প্রজ্ঞাব্রত গুপ্তের কথা।
অনুলিখনঃ দীপঙ্কর
ডাক্তার প্রজ্ঞাব্রত গুপ্ত। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী।আমাদের গর্ব।এখন আমেরিকার সিনসিনিটিতে একটা ক্লিনিকের অধিকর্তা। ক্লিনিকের নাম অ্যাডভান্সড পেইন ট্রিটমেন্ট সেন্টার এ্যান্ড অট্রিমেড ক্লিনিক ফর রিসার্চ। বর্তমানে মূলতঃ স্পাইনের বা নার্ভের ব্যথা নিয়ে বহু নতুন গবেষণায় ব্যস্ত। তাঁর একটি টেলিফোনিক সাক্ষাৎকার। দীপঙ্করের সঙ্গে।
প্রশ্ন|| আপনার চিকিৎসার মূল লক্ষ্য কী?
প্রজ্ঞাব্রত|| আমি মূলতঃ ব্যথা নিয়ে কাজ করি। ব্যথা মানে স্পাইনাল ব্যথা, মাথায় ব্যথা। অথবা ট্রাইজেমিনাল নিউর্যালজিয়া, ক্যানসার বা রেডিওথেরাপির জন্য নার্ভ নষ্ট হলে যে ব্যথা হয়…কিম্বা বিভিন্ন মেটাবলিক ডিজিজের…..ডায়াবেটিস রোগের নার্ভের ব্যথা…যখন সার্জিক্যাল চিকিৎসা সম্ভব নয় অথবা অপারেশনের পরেও ব্যথা হচ্ছে …অথবা যখন রোগী অপারেশন চাইছে না।
প্রশ্ন|| আর কিছু?
প্রজ্ঞা|| আর কিছু মানে? আচ্ছা, হ্যাঁ….এই বিষয়ে এখানে গবেষণাও চলছে।
প্রশ্ন|| চিকিৎসার সঙ্গে গবেষণা?
প্রজ্ঞাব্রত|| হ্যাঁ। আসলে আমি যে কাজটা করছি….এটা একটা নতুন বিষয়। যদি আমরা সবাই এটাকে এগিয়ে না নিয়ে যাই….তাহলে বিজ্ঞান এগোবে কি করে?
প্রশ্ন|| আপনি বলছেন, এটা একটা নতুন দিগন্ত। যদি এই বিষয়ে কিছু বলেন… আমাদের দেশে এটা ঠিক প্রচলিত নয়… অনেক মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন….তাহলে তাঁদের একটু উপকার হয়…..তাহলে প্রশ্নাবলী শুরু করি….
প্রজ্ঞাব্রত|| হ্যাঁ,শুরু হোক।
প্রশ্ন|| আপনার এই ক্লিনিকের চিকিৎসা পদ্ধতিটা যদি একটু বলেন…
প্রজ্ঞাব্রত|| হ্যাঁ অবশ্যই।এটা একটা সম্পুর্ণ সেট আপ….মানে মাল্টিডিসিপ্লিনারি ইউনিট। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা হয়। ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে প্রথমে বিহেভিয়ার্যাল থেরাপিস্ট দেখেন। তিনি এই রোগটার সম্বন্ধে এবং রোগীর মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেবেন। তারপর এই চিকিৎসার আউটকাম মানে ফলাফল কী হবে, সেটা বোঝাবেন। এরপর হবে এটার ইন্টারভেনশন অর্থাৎ চিকিৎসা।তারপর আসবে ফিজিওথেরাপি বা বিশেষ কিছু ব্যায়াম।
প্রশ্ন|| এটা বলতে বলতে এখানে কী বোঝাচ্ছে? যদি রোগের মূল উৎসটা নিয়ে একটু আলোচনা হয়, তাহলে বোধহয় কী করা হচ্ছে এবং কেন, সেটা বুঝতে সুবিধে হবে।
প্রজ্ঞাব্রত|| স্পাইনে ব্যথার মূল কারণ হলো ভার্টিব্রাল ডিস্কের ডিজেনারেশন। মেরুদণ্ডের ক্ষয়। ব্যথা সাধারণতঃ কম বয়স থেকেই হয় …কম মানে এখনকার যুগে পঞ্চাশ বছর বয়সটাকেই কম বয়স ধরা যায়। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পরে অন্য নানা ধরনের ব্যথা খুব বেশী দেখা যায়।
এতে মানে সায়াটিকার ব্যথায় দুটো ভার্টিব্রার মধ্যে দিয়ে স্পাইনাল কর্ড থেকে আসা সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে।
এছাড়াও রয়েছে হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা কাঁধে ব্যথা।
অথবা ক্যানসারে রেডিয়েশনের পর কিছু নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বা হার্পিস যেহেতু নার্ভের চিকেন পক্স তাই অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত নার্ভে চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়, এই সব ক্ষেত্রে আমাদের ইন্টারভেনশন খুব কাজে দেয়।
ক্যানসারের বিভিন্ন অবস্থায় যখন বিভিন্ন নার্ভের ক্ষতি হয় তখন ভয়ানক যন্ত্রণা হয়, বিশেষতঃ ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে। দেখা গেছে ব্যথাটা কমে গেলে রোগীর বাঁচার ইচ্ছে এবং আয়ু, দুটোই বাড়ে। সেখানেই এই চিকিৎসার সাফল্য।
প্রশ্ন|| খুব ভালো খবর।এই চিকিৎসার ফলাফল কতদিন থাকে?
প্রজ্ঞাব্রত|| কমপক্ষে দু বছর। তবে নানা ধরণের চিকিৎসা করা হয়, প্রত্যেকটার ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা ফলাফল হয়। কারো কারো এর থেকে বেশী বা চিরস্থায়ী সেরে যেতেও পারে। এবং এই পদ্ধতিতে যেহেতু কোনও সাইড এফেক্ট নেই, তাই কয়েক বার করলেও ক্ষতি নেই।
প্রশ্ন|| এবার যদি আর একটু বিস্তারিত করে রোগটার চিকিৎসা এবং শরীরের কোন জায়গায় হচ্ছে, সেটা আমাদের জানান…..
প্রজ্ঞাব্রত|| আসলে এই ধরণের, মানে সায়াটিকা, বা মেরুদণ্ডের ব্যথার উৎস হচ্ছে ফ্যাসেট জয়েন্ট বা ডিস্ক মানে ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক।….আর হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসা একটু অন্য রকম। ওটা পরে আলোচনা হবে। এখন মেরুদন্ড নিয়ে কথা বলা যাক। আমরা বিভিন্ন পরীক্ষা এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করে কোন নার্ভ বা কোন ফ্যাসেট জয়েন্ট এই ব্যথার জন্য দায়ী, সেটা বার করি।
প্রশ্ন|| তারপর?
প্রজ্ঞাব্রত|| প্রথমে হাঁটু নিয়ে কথা বলা যাক। সব ধরনের ব্যথাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। প্রতিটি জয়েন্ট নষ্ট হয়ে যায়। নার্ভের ক্ষতি হয়। এই সব ক্ষেত্রে এই ব্যথার চিকিৎসা এবং গবেষণা খুব জরুরি। হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট হয়ে যায় আর প্রচুর ব্যথা হয়।আমাদের কাজ রোগীকে আবার স্যোশালি প্রোডাক্টিভ জীবনে ফেরত পাঠানো। অপারেশন করা যাবে না অথবা অপারেশন হয়েও ব্যথা কমে নি এ দুটোই মূল চিকিৎসাধীন মূল লক্ষ্য। তবে আরও অনেক সময় এই চিকিৎসা অন্যক্ষেত্রে করা হয়।
হাঁটুর ক্ষেত্রে প্রথমে একটা ভিসকাস মেটেরিয়াল ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এতে কার্টিলেজটা হাইড্রেটেড থাকে মানে জল বেশী ধরে’ রাখতে পারে, তাতে ব্যথা কম থাকে। এরপর নার্ভ স্টিমুলেশন দেওয়া হয়। এছাড়া একটা প্ল্যান্ট অ্যালকালয়েড ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। এটার প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষা হয়ে গেছে।
প্রশ্ন|| কি ধরণের অ্যালকালয়েড?
প্রজ্ঞাব্রত|| এটা একটা ক্যাকটাসের থেকে পাওয়া যায়। এটা ক্যাপসয়েসিন জাতীয় ওষুধ, নাম হলো রেজিনিফেরাটক্সিন।ঝালের দিক দিয়ে ক্যাপসয়েসিনের থেকে আক্ষরিক অর্থেই এক হাজার গুণ বেশী ঝাল। এটাই পৃথিবীর সব থেকে ঝাল কেমিক্যাল। এক থেকে দু গ্রাম খেলেই মৃত্যু অনিবার্য। এটার একটা নির্দিষ্ট ডাইল্যুশনে ইঞ্জেকশন দিয়ে আমরা ব্যথাবাহী নার্ভগুলো নষ্ট করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া এর সঙ্গে ভাস্টাস মেডিয়ালিস, স্যাফেনাস, ফিমোরাল, বা সায়াটিক নার্ভ স্টিমুলেশন দিলে খুব ভালো উপকার পাওয়া যায়। নার্ভ স্টিমুলেশন মানে প্রোপ্রিওসেপ্টর নার্ভের, মানে ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার নার্ভে ইলেক্ট্রিক্যাল স্টিমুলেশন।
ইনট্র্যাক্টেবল শোলডার পেইনের ক্ষেত্রে সুপ্রাস্ক্যাপুলারিস বা অ্যাক্সিলারি নার্ভ স্টিমুলেশন দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রশ্ন|| শুনলাম রেজিনিফেরাটক্সিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার যে সাতটা সেন্টারকে বাছাই করা হয়েছে তার মধ্যে প্রজ্ঞাব্রতের ক্লিনিক আছে?
প্রজ্ঞাব্রত|| [প্রজ্ঞাব্রত সহাস্যে] আরে এখনও ট্রায়াল শুরুই হয়নি।
প্রশ্ন|| এই মুহূর্তে স্পাইনের কি চিকিৎসা হচ্ছে?
প্রজ্ঞাব্রত|| আমাদের স্পাইনের প্রথম রোগ হচ্ছে ফ্যাসেট জয়েন্ট ডিজেনারেশন, তারপর ডিস্ক প্রোল্যাপ্স। ডিজেনারেশন হলে ঐখান থেকে বেরিয়ে আসা নার্ভে চাপ পড়ে।
এখন জাপানের সঙ্গে কোলাবরেশনে একটা গবেষণা চলছে।আমরা ডিস্কে একটা এঞ্জাইম ইঞ্জেক্ট করছি। প্রোটিয়াস ভাল্গারিস ব্যাক্টেরিয়া থেকে তৈরি একটা প্রোটিওলাইটিক এঞ্জাইম, নাম কন্ডোলিয়াস। এটা নিজের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা কার্টিলেজ মানে ডিস্কটার প্রোটিন নষ্ট করে, ফলে ডিস্ক ছোটো হয়ে আসে। এটা এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে।
এছাড়া আমরা রেডিওফ্রিকোয়েন্সি থেকে তৈরি উত্তাপ দিয়ে অ্যাব্লাশন (রেডিওফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নার্ভটাকে ধ্বংস করা হচ্ছে)।এটাকে থার্মাল অ্যাব্লাশন বলা হয়।
প্রশ্ন|| আর সায়াটিকা?
প্রজ্ঞাব্রত|| ঐ কন্ডোলিয়াস, প্রোটিয়াস ভাল্গারিস থেকে উৎপন্ন।এটা ডিস্কের কার্টিলেজের প্রোটিন ভাঙে। এতে সায়াটিক নার্ভ ড্যামেজে খুব উপকার হয়।
প্রশ্ন|| আর ক্যানসারে?
প্রজ্ঞাব্রত|| ঐ যে প্রথমে বললাম মর্ফিন বা হাইড্রো মর্ফোন।স্পাইনাল ফ্লুইডের ভেতরে দেওয়া হয়। খুব অল্প ডোজেই খুব ভালো রেজাল্ট হয়। আর পেরিফেরাল নার্ভের ক্ষেত্রে একটা স্নেইল টক্সিন (অনুলেখকের সংযোজন সমুদ্র শামুকের বিষ)। এরা শিকারী সামুদ্রিক শামুক। এদের জেনাস হলো কোনাস।এদের বিষ অত্যন্ত জটিল। এটাও উচ্চ ধরনের প্রোটিন ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে, আসলে এরা নিউরোপ্যারালাইসিস করে শিকারকে প্যারালাইটিক করে দিয়ে শিকার করে। এটাকে কোনোপেপটাইড বলা যায়। এর ওমেগা সি কোনোটক্সিন জিকোনাটাইড ব্যবহার করা হয়। বিশেষতঃ হার্পিসের পরে ক্ষতিগ্রস্ত নার্ভে, ডায়াবেটিস থেকে পায়ে জ্বালা, যেগুলো সারানোই যায় না, সেখানে এটা ব্যবহার হয়।
প্রশ্ন|| ব্যথার ওষুধ সম্বন্ধে…..
প্রজ্ঞাব্রত|| হ্যাঁ।ব্যবহার করা যায়। তবে অতো দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে সাইড এফেক্ট হবে। এছাড়া পেটের আলসার হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই।
আর হ্যাঁ, যেগুলো অপারেশন করতে দেরী আছে বা অপারেশন সফল হওয়ার সুযোগ কম, বা অন্য অপারেশন করতে গিয়ে নার্ভের ক্ষতি হয়েছে, অথবা ক্যানসারে যখন নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মেরুদণ্ডের ক্ষতি হয়, তখন এই পদ্ধতিতে খুব উপকার পাওয়া যায়।রোগী আবার জীবনের রাস্তায় হাঁটতে পারে।
দীপঙ্কর|| ধন্যবাদ প্রজ্ঞাব্রত। আপনার কাজের অনেক দেরি করে দিলাম।
প্রজ্ঞাব্রত|| আপনাকেও ধন্যবাদ,ধন্যবাদ ডক্টরস ডায়ালগের বন্ধুদের এবং প্রত্যেক পাঠককে। শেষ কথা হলো সমস্ত ব্যথার মধ্যেও আশার আলো জ্বলছে। নতুন নতুন কাজ হচ্ছে এবং অপারেশনের থেকে কম দিন হাসপাতালে থেকে, কম খরচে প্রতিটি ব্যথা ধরে ধরে চিকিৎসা খোঁজা হচ্ছে। আশা ছাড়বেন না।স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই হবে। আমরা আছি পথ দেখাতে।ভালো থাকুন। সবাই।