শুরুর কথা
টমাস পিকেটি (প্রখ্যাত ফরাসী অর্থনীতিবিদ) তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত A Brief History of Equality (২০২২) পুস্তকে বলেছেন – “সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ছাড়া এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে পশ্চিমের সম্পত্তিভোগী শ্রেণী আদৌ ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ এবং প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা গ্রহণ করতো কিনা, এ কথাও বলা সম্ভব নয় যে ‘ডিকলোনাইজেশন’ এবং সিভিল রাইটসকে মেনে নিত কিনা।” (পৃঃ ১৪)
২০২৩-এ এসে স্বাস্থ্যের সব আনাচে-কানাচে সর্বগ্রাসী কর্পোরেট থাবার অনুপ্রবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথাগুলোর তাৎপর্য কি? তাৎপর্য একটিই – তা হল এমন একটা সামাজিক পরিবেশের উদ্ভব যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত উদ্বেগের পরিবর্তে ‘সামাজিক সুরক্ষা’-র বাতাবরণে সুরক্ষিত বোধ করতে পারে। আর্ত মানুষের সবরকমের বিপন্নতাকে কোন না কোন রোগের নাম দিয়ে, ওষুধ এবং চিকিৎসার আওতায় না ফেলে, সমগ্র জীবনকে ‘মেডিক্যালাইজেশন’-এর জালে না বেঁধে জীবনকে এর স্বাভাবিক ছন্দে রাখার ভাবনার পরিসর থাকে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণে আসতে পারে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মেডিসিনের পরোক্ষ অভিঘাতে ইংল্যান্ডে ১৯৪৮ সালের ৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেওয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর ইতিকথা। আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মের আগে এপ্রিল, ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডের প্রতিটি পরিবারে একটি লিফলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সে লিফলেটে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছিল যে এই “সার্ভিস” – “আপনাদেরকে সমস্ত ধরণের মেডিক্যাল, ডেন্টাল এবং নার্সিং পরিষেবা দেবে। সমস্ত নাগরিক – ধনী কিংবা দরিদ্র, পুরুষ, নারী, কিংবা শিশু – এ যত্নকে ব্যবহার করতে পারবে, হয় সামগ্রিকভাবে কিংবা আংশিকভাবেও বটে। কয়েকটি বিশেষ আইটেম ছাড়া এর জন্য কোন খরচ (“চার্জ”) নেই। এর জন্য কোন ইন্সিউরেন্সের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা কোন ‘চ্যারিটি’ নয়। আপনারা সবাই করদাতা হিসেবে এর জন্য মূল্য দিচ্ছেন। এবং আপনার দেওয়া অর্থ আপনার অসুস্থতার উদ্বেগের সময়ে আপনার কাজে ব্যবহৃত হবে।” (“The British National Health Service”, Public Health Reports, February 11, 1949, 64 (6): 161-200) শুধু তাই নয়, এই “সার্ভিস” সেসময় থেকে এখনও পর্যন্ত “free at the point of use”।
১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হল ইভান ইলিচ-এর সাড়া জাগানো এবং বিতর্কিত পুস্তক Limits to Medicine. Medical Nemesis: The Expropriation of Health (Marion Boyars, 1976)। এ পুস্তকে আধুনিক চিকিৎসার গতিপ্রকৃতি, ধরণ এবং মানবিক বীক্ষাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইভান ইলিচ দেখিয়েছেন মানুষের বিশেষ সংকৃতি-স্থিত বেদনা বহনের ধরণ, ক্ষমতা ও চরিত্রের কিভাবে ক্রমাগত পশ্চিমীকরণ বা Westernization হয়ে চলেছে। তাঁর পুস্তকের পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম “মৃত্যুর বিরুদ্ধে মৃত্যু – মৃত্যু যখন পণ্য হয়ে ওঠে”। এ অধ্যায়ের শুরুর একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রেক্ষাপট এবং কেন এ বক্তব্য বুঝতে সাহায্য করতে পারে – “মেট্রোপলিটান মেডিক্যাল সভ্যতা যতদূর অবধি গভীরে ছড়িয়েছে তাতে মৃত্যুর একটি অভিনব ‘ইমেজ’ পৃথিবীব্যাপী বিস্তার লাভ করেহে। মৃত্যুর এই অভিনব ‘ইমেজ’-এর সাথে সাথে ছড়িয়েছে নতুন কৃৎ-কৌশল এবং পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্ট চারিত্র্যলক্ষণ। চরিত্রের দিক থেকে এটা ‘সুপার-ন্যাশনাল’। কিন্তু এই বিশেষ কৃৎ-কৌশলগুলো সাংস্কৃতিকভাবে নিরপেক্ষ (নিউট্রাল) নয়, পাশ্চাত্যের সভ্যতার মাঝে এগুলো নির্দিষ্ট চেহারা লাভ করে এবং পাশ্চাত্যের ‘ethos’কে প্রকাশ করে। সাদা মানুষের মৃ্ত্যুর ‘ইমেজ’ মেডিক্যাল সভ্যতার সাথে সাথে বিস্তার লাভ করেছে এবং সাংস্কৃতিক উপনিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে।” (পৃঃ ১৭৯-১৮০; নজরটান আমার)
ফুকো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, শিল্পায়নের ফলে গড়ে ওঠা প্যারিসের প্রাক-আধুনিক সময়ে প্যারিসে Cemetery of the Innocents ছিল – যেখানে “cadavers of those who lacked the resources or the social stature to buy or to merit and individual grave were thrown, one on top of other.” (“The Birth of Social Medicine”, in The Essential Foucault, পৃঃ ৩২৭) যে সহায়-সম্পদহীন মানুষগুলোকে মৃত্যুর পরে একজনের ওপরে আরেকজনকে রেখে থাকবন্দী করে কবর দেওয়া হত তারা যদি একবিংশ শতকে সম্পদশালী (অন্তত পণ্য কেনার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেতা) হয়ে উঠতে পারে তাহলে চিত্রটি কেমন দাঁড়ায়? আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে এ প্রসঙ্গটি।
সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে হু (WHO) এবং ইউনিসেফের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা বলা যায়, যেখানে ১৩৪টির বেশি দেশ, অ-সরকারি সংস্থা এবং স্বাস্থ্য–প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিল। সে সম্মেলনে গৃহীত সনদের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হল – “২০০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সম্পদের আরও ভালো এবং পূর্ণতর ব্যবহার করে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মানের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করে তোলা সম্ভব। বিশ্বের দেশগুলোর সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করা হয় অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক সঙ্ঘর্ষের জন্য। স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা (détente) এবং নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে একটি অকৃত্রিম ও খাঁটি নীতি অতিরিক্ত সম্পদকে মুক্ত করতে পারে এবং করা উচিতও, যে সম্পদকে নিয়োজিত করা যেতে পারে শান্তির লক্ষ্যে এবং, বিশেষ করে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের গতি বৃদ্ধি করার কাজে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য যত্নবান হওয়া এবং এর জন্য সম্পদের যথাযথ অংশ বরাদ্দ করা।”
আন্তর্জাতিক সনদের এ অংশটুকু থেকে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায়, বিশ্বের দেশগুলোর একটা বড়ো অংশ সেসময়ে চাইছিল সম্ভাবনাপূর্ণ, সামাজিকভাবে যতদূর সম্ভব সুস্থিত, নিরুপদ্রব স্বাস্থ্যের কাঠামো – যার প্রধান উপাদান হল একটি জীবন্ত, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এরকম একটা ব্যবস্থা যদি বাস্তবে পৃথিবীর সমস্ত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গ্রহণ করে তাহলে অসুখের ফেরি করবে কে? ওষুধ থেকে বিলিয়ন ডলারের অংকে মুনাফা আসবে কিভাবে? ফলে এ ব্যবস্থাটিকেই, এ ধরণের চিন্তাকে একেবারে গোড়া থেকেই ভেঙ্গে দিতে পারলে কার্যসিদ্ধি হবে।
এই সেদিন – ১ এপ্রিল, ২০২১ – WHO-র ওয়েব সাইটে “প্রাইমারি হেলথ কেয়ার” শিরোনামের বুলেটিনে বলা হয়েছে – “প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শেকড় প্রোথিত আছে সামাজিক ন্যায়বিচার, সমদর্শিতা (equity), সংহতি এবং সবার অংশগ্রহণের মধ্যে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে এই স্বীকৃতি দেবার ওপরে যে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য মান মানুষ উপভোগ করবে – কোনরকম ভেদাভেদ ছাড়া, প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম উপাদান হিসেবে।” মনে রাখতে হবে, কথাগুলো বলা হয়েছে কোভিড-পরবর্তী সময়ে।
(এ কার্টুনটি সবার জন্য বেশ শিক্ষাপ্রদ)
ভিন্ন প্রেক্ষিতে আর্থার ক্লিনম্যান থেকে শুরু করে আরও বহু মান্য গবেষক দেখিয়েছেন, প্রতিটি সংস্কৃতিতে এর নিজের মতো অসুস্থতা, যন্ত্রণা (suffering) এবং মৃত্যুকে ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে। এবং এ সহনশীলতা (resilience) আসে মানুষের সমাজবদ্ধ থাকার শক্তি থেকে, পড়শিবোধ থেকে। কিন্তু এগুলো যদি সব ভেঙ্গেচুরে, ছিন্নভিন্ন হয়ে ‘আপনাতে আপনি মগ্ন’, নিজস্বী-নির্ভর একটি সমাজের জন্ম হয় অপ্রতিরোধ্য, হৃদয়হীন গতিতে? তাহলে সমগ্র বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে যায়।
আরও আধুনিক সময়ে অতুল গাওয়ান্ডে বলছেন – “আধুনিকতা কেবলমাত্র বৃদ্ধদের অবনমিত (demote) করেনি, পরিবারকেও অবনমিত করেছে।” (Being Mortal: Medicine and hat Matters in the End, ২০১৪, পৃঃ ২২) এ পুস্তকে পরে বলছেন – “আমাদের কাজ হল ‘well-being’কে সম্ভব করে তোলা। এবং ‘well-being’ হল সেই কারণ যার জন্য মানুষ বাঁচতে চায়।” এই ওয়েল-বিইং-এর সাথে হরলিকস খেয়ে শিশুর বেড়ে ওঠা বা পঞ্চাশোর্ধ মহিলাদের Shelcal খাবার অতিকথার কোন সম্পর্ক নেই।
আমরা নজের রাখবো, ইভান ইলিচের মূল সমালোচনা ছিলো যে আধুনিক বৃহৎ প্রযুক্তি-নির্ভর চিকিৎসাবিজ্ঞান জনসাধারনের জীবনের স্বাভাবিকতার বিনিময়ে এর পরিধিকে ক্রম-বিস্তৃত, ক্রম-প্রসারিত করতে চাইছে। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ‘মেডিক্যালাইজড’ হয়ে উঠছে অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, রোগা হওয়া থেকে মোটা হওয়া, বিবাহ থেকে সন্তান ধারণ করা সবকিছুই চলে আসবে মেডিসিনের নজরদারিতে – সবকিছুর শেষ কথা হবে মেডিসিনের অভিমত অনুযায়ী, পরিচালকের স্থানে থাকবে মেডিসিন। কিভাবে ঘটে এই medicalization? সে এক মর্মন্তুদ, অতি আগ্রাসী যুদ্ধ – বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর তরফে। অতি বিস্তৃত এর জাল – পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, ব্যতিক্রমহীনভাবে।
পিটার কনরাড তাঁর “Medicalization and Social Control” প্রবন্ধে (Annual Review of Sociology, 1992, pp. 209-232) খুব অল্প কথায় বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – “Medicalization describes a process by which nonmedical problems become defined and treated as medical problems, usually in terms of illnesses or disorders.” “নন-মেডিক্যাল” থেকে মেডিক্যাল হয়ে ওঠার ওপরেই নির্ভর করে অসুখ এবং ওষুধ ফেরি করার আখ্যান। যদিও এর সাথে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায়, জটিলভাবে বিন্যস্ত ও সংযুক্ত হয়ে আছে রাষ্ট্র, বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাসম্পর্ক এবং জনজীবনের গভীরে গিয়ে অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমকে ব্যবহার করে অসুখ আর এর চটজলদি সমাধান করার ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণকে ব্যবহার করা। চলমান দৃশ্য-শ্রাব্য চিত্রপট প্রতিটি ভগ্নাংশে আমাদের সামনে বদলে বদলে যায়। মানুষের তথা ভোক্তার মস্তিষ্কের উপরিস্তরের নিউরনের (স্নায়ু কোষ) প্রতিক্রিয়া গভীরে চিন্তার জন্য মস্তিষ্কের ভেতরের গ্লায়াল কোষ অব্দি প্রবেশ করেনা। পরিণতিতে পণ্য দুনিয়া ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে।
প্রাসঙ্গিকভাবে, ফুকো তাঁর “The Crisis of Medicine or the Crisis of Anti-Medicine” (২০০৪) প্রবন্ধে ইংল্যান্ডে গৃহীত Beveridge Scheme (এবং ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) নিয়ে মন্তব্য করছেন – “At a time when the War was causing large-scale destruction, society assumed the explicit task of ensuring its members not only life, but also a healthy life” – “একটা সময়ে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রকাণ্ড ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তখন সমাজ প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্ব নিল এর সদস্যদের জীবনের সুরক্ষা শুধু নয়, অধিকন্তু একটি স্বাস্থ্যময় জীবনের।” কিন্তু বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত মেডিসিন প্রবেশ করতে শুরু করলো জীবনের প্রতিটি স্তরে।
হাঙ্গর-সদৃশ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি এবং এর এজেন্ট “ইকনোমিক হিট ম্যান”-রা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করে মেডিসিনকে Wrigley কোম্পানির চিউয়িং গামের মতো বিক্রির মতো উপযোগী করে তুলতে সদা তৎপর, সাথে আছে বিজ্ঞাপন দুনিয়ার মায়াজাল।
বর্তমানের কথা – অসুখ যেখানে ফেরি করা হয়
আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে অতিবৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি Merck-এর তদানীন্তন প্রধান কর্মকর্তা Henry Gadsden বিখ্যাত Fortune পত্রিকার প্রতিনিধি W. Robertson-কে জানিয়েছিলেন (Fortune, March, 1976) – “I want us to be like Wrigley’s and sell to everyone.”
তুলনাটি বড়ো কৌতুকপ্রদ। Wrigley কোম্পানি, আমাদের অনেকেরই জানা, আমেরিকার একটি বিখ্যাত বাবল গাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি। Gadsden-এর আক্ষেপ হল যে বাবল গাম-এর মতো ওষুধকেও সবার কাছে বিক্রী করতে পারলেন না! অতঃ কিম্? এরপরে শুরু হল সুকৌশলী এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে রোগ বা অসুখ বিক্রী করার নিরন্তর, ধারাবাহিক ও হিংস্র একটি উপাখ্যান লেখার ইতিহাস। সে ইতিহাসের সানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে Ray Moynihan এবং Alan Cassels-এর লেখা Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients (Allen Unwin, 2008) পুস্তকে। এ পুস্তকে লেখকেরা বলছেন – “There are many different promotional strategies used in the selling of sickness, but the common factor amongst them all is the marketing of fear. The fear of heart attacks was used to sell women the idea that the menopause is a condition requiring hormone replacement. The fear of youth suicide is used to sell parents the idea that even mild depression must be treated with powerful drugs. The fear of an early death is used to sell high cholesterol as something automatically requiring a prescription.” (পৃঃ ১৫) অর্থাৎ মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের থেকে সামান্য ব্যতিক্রমী যে কোন অবস্থাকে ‘অসুখ’ বলে চিহ্নিত করে মনের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দাও। তাহলে ভয়ার্ত এবং নিজেকে অসুস্থ বলে ধরে নেওয়া মানুষটি ক্রমাগত নিজেকে বিপন্ন বোধ করবে এবং বেশি বেশি করে বাঁধা পড়বে অসুখের/ওষুধের ফেরিওয়ালাদের বিজ্ঞাপনী কুহকের জালে।
কয়েকটি উদাহরণ দিই। PLoS-এর মতো গ্রাহ্য জার্নালের ২০০৬ সালের একটি বিশেষ সংখ্যা কেবলমাত্র উপরোক্ত বিষয়ের ওপরে বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধগুলোর শিরোনামের উল্লেখই আমাদের বোঝার জন্য যথেষ্ট হবে, আশা করি। (১) “The Fight against Disease Mongering: Generating Knowledge for Action”, (২) “Combating Disease Mongering: Daunting but Nonetheless Essential”, (৩) “Pharmaceutical Marketing and the Invention of the Medical Consumer”, (৪) “The Latest Mania: Selling Bipolar Disorder”, (৫) “Female Sexual Dysfunction: A Case Study of Disease Mongering and Activist Resistance”, (৬) “Medicine Goes to School: Teachers as Sickness Brokers for ADHD”, (৭) “Bigger and Better: How Pfizer Redefined Erectile Dysfunction”, (৮) “Disease Mongering in Drug Promotion: Do Governments Have a Regulatory Role?” ইত্যাদি।
কিন্তু এখানে একটি বিপত্তিও আছে। জিওফ্রে রোজের মতো বন্দিত এপিডেমিওলজিস্ট তাঁর সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Sick Individuals and Sick Population”-এ বলছেন – “In mass prevention each individual has usually only a small expectation of benefit, and this small benefit can easily be outweighed by a small risk.” আরও বলছেন WHO-এর রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ নিয়ে একটি বৃহৎ স্টাডির ক্ষেত্রে “where a cholesterol-lowering drug seems to have killed more than it saved, even though the fatal complication rate was only about 1/1000/year … A further disadvantage of the ‘high-risk’ strategy is that it is behaviourally inappropriate.”
২০০২ সালের ৩০ জুলাই বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “First, you market the disease… then you push the pills to treat it”। সে প্রবন্ধে বলা হয় – “On April 16 2001, the US food and drug administration (FDA) had approved the antidepressant Paxil, made by British pharmaceutical giant GlaxoSmithKline, for the treatment of Gad (generalized anxiety disorder). But it was a little-known ailment; according to a 1989 study, as few as 1.2% of the US population merited the diagnosis in any given year. If GlaxoSmithKline hoped to capitalise on Paxil’s new approval, it would have to raise Gad’s profile.” মোদ্দা কথা হল, দৈত্যাকার বহুজাতিক কোম্পানি ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল আমেরিকার সর্বমান্য সংস্থা এফডিএ-র এদের তৈরি ওষুধ Paxil-এর বিক্রীর জন্য অনুমোদন পায়। কিন্তু কি কারণে বিক্রী হবে? একটি লাগসই রোগ প্রয়োজন এ ওষুধের বাজারের জন্য। এবার সে অসুখের নামকরণ হল “generalised anxiety disorder (GAD)”। কিন্তু তখনও অব্দি এ রোগের ব্যাপারে মানুষ অবহিতই নয়, মানুষের কোন হেলদোল নেই। তাহলে ডাক্তারের কাছেই বা যাবে কেন? ওষুধই বা বিক্রী হবে কেন? তাহলে মেডিসিনের জগতে, চিকিৎসক মহলে একে রোগ হিসেবে মান্যতা ও স্বীকৃতি – দুটোই দিতে হবে।
এরপরে আসে পরবর্তী ধাপ। প্রবন্ধটি থেকে জানা যাচ্ছে – “SmithKline was especially interested in a series of minor entries in the diagnostic and statistical manual of mental disorders (DSM), the psychiatric bible. Published by the American psychiatric association since the 1950s, the DSM is designed to give doctors and scientists a common set of criteria to describe mental conditions.” সহজ কথা হল, মানসিক রোগের বাইবেল DSM-এ এ রোগকে নথিবুক্ত করতে হবে। মেডিসিনের বাইবেলগুলো কোন নিষ্কাম, স্বরাট কিংবা দানশীল বস্তু নয়। বরঞ্চ বিভিন্ন ক্ষমতা সম্পর্ক, বিলিয়ন ডলার ওষুধ কোম্পানিগুলোর নিঃশব্দ চাপ ও উপঢৌকন এবং রকমারি “প্রেসার গ্রুপ”-এর প্রভাব সৃষ্টি করার ক্ষমতা, সবকিছুই একসঙ্গে কাজ করে। এবং অবান্তর ও “মাইনর” অসুস্থতাও “অসুখ” হিসেবে DSM-এর পৃষ্ঠায় জায়গা পায়। এ প্রবন্ধেই পরে ব্যাখ্যা করে বলা হল – “Critics note that the DSM process has no formal safeguards to prevent researchers with drug-company ties from participating in decisions of interest to their sponsors. The committee that recommended the Gad entry in 1980, for example, was headed by Robert L Spitzer of the New York state psychiatric institute, which has been a leading recipient of industry grants to research drug treatments for anxiety disorders.”
পরবর্তী ধাপগুলোতে চলতে থাকে আরও বহু জটিল, পরস্পরসংবদ্ধ প্রক্রিয়া – “The modus operandi of GlaxoSmithKline – marketing a disease rather than selling a drug … Typically, a corporate-sponsored “disease awareness” campaign focuses on a mild psychiatric condition with a large pool of potential sufferers. Companies fund studies that prove the drug’s efficacy in treating the afiction, a necessary step in obtaining FDA approval for a new use, or “indication”. Prominent doctors are enlisted to publicly affirm the malady’s ubiquity, then public-relations firms launch campaigns to promote the new disease, using dramatic statistics from corporate-sponsored studies. Finally, patient groups are recruited to serve as the “public face” for the condition, supplying quotes and compelling stories for the media; many of the groups are heavily subsidised by drugmakers, and some operate directly out of the offices of drug companies’ PR firms.” শিক্ষিত পাঠকেরা একটু কষ্ট করে ইংরেজিটা পড়ে নিন। আর বাংলা করলাম না।
অধুনা একটি অতি জনপ্রিয় চালু বিষয় হল “whole body check-up”। যে বিশাল সংখ্যক রোগী প্রধানত দক্ষিণ ভারতে পাড়ি জমান চিকিৎসার জন্য তাদের জন্য অ্যাপোলো হাসপাতাল সম্ভবত প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক এরকম একটি প্যাকেজ চালু করে। রোগীদের চিন্তায়, মননে এবং বোধে ধীরে ধীরে সংক্রামিত হতে থাকে একবার whole body check-up করে ফেলতে পারলে রোগ নিয়ে আর দুর্ভাবনার বিশেষ কিছু থাকে না। একটু নজর করলে বুঝবো মানুষের স্বাভাবিক সুস্থতার মাঝে একটি পরিহার্য বিপন্নতা বোধের জন্ম হচ্ছে, মানুষ নির্ভর করতে শুরু করছে আরো বেশী বেশী পরিমানে মেডিসিনের জগতের ওপরে।
এ প্রসঙ্গে British Medical Journal-এ (৯ জুন, ২০১৪) প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় এবং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্পাদকীয়-র শিরোনাম – “General health checks don’t work: It’s time to let them go”। এতে বলা হয়েছিল – “People who accept an invitation to a health check tend to have higher socioeconomic status, lower cardiovascular risks, less cardiovascular morbidity, and lower mortality than others.” অর্থাৎ সচরাচর যারা এ ধরণের চেক-আপ করাতে যান তারা অর্থনৈতিকভাবে সুস্থিত অবস্থায় থাকার ফলে বিশেষ কিছু শারীরিক সমস্যার সম্ভাবনা সাধারণভাবে কম।
Danish Inter99 Trial-এর একটি বড়ো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের একই সংখ্যায়। ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত ৩০-৬০ বছর বয়সী ৫৯,৬১৬ জন মানুষের ওপরে এ সমীক্ষা করা হয়েছিলো। সমীক্ষার সিদ্ধান্ত – “A community based, individually tailored intervention programme with screening for risk of ischaemic heart disease and repeated lifestyle intervention over five years had no effect on ischaemic heart disease, stroke, or mortality at the population level after 10 years.”
নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে ২৪ জুন, ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মার্গারেট ট্যালবটের লেখা ‘দ্য শাইনেস সিন্ড্রোম’ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি দেখান, ডেভিড বেকহ্যাম, স্পাইস গার্ল বা রিকি উইলিয়ামস-এর মতো সেলিব্রিটিরা ওষুধ কোম্পানির টাকায় মিডিয়ার সামনে কেমন করে ‘সোশাল ফোবিয়া’-র শিকার হচ্ছেন বলে টিভির পর্দায় বারংবার জানাচ্ছেন, এবং এ সমস্যার চিকিৎসার জন্য ওষুধ কোম্পানির তৈরি একটি নতুন অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধে ফল পাচ্ছেন বলেও বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। এমনকি কখনো কখনো আগে ওষুধ তৈরি হয়, পরে রোগের লাগসই নামকরণ হয়।
২৬ মার্চ, ২০২১-এ ব্রিটিশ জার্নাল অফ ক্লিনিকাল ফার্মাকোলজি-তে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম – “Promoting diseases to promote drugs: The role of the pharmaceutical industry in fostering good and bad medicalization”। প্রবন্ধটিতে প্রশ্ন করা হয় – “শোকে বিলাপ করা কি একটি রোগ? স্বাস্থ্যের কিছু বিশেষ অবস্থাকে কি নতুন করে উদ্ভাবন করা হয়েছে কিংবা তাদেরকে ‘প্রোমোট’ করা হচ্ছে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট কিংবা অন্য কোন ওষুধের চাহিদা বাড়ানোর জন্য?”
মার্গারেট ট্যালবট নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রবন্ধে (The Shyness Syndrome) প্রশ্ন করেছিলেন – “হতে পারে আরও অনেক মানুষ বেশি বেশি লাজুক বোধ করবে এমন একটি সংস্কৃতিতে যেখানে সর্বব্যাপী মিডিয়া আক্রমণাত্মকভাবে নির্লজ্জ। হয়তো আরও এক প্রজন্ম পরে আমরা দেখব যে মৃদু এবং নরম, উদাসীন এবং স্বল্পভাষী মানুষেরা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। তখন কি অতিরিক্ত বেহায়াপনার চিকিৎসার জন্য আবার ওষুধ আবিষ্কৃত হবে?”
যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের ভিন্নতার জন্ম দেয়, সেরকম একটি বৈশিষ্ট্য স্বল্পবাক বা লাজুক চরিত্র যদি medicalized হয়ে যায় তাহলে মানুষের এসমস্ত স্বাভাবিক ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যও ওষুধের এবং চিকিৎসার আওতার মধ্যে চলে আসবে। এদের জন্য নতুন ওষুধ তৈরি হবে। এরকম সামাজিক মানসিকতায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যেকোন পণ্য ভোগ করার একটি ‘হাইপাররিয়াল’ অবস্থার জন্ম হয়। ডাক্তার সমাজও এর উর্ধে নয়।
একটি নতুন anti-depressant ওষুধ তৈরি হচ্ছে social phobia-র জন্য। যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের ভিন্নতার জন্ম দেয়, সেরকম একটি বৈশিষ্ট স্বল্পবাক বা লাজুক চরিত্রকে medicalize করে ফেলতে পারলে তা ওষুধের ও চিকিৎসার আওতার মধ্যে চলে আসবে। নতুন ওষুধ তৈরি হবে। কয়েক মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে। ক্রিস্টোফার লেন তাঁর পুস্তকে দেখিয়েছেন ১৫২৫ সাল থেকে ‘anxiety’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে, মেডিসিন তখনো একে গ্রাস করতে পারেনি। (Shyness: How Normal Behavior Became a Sickness, ২০০৮, পৃঃ ১১) লেখকের মন্তব্য –“যেহেতু ডিএসএম-৩ (DSM-III) anxiety disorder-এর ক্ষেত্রে এত নাটকীয়ভাবে ফার্মাসিউটিকাল বাজারকে সম্প্রসারিত করে ফেললো যে SmithKline-এর কর্তাব্যক্তিরা ডগোমগো হয়ে বলেছিল ‘সুযোগ’ সুবিশাল – ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৯ কোটি মানুষ এ রোগে যেকোন সময়ে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।” (পৃঃ ১১৮) লেখক পরপর ৪টি ধাপের কথা বলেছেন কিভাবে সামান্য অস্বাভাবিকতাকে ‘মানসিক অসুখ’ বানিয়ে ফেলা হয় – (১) মানুষের কাছে এও-হয়-তাও-হয় গোছের অস্পষ্ট (ambiguous) প্রশ্নমালা নিয়ে যাওয়া হয়, (২) নতুন ‘ডিসঅর্ডার’কে ডিএসএম-এ নথিভুক্ত করো, যাতে নতুন নতুন কোম্পানি এর চিকিৎসার ওষুধ তৈরি করে ফেলতে পারে, (৩) ডাক্তারদের সমস্ত ধরণের উপঢৌকনে ভরিয়ে দাও এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের প্লাবন আনো, এবং (৪) যারা এগুলোকে অস্বীকার করবে তাদেরকে রোগীর অসুস্থতার জন্য দায়ী করে নিরন্তর নির্দয় আক্রমণ করে যাও। (পৃঃ ১৯৬-১৯৭)
আমেরিকায় নিযুক্ত ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত Kingman Brewster “Health at any price?” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন (Journal of the Royal Society of Medicine Volume 7, 2 October 1979, পৃঃ ৭১৯-৭২৩)।
ব্রিউস্টার বলেন – “সমস্যা হচ্ছে এইটে যে একজন রোগী যখন মনে করে যে তার কিছু গণ্ডগোল হয়েছে তখন সে কোন ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ নয়। সে একজন ভীত, অজ্ঞ, অসহায়, শোচনীয় প্রাণী। সে অবশ্যই স্বাস্থ্য চায়, প্রায় যে কোন মূল্যে। অর্থনীতিবাদেরা যাকে ‘প্রোভাইডার’ বলে সেরকম কাউকে সে খুঁজছে না। সে কেবলমাত্র পেশাগত বিবেচনা প্রার্থনা করে। সে পেশাগত দক্ষতাকেও বস্তুগতভাবে তুলনা করার মতো অবস্থায় থাকে না। পেশাগত বিবেচনার গুণমানের পরবর্তীতে ধাপেই একজন রোগী অনুভব করতে চায়, যে মানুষটি তার চিকিৎসা করছে সে কত ভালোভাবে তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং এর অতিরিক্ত কোন চিন্তা যেন চিকিৎসকের মাথায় না থাকে। সে কোন দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ (second best) চিকিৎসককে চায় না … সংক্ষেপে বললে একজন রোগী আন্তরিকভাবে খোঁজে একজন ‘trustee’-কে, কোন ‘প্রোভাইডার’-কে নয়।” (পৃঃ ৭২০)
এ প্রবন্ধেই ব্রিউস্টার একটি গভীর প্রশ্ন তুলেছিলেন – “Just as the market ‘failed’ because the physician-patient relationship is not one of a seller and a buyer bargaining for each other …
Is there any way out of this expensive triangle of patient, physician, and government as underwriter?” (পৃঃ ৭২২)
কাকস্য পরিবেদনা! এ প্রশ্ন অনুভূতিশীল চিকিৎসক এবং মানুষকে ভাবিয়েছে সত্যি, কিন্তু কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, ইনসিউরেন্স কোম্পানি বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ভাবনায় কোন আঁচড় কাটে নি। তবুও প্রশ্নগুলো থেকে যায়। ব্রিউস্টার তাঁর প্রবন্ধের শেষে বলেছিলেন – “By groping pragmatically we may not stumble upon a new and more adequate Ideology to compete with either Adam Smith or Karl Marx. But we may find that there are solutions which allow us to keep society more voluntary than it would be under either the rule of the unfettered market or the rule of the all-pervasive State.” (পৃঃ ৭২৩)
পূর্বোক্ত প্রবন্ধে ট্যালবট যে আশঙ্কা বোধ করেন এমন কোন দিন হয়তো আসবে যখন পৃথিবীতে মৃদুভাষী, স্বল্পবাক বা স্বভাব ভীরু বলে কিছু থাকবে না সে আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তিতে আছে অর্থনৈতিক মুনাফা। আমেরিকাতে ওষুধ কোম্পনিগুলো বছরে (এ হিসেব ২০০৪ সালের এবং এখন বহুল পরিমাণে বেড়েছে) ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে “on promoting their products.” (Lancet, “Dealing in drugs”, November 6, 2004, pp. 1655-56) অন্য আরেকটি প্রসঙ্গে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, কিভাবে মহিলাদের কিছু স্বাভাবিক স্বভাবকে একটি বিশেষ রোগের নামে নামাঙ্কিত করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করা হয়। (Ray Moynihan and Barbara Mintzes, Sex, Lies, and Pharmaceuticals: How Drug Companies Plan to Profit from Female Sexual Dysfunction, ২০১০)
১৯৮০ সালে (২৩ অক্টোবর) নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ তৎকালীন সম্পাদক রেলম্যান একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন “The New Medical-Industrial Complex” শিরোনামে। এ প্রবন্ধে তিনি বলেন – “প্রাইভেট হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি তাদের পরিষেবা বিক্রীর ব্যাপারে প্রধানত আগ্রহী। কিন্তু রোগীরা আগ্রহী কেবলমাত্র সেটুকু পরিষেবা পেতে যা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় – অর্থাৎ যে পরিষেবা সাহায্যকারী এবং তুলনায় নিরাপদ। অধিকন্তু, সমাজ যেখানে স্বাস্থ্যকে কম খরচের মধ্যে রাখতে চায়, সেখানে প্রাইভেট হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র নজর হল কি করে সামগ্রিক বিক্রীর পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়।”
এরকম একটি চিন্তা, মত ও ভাবনা উৎপাদনের সামাজিক পরিবেশ, ডিজিটাল দুনিয়া, সংবাদমাধ্যম এবং পারস্পরিক আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে আমাদের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ফলে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিও আমাদের কতটা নাড়া দেবে সেটা চিন্তাসাপেক্ষ। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ অ্যান্ড্রু পোলাক তাঁর “Drug Goes From $13.50 a Tablet to $750, Overnight” (সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫) প্রতিবেদনে বলছেন – “Daraprim (প্যারাসাইট-ঘটিত রোগ টক্সোপ্লাজমোসিসের চিকিৎসার ওষুধ) cost only about $1 a tablet several years ago, but the drug’s price rose sharply after CorePharma acquired it. According to IMS Health, which tracks prescriptions, sales of the drug jumped to $6.3 million in 2011 from $667,000 in 2010, even as prescriptions held steady at about 12,700. In 2014, after further price increases, sales were $9.9 million, as the number of prescriptions shrank to 8,821. The figures do not include inpatient use in hospitals.” এ সংবাদপত্রেই জুলাই ৮, ২০২১-এ প্রকাশিত হচ্ছে বড়ো প্রতিবেদন “How Big Pharma Grew Addicted to Big Profits”।
১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রোনাল্ড রেগানের নির্বাচন বোধ করি “big pharma”-দের উত্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এসময়ে কেবলমাত্র রাষ্ট্রনীতিতে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে pro-business shift হল। ১৯৮০-তেই রচিত হল বি/কু-খ্যাত Bayh-Dole Act (Pub. L. 96-517, December 12, 1980)। ইন্ডিয়ানার ডেমোক্র্যাট সেনেটর বার্চ বে এবং কানসাসের রিপাব্লিকান সেনেটর রবার্ট ডোলের যৌথ উদ্যোগে জন্ম নিল এ আইন। পুঁজির অবাধ বিচরণের জন্য যা ডেমোক্র্যাট তাই রিপাবলিকান – আমে দুধে মিশে যায় অভ্রান্তভাবে। টেকনোলজি ট্রান্সফারের নামে – “Bayh-Dole enabled universities and small businesses to patent discoveries emanating from research sponsored by the National Institutes of Health (NIH), the major distributor of tax dollars for medical research, and then to grant exclusive licenses to drug companies.” (Marcia Angell, The Truth about the Drug Companies: How They Deceive Us and What to Do about It, 2004, p. 7)
(এই ভেন ডায়াগ্রাম থেকে বোঝা যায় বিভিন্ন অতি-বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি কিভাবে নীতিনির্ধারণের পরিসরে ভূমিকা পালন করে – যেন একটি swinging door)
PLoS-এ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেসঃ দ্য টেন থাউস্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”-এ বলা হয়েছিল – “১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ হয় তার ১/১০,০০০ ভাগেরও কম খরচে অবহেলিত রোগগুলোকে নির্মূল করা ও বিশ্বের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব।”
কিন্তু এর পরিবর্তে শুরু হল সুকৌশলী এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে রোগ বা অসুখ বিক্রী করার নিরন্তর, ধারাবাহিক ও হিংস্র একটি উপাখ্যান লেখার ইতিহাস। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা যে সব সেক্টর থেকে হয় তার মধ্যে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি অগ্রগণ্য।
আগে উল্লেখিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় (৩০ জুলাই, ২০০২) প্রকাশিত প্রতিবেদনে (“First, you market the disease… then you push the pills to treat it”) বলা হয়েছিল – “The modus operandi of GlaxoSmithKline – marketing a disease rather than selling a drug – is typical of the post-Prozac era … The strategy has enabled the pharmaceutical industry to squeeze millions in additional revenue from the blockbuster drugs known as selective serotonin reuptake inhibitors (SSRIs), a family of pharmaceuticals that includes Paxil, Prozac, Zoloft, Celexa, and Luvox. Originally approved solely as antidepressants, the SSRIs are now prescribed for a wide array of previously obscure afflictions – Gad, social anxiety disorder, premenstrual dysphoric disorder, and so on.”
Allan V. Horwitz এবং Jerome C. Wakefield-এর The loss of sadness: how psychiatry transformed normal sorrow into depressive disorder (২০০৭) পুস্তকে লেখকেরা বলছেন – “The resulting problems went unremedied in subsequent editions of the manual. But the problem of pathologizing normal sadness does not end there. The next step in transforming normal unhappiness into mental disorder came when the symptom-based logic behind the DSM-III and DSM-IV went beyond the clinic and formed the basis for studies of depression among untreated individuals in the community.” (পৃঃ ১২২) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। টেক্সট বই কিভাবে রোগ ফেরি করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় তার একটি উদাহরণ।
আমি নিশ্চিত নই হালে CBT (Cognitive Behavioral Therapy)-ও এরকম গোত্রে পড়বে কিনা। কারণ এ চিকিৎসা প্রধানত ওষুধ-নির্ভর নয়। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই দ্বিধাহীনভাবে বাছবিচার না করে বহু শিশুকে CBT-র আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে শিশুদের ক্ষেত্রে আরেকধরণের মেডিক্যালাইজেশন হচ্ছে তো বটেই।
(The triangle in the middle represents CBT’s tenet that all humans’ core beliefs can be summed up in three categories: self, others, future – উইকিপিডিয়া)
JAMA (Journal of American Medical Assoction-এর মুখপত্র)-তে ২০১৯ সালে ১ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত “Medical Marketing in the United States, 1997-2016” প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল – “১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ‘মেডিক্যাল মার্কেটিং’ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে ‘প্রেস্ক্রিপশন ড্রাগ’ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে DTC (direct to consumer – সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছে যাওয়) বিজ্ঞাপন ভয়ঙ্কর রকমের বেড়ে গেছে। হেলথ প্রফেশনালদের ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির তরফে বিপণন করাতে সামগ্রিক খরচের বেশির ভাগ অংশ ব্যয়িত হয়েছে। এবং এখনও খুব বেশি, রাষ্ট্রের তরফে ইন্ডাস্ট্রির পলিসির প্রভাবকে সীমায়ত করার ব্যাপারে নতুন পলিসি গ্রহণের পরেও।”
এখানে কোথাও একটা আমাদের অবস্থান গ্রহণ করা নিতান্ত আবশ্যক, গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সুখের নামান্তর বলে কেনার প্রধান উপায় হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াটিকে আমাদের এবার থামানো দরকার – বিশেষ করে আমরা যারা চিকিৎসক। স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় “সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ” যতক্ষণ না বাস্তবায়িত হচ্ছে, যতক্ষণ না সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নটি রাষ্ট্রের বিবেচনার মধ্যে আসছে, যতক্ষণ না বেঁচে থাকার সামগ্রিক উপাদানগুলো সবার নাগালের মধ্যে অধিকারভুক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনভাবেই সুখের বিকল্প নয়।
এখানে একটি ভিন্নতর ও গভীরতর সত্য নিহিত আছে। মুক্ত বাজারের অর্থনীতি এবং এর হিংস্রতা ওষুধের বাজার, মুনাফা এবং এর জনগ্রাহ্যতা তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়ার পেছনে কাজ করছে। এখানে নিতান্ত স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয় – (১) মানুষ চির-অতৃপ্তির ধারক একটি জীব এবং সে সবসময়ে অতৃপ্তিকে তৃপ্তিতে এবং সুখে রূপান্তরিত করার জন্য সবকিছু বাজি রাখতে পারে, (২) ধরে নেওয়া হয় মুক্ত বাজার হল সে স্থান যেখানে মানুষ free choice-এর সাহায্যে তার প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে, (৩) “unfettered competition in the market” হল সমস্ত আবিষ্কারের চালিকা শক্তি। Marshall Sahlins দেখিয়েছেন পশ্চিমী দুনিয়ার “satisfaction”-এর জন্য এই সুতীব্র আকাঙ্খা কিভাবে মানব সভ্যতা সম্পর্কে একমাত্রিক এবং একটি মাত্র ধারণাকে চরম ও পরম সত্যি বলে গ্রহণ করে ও সমগ্র পৃথিবীতে সে ধারণা প্রাধানা বিস্তার করে, যা তাঁর মতে – “disastrous for the study of non-Western societies.” (“The Sadness of Sweetness: The Native Anthropology of Western Cosmology”, Current Anthropology, 1996, 37.3, pp. 395-428)
সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তকে সমসত্ত্ব medical consumer করে তোলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসমসত্ত্ব এবং নিজের সংস্কৃতিতে স্থিত অঞ্চল (heterogeneous space) গড়ে তোলার লড়াই তো চালিয়ে যেতেই হবে। আমাদের কাছে মানুষের জীবনই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। দৈত্যাকার বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা নয়।
Khub sunder lekha sir
Lekhata pore khub valo laglo.
Kintu amder akhane ei poriseba paoyar katha vabai jay na.
Jayanta, thank you for this well researched, topical thought provoking article. The message needs to be spread as widely as possible and I will do my bits towards this.
Khub bhalo laglo. Tabe anek alochana tola thaklo.
মৃত্যুকে নিয়ে এই ব্যবসা এখন সর্বগ্রাসী। এর সাথে আছে হসপিটাল ট্যুরিজম। বীমা কোম্পানী এখন ১ কোটি টাকার স্বাস্থ্যবীমার প্রচার করছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান আর থাকবে না। ওটা মুনাফা বিজ্ঞানে চিকিৎসা নামে একটা অধ্যায় হবে।
সাহসী ও বলিষ্ঠ লেখা – পড়ে মুগ্ধ হলাম
ভীষন সুন্দর এবং ব্যাতিক্রমী লেখা। চিকিৎসা রাষ্ট্র বিগ ফার্মা এবং তাদের অসাধারণ বোঝাপড়া এক নয়া দিগন্ত।
Manuser jibon nie business cholche, ei business er katorakom policy. Er sathe insurance company gulo o fule fepe utheche.
Aapnar lekha gulo vison valo, lekha pore anuprerona paoajai.