১)
উনিশশ’ একাত্তর সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বই খুলে গণ-টোকাটুকি হয়েছিল। পুরনো এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি তখন। রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল অন্যান্য বছরের দ্বিগুন ছেলেমেয়ে ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছে। আমার বন্ধু বাসুও তাইই। তারপরে বেশ কিছুদিন এমনকি নির্মেঘ রাত্রিতেও বাসু পাড়ায় চলাফেরা করত ছাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। লোকে দেখতে পেলেই জিজ্ঞেস করত, কীরে বাসু তুইও নাকি ফার্স্ট ডিভিসন?
★
২)
আমরা ১৯৭১এর হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচ।
আমরাও যাকে বলে টুকে পাশ করা ডাক্তার … আক্ষরিক অর্থেই। যে সে কাগজ দেখে টুকলি না। ক্লাসের ফার্স্টবয় থেকে লাস্টবয় অবধি সবাই খুল্লাম খুল্লা টুকেছিলাম বই খুলে। অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি পরীক্ষায়। সে কী হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। আমাদের পুরো ব্যাচে মোটে দু’জন টোকেনি, মহফাজুর খোন্দকার রহমান আর শুভাশিস সাহা।
আমাদের সিনিয়র ব্যাচগুলোও টুকেছিল। দাদা দিদি সবাই। কারও সেকেন্ড এমবিবিএস, কারও বা ফাইনাল এমবিবিএস।
ডাক্তারির বইগুলো এমনিতেই বেশ মোটা মোটা। এক্সামিনেশন হলটা ছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্লকের তিন তলায়। রোগা রোগা মেয়েগুলো অবধি চটের ব্যাগে করে ডান হাতে তিনটে বই মানে দশ কিলো আর বাঁ হাতেও আরও দশ কিলো বই নিয়ে মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠত সেই তিন তলায় পরীক্ষা দিতে।
অবশ্য তার জন্য রেজাল্ট যে খুব হেরফের হত তা না। সেই টোকাটুকির বাজারে ইউনিভার্সিটি নিয়ম করেছিল, মেডিকেল পরীক্ষার থিওরি খাতা যিনি দেখবেন তিনিই ওর্যাল প্র্যাকটিকাল নিতে আসবেন। ওর্যাল প্র্যাকটিক্যালে থিওরির সমান নম্বর। পরীক্ষকরা দ্বিতীয় মোলাকাতের সময় সেই অভিশপ্ত বই থেকে টোকা থিওরির খাতা সহ আসতেন। টুকে যে বেশি নম্বর পেয়েছে তার মৌখিক প্রশ্নও হত সেই মানের। উত্তর না দিতে পারলেই ডাহা ফেল।
যে গল্পটা বলতে চাইছি সে’টা একটু অন্যরকম। আমাদের ক্লাসে পড়ত মুক্তিশঙ্কর মাল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল রেজাল্ট। ক্লাসেও পড়াশুনোয় দুরন্ত। মোটেই আমাদের মত ফাঁকিবাজ না। মুক্তি যেদিন ক্লাসে যা পড়ানো হয়, সন্ধ্যে বেলায় পুরোটা বই থেকে পড়ে যাকে বলে আত্মস্থ করে ফেলে, একেবারে নিয়মিত। আর একটা কাজও করত মুক্তি সেই প্রথম দিন থেকে। সরু চিলতে কাগজে অত্যন্ত ছোট হাতের লেখায় পুরো পড়াটা লিখে ফেলত সেই দিনই। সেই কাগজ আবার বিশেষ কায়দায় ভাঁজ কড়া হত। মুক্তি আমাদের দেখিয়েওছিল কী ভাবে বাঁ হাতের মুঠোয় কাগজ রেখে সুপটু তর্জনী আর মধ্যমার সঞ্চালনে প্রায় জাদুকরের মত সমস্ত লেখাটা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। মুক্তি তার এই কাগজগুলো একেবারে নিয়মমাফিক বৈজ্ঞানিক কায়দায় গুছিয়ে রাখত তার টুকলি রাখার ট্রাঙ্কে। তার এই শিল্পকর্মের জন্য রীতিমত গর্বিত ছিল সে। আর আমরা ছিলাম অলস ঈর্ষাদগ্ধ গুণমুগ্ধের দল।
সন ১৯৭৫। মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা। আমরা উপায়হীন নির্লজ্জরা দল বেঁধে প্রতিটা পেপার বই খুলে টুকছি। সে টোকারও কোনও মাথামুণ্ডু নেই। আসলে বই দেখে টুকলে মাত্রাজ্ঞান থাকে না কোনও। পঁচিশ নম্বরের প্রশ্ন এসেছে Decerebrate Rigidity। সি সি চ্যাটার্জির বইয়ে এ ব্যাপারে আছে মোটে সাড়ে তিন লাইন। মাত্র সেইটুকুই টোকা হল। আর পাঁচ নম্বরের শর্ট কোশ্চেন ভিটামিন সি, বইয়ে আছে সর্বমোট পাঁচ পাতা। এক ঘণ্টা খরচ করতে হল সেটা টুকতে।
এই রকমের ঐতিহাসিক পরীক্ষা দিয়ে হতক্লান্ত আমরা বিজয় গৌরবে হোস্টেলে ফিরেছি। সবাই খুশি।
শুধু মুক্তিশঙ্কর একা মুখ চুন করে জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে, এরকম বই খুলে টোকা অত্যন্ত খারাপ… অন্যায়।
গত দু বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফসল তার অতিকায় শিল্পকর্ম এক ঝটকায় অর্থহীন হয়ে গেছে সহসা।
প্রসঙ্গত বলি, টোকাটুকির এই স্বর্ণযুগ ১৯৭৬ এর পর অন্তর্হিত হয়। সিদ্ধার্থ রায়ের আমলেই। আমাদের অ্যানাটমি পরীক্ষা ক্যান্সেলড্ হয়েছিল। নতুন করে পরীক্ষার সিট পড়ল ইউসিএমএর বাড়িতে। সব কলেজ একসঙ্গে। পুলিশ দিয়ে পকেট ও অন্যান্য জায়গা সার্চ করিয়ে ঢোকানো হয়েছিল, এমনকি মেয়েদেরও। আমরা পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাশও করেছিলাম।
★
পুনশ্চঃ- মূল লেখাটা কয়েক বছর আগেকার। লেখাটা পড়েই আমার কলেজের তিন বছরের ছোটো ভাই আর বন্ধু, চন্দন ঘোষ ফোন করে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। চন্দন অত্যন্ত ভালো ও মেধাবী ছাত্র। এভাবে পরীক্ষার কথা ও ভাবতেই পারে না।আসলে ওরা যখন কলেজে ঢুকেছে তদ্দিনে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে গেছে। সেই সুদিন অন্তর্হিত। যথার্থ পরীক্ষার দিন ফিরে এসেছে। আমরাও ফাইনাল এমবিবিএস আর এমডি তক সেই বিনা-টোকাটুকির পরীক্ষাই দিয়েছি।
এখনের প্রবল প্রতাপ মাঝি আর সেনরাও তাইই। না টুকে পরীক্ষা দিতে গিয়ে সাফারও করেছেন বেশ।
কিন্তু এঁরা তো প্রবল ছাত্রবন্ধু! আর এখন আবহাওয়াও অনুকুল। বস্তুত যদ্দুর জানি, এঁদের ইয়েও টুকে পাশ করা উকিল। এই ডাক্তারি স্টলওয়ার্টেরা পুরোনো দিন ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছেন তাই।