ঘোষের মিষ্টির দোকানের ভেতরে দুই খান বেঞ্চি পাতা । মিষ্টি প্রদর্শনীর বাক্সের ওপরে একটা আলো জ্বলছে তার আভায় আড্ডা জমে ক্ষীর। এটা মুক্ত আড্ডা।
এখানে সর্বজ্যেষ্ঠ মানুষটি হলেন হীরকবাবু। ব্রহ্মতালু কেশহীন। দীর্ঘনাসা- কোটরগত উজ্জ্বল দুটি চোখ– গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি। হাতে ও হেনরি তামাকের প্যাকেট আর সবুজ প্যাকেটে সিগারেটের মিহি কাগজ। প্রায়শঃই স্বহস্তরচিত সিগারেট একটা হলুদ রঙের লাইটার দিয়ে ধরাচ্ছেন। নানা বিষয়েই ওনার বক্তব্য থাকে। বাকিদের পরিচয় যথাস্থানে উন্মোচিত হবে।
প্রবল ভক্ত থেকে তীব্র অতিবাম নারী পুরুষ সবাই এই আড্ডায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। এমত সময়ে কপালে তিলক কেটে সদ্য ধার্মিক কিন্তু প্রাক্তন বামপন্থী নিতাইবাবু সাইকেলে করে আড্ডা সরগরম করতে হাজির হলেন। সাইকেল থেকে নেমেই জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে ঘোষের পো’কে একটা বিনা চিনি কালো চায়ের আদেশ করে’ বেঞ্চির শূণ্যস্থান পূরণ করলেন।
পরম ভক্ত ঝুলনকৃষ্ণ সাড়া দিলেন “জয় গুরু। ধর্মের অভাবে আজ দেশের নারীজাতির এই দুরবস্থা। পাড়ায় পাড়ায় ধর্ষণ– নারী হত্যা উফ্ফ্ফ্ফ্ খবরের কাগজ খুললে গা বমি বমি করে”
নিতাইবাবু বেঞ্চিতে পা গুটিয়ে বসে বললেন “একবার রাম রাজত্ব এলে সব বন্ধ হয়ে যাবে। টোটাল স্টপ”।
অতিবাম গৌরহরি নাসিকায় একটা খুর্খুর শব্দ করে বললেন “রাম? হুঁঃ”
কথার পৃষ্ঠে কথা ওঠে। আবড়োখাবড়ো চুল কাটা ভূমিকাদেবী হাতের সিগারেটে টান দিয়ে বললেন “রাবিশ ,যতসব পুরষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা….”
গলায় কন্ঠি পরা কপালে তিলক কাটা পরম ভক্ত শ্রীমতি মন্দাক্রান্তা দেবী বললেন “রাধে মাধব, রাধে মাধব, আজ আমরা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা ত্যাগ করে বিলাঈতি কায়দায় ধোঁয়া ফুঁকছি আর পোশাকের কি ছিরি মাগো ম্মাআ ধর্ষণ হবে না তো কী? সত্যি সত্যিই রামরাজত্বই ভালো ছিলো ….” বলে পিচিক করে নিতাইবাবুর কেয়ারি করা চুলের ওপর দিয়ে পরম কৌশলে পানের অবশিষ্টাংশ উড়িয়ে দিলেন।
নিতাইবাবু সযত্নে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে মাথার নিরাপত্তা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
হীরক তখন একটি জনসনের কান খুঁচুনী সাইজের সিগারেট বানিয়ে হলুদ লাইটার দিয়ে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন “ফুসসসসসস”
গৌরহরি এই শব্দটা শুনে বলে “মামু কিছু বলছো না?”
হীরকবাবু নীল ধোঁয়া অন্তরিভূত করে বললেন “সীতার বাবা কে ছিলেন গো?”
মহম্মদ মিরাজুল একটুও না ভেবে উত্তর দিলো “জনক রাজা”
ভূমিকাদেবীর আবার চুলে হাইলাইট আর কবিতা করা মিরাজুলের প্রতি একটু ইয়ে আছে। উনি মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখকিয়ে হেসে বললেন “মামু হেইডা আপনে কি জিগাইলেন? হক্কলেই জানে জনক রাজা…”
হীরকবাবু বাধা দিয়ে বললেন “সীতা একটি পরিত্যক্তা কন্যাশিশু …কাশ্মিরি রামায়ণে কথিত আছে সীতামাইয়া রাবণ এবং মন্দোদরীর সন্তান … হয়তো কন্যা বলেই পরিত্যক্তা হয়েছিল.. হয়তো আত্মজা বলেই রাবণ অপহরণ করেও ধর্ষণ করেনি…” হীরকবাবু নিভন্ত ঐ সিগারেটে পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে বলতে থাকেন “রামের সঙ্গে সীতার বিবাহ ব্যাপারটাও কিঞ্চিৎ সন্দেহজনক …”
নিতাই বলে “সে আবার কি কথা? হরধনু ভঙ্গ হলো ….মামু তুমি কি সেকু হয়ে গেলে নাকি?”
হীরকবাবু ঠান্ডা মাথায় চায়ের ঠান্ডা অবশিষ্টাংশে সিগারেটের শেষ পর্ব নিমজ্জিত এবং পিষ্ট করে বলেন “মহাভারত মানো? যেটায় ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রচনা করেছিলেন? ওটা দ্বাপর যুগের ঘটনা। দ্বাপর যুগে ঋষি শ্বেতকেতু বিবাহ প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। তার আগেই অর্থাৎ বহু কাল আগে ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আবির্ভূত হন। অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের আমলে বিবাহ চালু হয়নি। আমাদের এই দুটো পৌরাণিক উপাখ্যানে যদি বিশ্বাস রাখতে হয় তাহলে কোনটাকে বিশ্বাস করবো সেটা বিচার্য তো বটেই। তাই না?”
গৌরহরি শ্বেতকেতুর ব্যাপারটা জানে না, ও বলে “মামু শ্বেতকেতু কে?”
হীরকমামা একটু উদাস হয়ে বাতাসে ভেসে ওঠা গন্ধ শোঁকেন “ও ঘোষবাবু আজকে কি ফুলকপির সিঙাড়া নাকি?”
মিরাজুল হাঁক পাড়ে “ও চাচা…এক দুই তিন…..মোট সাতখান সিঙাড়া দ্যাও দেহি….”
মামু এক কামড় বসিয়ে বলেন “আহা অমৃত…তবে বড্ড গরম ..! তোমরা আরুণির নাম জানো? গুরুর আদেশে যে ছাত্রটা ভাঙা আলের ওপর শুয়ে জলের স্রোত থেকে গুরুর ফসল বাঁচিয়েছিলো?”
সকলেই ঘাড় নেড়ে জানায় সকলেই শুনেছে।
“এই আল ভেদ করে উঠে আসার কারণে গুরু আয়াধধৌম ওনার নামকরণ করেন উদ্দালক। এই উদ্দালকের তথাকথিত সন্তান হচ্ছে শ্বেতকেতু। তখন নারী ছিলো গাভীর সমান। যে কোনও পুরুষ এসে নারীকে ভোগ করে যেতে পারতো”
গৌরহরির মতো লিবারেলও এই কথাটা শুনে মন্দাক্রান্তার মতোই চমকে ওঠে।
“তাই উদ্দালকের এক কামার্ত শিষ্যের ঔরসে শ্বেতকেতুর জন্ম হয়। এরপর একদিন এক ব্রাহ্মণ শ্বেতকেতু আর তার পিতা উদ্দালকের সামনে দিয়েই তার অনিচ্ছুক মা’কে ভোগ করতে নিয়ে যায়।”
মন্দাক্রান্তা, ভূমিকা এবং তৎসহ সমবেত সক্কলে মায় মিষ্টির দোকানের ঘোষবাবু পর্যন্ত আঁৎকে ওঠেন।
মামু নির্বিকার বলে যেতে থাকেন “শ্বেতকেতু সর্ব বেদ শিক্ষান্তে বিশিষ্ট ঋষি হওয়ার পর বিবাহ প্রথা চালু করেন। পরদারগমন অথবা পরপুরুষ গমনে সমান শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়”
ভূমিকাদেবী খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে বলেন “চমৎকার ব্যবস্থা। নারী পুরুষের সমান বিচার”
মামু নতুন করে একটি সূক্ষ্ম সিগারেট বানাতে বানাতে বলেন “আমি তো শুধুমাত্র হিন্দু পুরাণ নিয়ে আলোচনা করছি। তবে সব ধর্মেই নারী কেবলমাত্র ভোগের বস্তু এটা মোটামুটি স্বীকৃত। কেননা নারীদের শারীরিক শক্তি কম আর নারীকে শাস্তি দেওয়ার সহজতম উপায় তাকে গর্ভবতী করে দেওয়া। তাতে পৌরুষের গর্বও বজায় থাকে – সুখও হয় আবার নারীকে অপমান করাও হয়। তবে ভূমিকা, শোনো নারীদের এই সমতা কিন্তু পৌরাণিক যুগেই ফের হরণ করা হয়”
নিতাইবাবু বলে ওঠেন “সেটা আবার কি ঘটনা?”
“সেটা মানে … একটু শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে যায়– বলবো?” সবাইকারই উদগ্রীব মুখ দেখে মামু পুনরায় আরম্ভ করেন “সে যুগটা ছিলো সমস্ত সামাজিক রীতিনীতির বাইরে– আসলে ধর্ম তো কোনও আগল মানে না– তাই না? ঋষি উতিথ্যর স্ত্রী মমতা যখন গর্ভবতী তখন দেবপুরোহিত বৃহস্পতি যিনি আবার উতিথ্যর আপন ভাই – মমতাকে সম্ভোগেচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং মমতার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভোগ করেন। এটাই পুরাণে লেখা আছে। গর্ভস্থ দীর্ঘতমা (দীর্ঘ লম্বা, তমা রাত্রি) পায়ে করে বৃহস্পতির বীর্য ঠেলে বার করে দ্যান ফলতঃ বৃহস্পতিবাবু সম্পূর্ণ সুখ পান না। এর ফলে বৃহস্পতির অভিশাপে দীর্ঘতমা জন্মান্ধ হয়ে জন্ম নেন কিন্তু মমতার আশীর্বাদে মাতৃগর্ভ থেকেই সব শাস্ত্রবিশারদ হয়ে জন্মান। ওনার সঙ্গে প্রদ্বেষী নাম্নী এক বিদূষী মহিলার বিয়ে হয়। কিন্তু দীর্ঘতমা গোধর্ম পালন করতেন … তাই প্রদ্বেষী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হ’ন”
মিরাজুল মুখব্যাদান করে বলে “গোধর্ম? সেটা কি? হাম্বা হাম্বা করে ডাকতো?”
ভূমিকা একা নয় সকলেই সোৎসাহে প্রশ্ন করে “গোধর্ম কি জিনিস মামু?”
কেবলমাত্র মন্দাক্রান্তা দেবী বিড়বিড় করতে থাকেন “দেবগুরু বৃহস্পতি ধর্ষণ করেন? বৃহস্পতি? বৃহস …..” মন্দাক্রান্তা দেবী আর ভাষা খুঁজে পান না।
মামু নতুন সিগারেট মুখে ঠেকাতেই গৌরহরি বাবু একটা প্রজ্জ্বলিত দিয়াশলাই কাঠি সিগারেটের অগ্রে ধারণ করেন।
মামু একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে বলেন “ইয়ে মানে গোধর্ম মানে হলো যত্রতত্র প্রকাশ্যে যৌনক্রিয়া করা। শুধু বৃহস্পতি কেন দেবরাজ ইন্দ্র থেকে কেউই এই রোগ থেকে মুক্ত ছিলেন না”
ভূমিকাদেবী স্বগতোক্তি করেন “এক্সহিবিশনিজম অ্যাট দ্যাট এরা ..ও মাই গশ”
ঝুলনকৃষ্ণ কেবল বলতে পারেন “খাইসে”
হীরকবাবু বলে চলেন “প্রদ্বেষী বলে তুমি অন্ধ- আমি সংসার চালাতে কাহিল হয়ে পড়ছি তার ওপর তোমার এই ঢংয়ের গোধর্ম। তুমি বিদেয় হও। এবারে দীর্ঘতমা ভয়ানক রেগে মেগে বলে আজ থেকে নারী বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হবে এবং স্বামীর মৃত্যুর পরেও ঐ স্বামীর কথা ভেবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হবে। ব্যস স্বাধীনতা হরণ!”
ভূমিকাদেবী বলেন “এই ধর্ম এই বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে– আবার মানুষ যেমন খুশি মেয়েদের অপমান করবে? আমরা আবার ফিরে যাবো সেই প্রাচীনতম অসভ্যতার যুগে?”
ঘোষবাবু মামুর জন্য বিনা অনুরোধে এককাপ চা নিয়ে আসে।
চায়ে চুমুক দিয়ে হীরকমামা বলেন “না না, প্রাচীনতম সভ্যতা হলো মেসোপটেমিয়া প্রায় খৃষ্টপূর্ব আট হাজার বছরের পুরোনো, তারপর হরপ্পা, তারপর রোমান সিরিয়ান গ্রীস ইঙ্কা মায়া অ্যাজটেক মিশরীয়– এরা সব আগে পরে আছে। আর ভারতীয় সভ্যতা? সেটা আনুমানিক তিনশো খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়। ধর্ম চিরকালই নারীদের ব্যবহার করেছে। এছাড়াও জৈব প্রবৃত্তির ব্যাপারটাও আছে শিপাঞ্জি গোত্রের কিছু প্রাণীর ভেতরে ধর্ষণের তথ্য পাওয়া যায়”
এতক্ষণ নীরব থাকা অভ্রদিতা বলে “তাহলে কি শিক্ষা বোধ রুচি তৈরি করে পাশবিক প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসা আর …”
ওর পাশে মুঠোফোনে সদাব্যস্ত তমোনাশ বলে “আর ধর্মের সঠিক ব্যবহার – প্রাচীন ধর্মভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা …তাই না মামু?”
হীরকমামা উত্তর না দিয়ে সিগারেটের লাল অগ্নিবিন্দু জ্বেলে একটু কুঁজো ভঙ্গিতে অন্ধকার ভেদ করে গৃহাভিমুখী হলেন।