ওই ম্যাচটার সময়ে স্টেডিয়ামের আবহাওয়া কেমন ছিল সেটা জানতে একটু ফেরত যেতে হবে। ১৯৯০-এর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই ইতালির জনতা আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ব্যাপক খাপ্পা। তাদের জাতীয় সংগীত বাজানোর শুরুর সময় থেকে ম্যাচ শেষ হওয়া পর্যন্ত মারাদোনার টিমকে দর্শক গ্যালারি থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ দেয়া, গালাগালি করা। ক্যামেরুনের কাছে হেরে যাওয়ার পরে ক্ষিপ্ত মারাদোনা বলেছিলেন, “আজ বিকেলে একমাত্র যে ঘটনায় আনন্দ পেয়েছি সেটা হল জীবনে প্রথমবার মিলানের দর্শকরা বর্ণবিদ্বেষ মুক্ত হতে পেরেছেন”। দ্বিতীয় তৃতীয় ম্যাচ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আর রুমানিয়ার সাথে সেই একই অবস্থা গ্যালারিতে, সেই গালাগালির বন্যা। পরের ম্যাচ যুগোশ্লাভিয়া। গোয়কচিয়ার অনবদ্য গোলকিপিং-এর জোরে ম্যাচ জেতা। দিয়াগো মনে মনে ফুঁসছেন, অপেক্ষায় আছেন সেই ম্যাচটার জন্য।
সান পাওলোর স্টেডিয়ামে ষাট হাজার দর্শকের সামনে নামার আগে মারাদোনা আবেদন জানালেন, “আমি কেবল নিয়াপলিটানদের জন্য রেসপেক্ট চাই। আমি বা আমার টিমমেটরা জানি যে তারাও ইতালিয়ান, আমরা তাদের বলতে পারি না যে আমাদের জন্য গলা ফাটাও।” নেপলস-এর দর্শকরা ধর্মসংকটে। একদিকে নিজের দেশ ইতালি আর অন্যদিকের বিদেশি টিমে তাদের ঘরের ছেলে দিয়াগো। গ্যালারিতে দেখা গেল সেই অবিস্মরণীয় ব্যানার, “দিয়াগো ইন আওয়ার হার্টস, ইতালি ইন আওয়ার সং।” “দিয়াগো আছে হৃদয়ে, আর ইতালি আছে গানে”। প্রথমবার আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীতের সময় কেউ আওয়াজ দিল না। মাঠের হাওয়া অন্যরকম। হেরে যাওয়ার পরে ইতালির প্লেয়ার ওয়াল্টার জেঙ্গার ভাষায়, “রোমে পাঁচটা ম্যাচ খেলে তারপরে আমরা এসেছিলাম নেপলস-এ, পাঁচটাতেই জয়। এই হারের জন্য আমি কোনো বাহানা দিচ্ছি না, কিন্তু মারাদোনা এলো। এসে কি সব বললো আর মাঠের হাওয়া পাল্টে গেল।” জাস্ট ভাবা যায় না।
দেশ বনাম প্রিয় ফুটবলার। কেন প্রিয় তার উত্তরটা নিয়াপলিটান সমর্থকদের কাছে খুব সোজা। চিরকাল উত্তর ইতালির লোকজনদের কাছ থেকে চাষাভুষো এলেবেলে গালাগালি শুনে তিতিবিরক্ত হতাশ নাপলির লোকজনের কাছে একমাত্র আশার আলো ছিল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির ওই জাদুকর। ফুটবল পায়ে জাদুকর। সে তাদের দু’হাত ভরে দিয়েছে। একার চেষ্টায় তাদের অখ্যাত ক্লাবকে চিনিয়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর সামনে।
ঠিক এইখানেই লোকটার মাহাত্ম্য। ফুটবল, সবাই জানে যে এগারো জনের খেলা, টিমগেম। সেইখানে সবাইকে ছাপিয়ে যেতে পারাটা সহজ নয়, এমন খেলা সহজ নয় যাতে লোকে বলে, একাই জিতিয়ে দিলো।
টেকনিক্যাল দিকটার কথা ছেড়ে দিলাম, ছেড়ে দিলাম ওই পরিসংখ্যানের কচকচি যে আর্জেন্টিনার করা সবকটা গোলের ৭৭% ক্ষেত্রে মারাদোনার অবদান ছিল, ফিরে আসি তার বিশ্বকাপ জয়ী টিমের সতীর্থ ভালদানোর কথায়, “আমি যেটা বলতে চাইছি তা’হল এই যে ম্যাচ এর আগের দিন রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম এইজন্য নয় যে আমি মারাদোনার পাশে খেলছি আর ও হল সেই প্লেয়ার যা এমন কিছু করতে পারে যেটা আর কেউ পারবে না, এই কারণে ঘুমোতে পারতাম যে হেরে গেলে সবার চেয়ে বেশি দোষ পড়বে দিয়াগোর ঘাড়ে, দোষের বেশির ভাগ ও নিজের কাঁধে নেবে”।
না, স্রেফ গোল করার দক্ষতার জন্য নয়, সেটা বিবেচনা করলে পেলে আছেন, মেসি আছে, না, কেবল বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা নয়, সেটা বিবেচনা করলে ক্রুয়েফ আছেন, বেকেনবাউয়ার আছেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আছে, কিন্তু সবটা মিলিয়ে আছেন একজনই, পৃথিবীর সবচেয়ে খর্বকায় দানব যার কাঁধে গোটা টিমের ভার ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারেন পুমপিদো বুরুচাগা বাতিস্তারা। এই লোকটার নাম অমর হয়ে থাকবে যদ্দিন পৃথিবী নামক এই গ্রহে চারশো পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের চামড়া মোড়া একটা গোলাকে নিয়ে হাজার লক্ষ মানুষের উন্মাদনা থাকবে।
গরিব ঘর থেকে ফুটবল খেলে লাখোপতি হওয়ার অনেক গল্প আছে কিন্তু পৃথিবীতে আপাততঃ একজনই আছেন গরিব বাচ্চাদের জন্য চ্যারিটি ম্যাচে যার ডাকে রোনালডিনহো অবসর ভেঙে মাঠে নামতে রাজি হয়ে যান। কেন রাজি হবেন না বলুন তো। সেই ম্যাচে আনফিট থাকলেও হাইড্রোকর্টিশন ইনজেকশন নিয়ে নামবেন যে স্বয়ং দিয়াগো। দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে মাসল বাড়ানোর ইনজেকশন, ব্যথা কমানোর ইনজেকশন, ফোলা কমানোর ইনজেকশন নিয়ে নিয়ে শতছিদ্র শরীরটা নিয়েই মাঠে নামবেন দিয়াগো, সেই মারাদোনা যিনি দেশের হয়ে খেলার সময় কোনোদিন ক্লাবের স্বার্থে পা বাঁচিয়ে খেলেন নি। আমরা যেমন ভালোবাসি ওনাকে তেমনি আমাদেরও ভালোবাসেন, প্রচণ্ড ভালোবাসেন উনি।
এই ভালোবাসার কাহিনী শেষ হওয়ার নয়। পায়ের তলায় ছোট্ট পৃথিবীটাকে শেষবারের মতো নাচিয়ে আমাদের হাসিয়ে কাঁদিয়ে চলে গেছেন আপনি। আজ দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা মাঠে নেই, পৃথিবীতেই নেই। না থাকলেও বুকে থাকবেন চিরকাল। কোনও ক্লদিও জেন্টিলে-এর সাধ্য নেই আপনাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়ার। পৃথিবীটা ছিল, আছে, থাকবে আপনার পায়ের কাছে, যে পায়ে আঁকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নায়ক দাড়িওয়ালা ফিদেল-এর ছবি।
হ্যাপি বার্থ ডে দিয়াগো।
৩০শে অক্টোবর, ২০২৩