ড্রাইভার জগুর সাজগোজ আজ অন্যরকম। সাদা ধবধপে প্যান্ট শার্ট। কপালে তিলকের ফোঁটা।
চাবি ঘুরিয়ে ষ্টার্ট দিতেই গাড়ীটা গরগর করে উঠল। ভাবলাম, যাক্ আজকের দিনটা গাড়ির মতিগতি ভালো। কিন্তু কোথায় কি? গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে গীয়ারে পড়তেই সব ফুস্। ইঞ্জিন বন্ধ। গাড়ি সেই আগের মতই। নট-নড়নচড়ন।
‘যাকগে, চল রিক্সায় যাই। বেশী দূর না।’
রিক্সায় মণিমামার পাশে বাকী ছ’-ইঞ্চি জায়গায় অর্ধেক বসে, অর্ধেক ঝুলতে ঝুলতে চ্যাটার্জীহাট পৌঁছে গেলাম। গলি গলি তস্য গলি। রাস্তার উপরে দোকান- বাজার। সেখানেই একটা একতলা বাড়ির পিছনের দিকে মামার ছোট্ট চেম্বার। বাড়িটার সামনে গোখাদ্যের দোকান। তার পাশ দিয়ে ঢুকতে হয়। ঢোকার মুখে এক খনখনে বুড়ি কয়েক গোছা শাক আর হাঁসের ডিম নিয়ে বসে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
বাড়িটায় প্রথমে পড়ে এক ভেটেরেনারি ডাক্তারের চেম্বার। সেখানে বেশ ভীড়। আর মণিমামার ঘর প্রায় ফাঁকা। রুগী বসার জায়গায় একজন মাত্র বসে আছে।
“ভজুয়া আজ আসে নি বুঝলি। সামন্ত বাইরে নাম লিখছে। তুই ভেতরে থাক।”
মণিমামা ইঞ্জেকশন বা ড্রেসিং করার সময় ভজুয়া পেশেন্টকে চেপে ধরে। কোন রোগীর সাধ্যি ভজুয়ার ছাতু খাওয়া পেটাই হাত ছাড়িয়ে বেরোয়! সেই ভজুয়া আজ ছুটিতে। আমি কি ওর কাজ পারব? তবে ভাগ্যিস রোগী খুব বেশী নেই।
যে লোকটা বসে আছে সে বেশ লিকপিকে। সঙ্গে একজন মাঝারি চেহারার মহিলা। মামা চেম্বারে জাঁকিয়ে বসল। প্যাচপেচে গরম। মাথার উপর মান্ধাতার আমলের ডিসি ফ্যান ঠেলাগাড়ির গতিতে কড় কড় আওয়াজ করে ঘুরছে। মণিমামা প্রথমেই ঘামে ভেজা জামাটা খুলে চেয়ারের হাতলে রাখে দিল। আর স্যান্ডো গেঞ্জির নীচে ভুঁড়িটা পাঁচ নম্বর ফুটবলের মত জেগে রইল।
টেবিলের উপরে রাখা হাতপাখাটা টেনে নিয়ে হাওয়া খেতে খেতে বলল, ‘চা নিয়ে আয়।’
বারোয়ারি চা-ওলা মন্টু কোত্থেকে চায়ের কেটলি আর জলের বোতল নিয়ে হাজির।
চায়ে চুমুক দিয়ে মামা মুখ ব্যাজার করে বলল, ‘কি হয়েছ্যা।’
‘পাতলা পায়খানা।’
“কতবার?”
“যতবার গেছি ততবার।”
“মানে?”
“মানে বাথরুমে গেলেই হয়। কাপড়চোপড়ে হয় না।”
“কিরকম?”
“কালকে সকালে হলুদ হলুদ ছিল। বিকেলে সবুজ সবুজ। আজ সকালে কচি পাতার রং।”
‘থামো। যেন ছবি আঁকছে! আর কি হয়?’
‘মাথা ঘোরে।’
‘কোন দিকে?’
‘তা তো খেয়াল করি নি!’
‘নিজের মাথা! খেয়াল কর নি মানে? তাহলে চিকিৎসাটা হবে কি করে?’
এতক্ষণে মণিমামা রোগীকে চেপে ধরেছে- যেমন গোয়েন্দা অপরাধীকে অথবা বাঘ হরিণকে ধরে। লাল, সবুজ, নীল রঙের পেন দিয়ে খসখস করে তিন রঙা প্রেসক্রিপশন করা হয়ে গেল। শব্দগুলো যেন আরশোলার পায়ে রঙ লাগিয়ে কাগজের উপর ছেড়ে দিয়ে আঁকা। যার একটারও অর্থ উদ্ধার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এই কাজ পারে শুধু ভজুয়া। কি এক অদ্ভুত কায়দায় সে মণিমামার প্রেসক্রিপশনের অর্থ উদ্ধার করে রোগীদের বুঝিয়ে বলে দেয়! রোগীরাও সব শুনে সুড়সুড় করে গুটিগুটি পায় ওষুধের দোকানের দিতে রওনা দেয়। প্রেসক্রিপশন বুঝতে তাকে মামার কাছে ফেরত যেতে হয় না।
আজকে বার বার আমাকে মণিমামাকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে- প্রেসক্রিপশনে কি লেখা আছে ।
‘তোর দ্বারা এটা হবে না। তুই বাইরে বোস। রুগীর নাম লেখ।’
বুঝতে পারছি এ কাজ আমার দ্বারা হবে না। তবু মনিমামা মুখের উপর কাঠকাঠ করে যেভাবে বলল, তাতে মনটা তেতো হয়ে গেল। হোষ্টেল থেকে খাওয়ার লোভে মামার বাড়ি না এলেই ভাল হত।
বাইরে রিসেপশনে বসে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি। এমন সময় দেখি একটা অল্পবয়স্ক বৌ কোলে দুটো খরগোশ নিয়ে মনিমামার চেম্বারে ঢুকে পড়ল। ‘আমার ধনারে একটু দেখে দ্যাও দেকি।’
‘আরে এখানে না। পাশের ঘরে যাও। এখানে খরগোশ দেখা হয় না।’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ি গ্যাচে? খরগোশ দুটোরে পাশের ঘরে দেকিয়ে নিচি। ও ধনা, ইদিকে আয়।’
ধনা এল। নাক থেকে সিকনি ঝরা হাড় জিরজিরে এক বালক। স্টেথোস্কোপের দরকার হবে না। রিসেপশনে বসেই আমি তার নিঃশ্বাসের সাঁইসাঁই শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বৌটার কাছ থেকে ফী চাইতে যাব, ওমনি ভেতর থেকে বাজখাঁই গলা ভেসে এল, ‘ফী নিতে হবে না। ভেতরে পাঠিয়ে দে।’
পনের মিনিট বাদে একগাদা ওষুধ, প্রোটিন পাউডার আর একখানা হিব্রুভাষায় লেখায় দলিলের মত প্রেসক্রিপশন হাতে মা-ছেলে হাসি-হাসি মুখে আমার সামনে এসে হাজির হতে আমার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। ফী দিতে না হলে দাঁতে ব্যথার রুগীরও মুখে হাসি বেরোয়। কিন্তু এরপরের ঝামেলাটা তো আমাকেই পোয়াতে হবে। ওই দাঁতভাঙা প্রেসক্রিপশনের অর্থ উদ্ধার করতে হবে। এভাবে রোজ রোজ কিভাবে চলে কে জানে!
পনেরো মিনিট লাগল সেই প্রেসক্রিপশনের লেখার অর্থ উদ্ধার করে রোগীকে বোঝাতে আর ওষুধের দোকানে পাঠাতে।
(চলবে)