক্ষতি হয় ওই যুদ্ধের দিনেই, সেখানে সাবধানতার সুযোগ কই!!
তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষতি নিয়ে তিনি এতখানিই সচেতন ছিলেন যে, হাতেকলমে গবেষণায় যেখানে এক্সপোজার ও ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি, সেখানে তিনি জুনিয়রদের না যেতে দিয়ে নিজেই এগোতেন।
১০. মৃত্যুর পরে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান বলেছিলেন – মাদাম কুরি বিজ্ঞান গবেষণার এক শহীদ। আজীবন গবেষণায় ডুবে থেকেও মানবকল্যাণ আর বিশ্বশান্তির জন্যে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। সবকিছুর শেষে, তিনি ছিলেন এক সহজসরল ঘরোয়া মানুষ এবং নারীত্বের সবচেয়ে উন্নত যা যা গুণ হতে পারে, সেই সমস্ত গুণের অধিকারী এক মহীয়সী নারী।
হ্যাঁ, ভালো অর্থে হোক বা মন্দ, প্রশংসার মুহূর্তে হোক বা নিন্দে, সব সময়েই কিংবদন্তী বিজ্ঞানী মেরি কুরির সঙ্গী ছিল তাঁর লিঙ্গপরিচয় – আমরণ সঙ্গী, এমনকি মৃত্যুর পরেও।
ঠিক নাকি ভুল, জাস্টিস নাকি ইনজাস্টিস, সেসব আপনিই ভাবুন।
শুধু জানিয়ে রাখা যাক, জীবদ্দশায় কিংবদন্তী হয়ে ওঠা মাদাম কুরি কিন্তু আমরণ ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যা হয়ে উঠতে পারেননি। অমন উচ্চমার্গের একাডেমিতে মেয়েদের স্থান!!! কী যে বলেন…
তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক বাদে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির প্রথম মহিলা সদস্য হন তাঁরই ছাত্রী। হয়ত ছাত্রীর প্রতি সম্মান শিক্ষকের প্রতিও ট্রিবিউট একরকম।