মা আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল,– বাবু ওঠ, যাবি না? স্যার ডাকছেন যে!
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। – তবে কি শুরু হয়ে গেল মা?
– না রে বাপু , আয় তোকে তৈরি করে দিই।
যেতে হবে সেই হিলোরা হাসপাতালে। সেখানে রেডিও আছে। গ্রামে কারেন্ট নেই। ভালভ সেট রেডিও। সেই রেডিও চলে মস্ত একটা ব্যাটারিতে। তার পেটের ভেতর একগাদা টর্চের ব্যাটারির মত ব্যাটারি।
সেই সেখানে আশ্বিনে শারদপ্রাতে… মহালয়া শুনব। বাবা থাকেন অন্য কোথাও। চাকরিস্থলে। আমি মা আর বাবা। মহালয়ার দিনই তর্পণ। তৃষ্ণার্ত পূর্বপুরুষেরা আসেন। মা বলে বাড়ির একজন মহালয়া শুনলেেও সেই তর্পণ হয়। তাই মহালয়া শুনতে আমি একলাই যাব।
হিমের পরশ লাগা বাতাস পাছে আমাকে ছুঁয়ে ফেলে, মা সাবধানে জড়িয়ে দিল বাবার একটা চাদর। জড়িয়ে পেছনে একটা গিঁট। চাদর না খুলে পড়ে যেন।
ইশকুলের স্যার বাইরে থেকে ফের শুধোলেন, – ও কি উঠেছে দিদিমণি? আমি তবে যাই।
স্যার যাবেন শেখ পাড়ায় মসজিদে। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। মসজিদে মাইক নেই। নিস্তব্ধ গ্রামীন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ইমামসাহেবের তীব্র সুরেলা গলা আর সদ্য ঝরে পড়া শিউলি গন্ধ।
মা আমাকে চিনতে পারে না কয়েকবছর। বাবা চলে যাবার পর মায়েরও সেরিব্রাল হল। আমাকে অসহায়ের মত বলে, – তুমি কি আমার দাদা? দেখ না, আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবুর বাবা একটু আসছি বলে কোথায় চলে গেল!
মাকে বলি না কারণ বলার মানেই হয় না। আমার সেই বড়মামাও গতবছর চলে গেছেন।
বাইরে কে যেন ডেকে বলল, – দিদিমণি, খোকাকে তুলে দ্যান ক্যানে! মহালয়া যে শুরু হল বলে!
আমি স্বপ্ন ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসি।
মাও তো ডাকল স্পষ্ট শুনলাম, – বাবু ওঠ! যাবি না?
ডাকল কে? আমার সেই মৌলবি স্যার কি এখনও দাঁড়িয়ে? আমাকে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে দেখা করাতে বড়ই তাড়া তাঁর।
থতমত গলায় বলি, – এই যে, যাই স্যার!
দৌড়ে মায়ের ঘরে যাই। ঠোঁট কাঁপছে। ঠোঁটের কাছে কান নিই। – আয়, তোকে তৈরি করে দিই। বলে আমার বোধহীন চলচ্ছক্তিহীন মা। সত্যিই বলে?
নিজেই তৈরি হই।
বাতাসে হিম নেই। আমাদেরও রেডিও নেই কোনও। তাতে কী? মোবাইল আছে তো!