কাল ছিল মে-দিবস। শ্রমিকদের দিন। স্বাস্থ্যকর্মীদের শ্রমিক বলা যায় কিনা, প্রথাগত সংজ্ঞা অনুসারে তাঁরা শ্রমিক পদবাচ্য কিনা, সেসব আলোচনা তাত্ত্বিক-বিশেষজ্ঞরা করুন। কিন্তু আজ, এবছরের মে-দিবসে, অন্তত এই বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাস্থ্যশ্রমিক হিসেবেই দেখতে চাইছি।
নাকি কোভিডের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে নিজেদের সামনের সারিতে লড়াই করা যোদ্ধা বা সেনা হিসেবে দেখা উচিত? নাঃ, অতখানি ভেবে বসা হয়ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে – কেননা, যেকোনো যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর সুরক্ষা এবং সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের সামনে অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়ায় – এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা সেরকম বাড়তি সুবিধে তো দূর, উলটে অবহেলারই শিকার হচ্ছেন। অতএব, স্বাস্থ্যকর্মীরা বিষয়টি যেভাবেই দেখতে চান, বা নিজেদের অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চান, অন্তত রাষ্ট্রব্যবস্থা যে তাঁদের অপরিহার্য প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে দেখছেন না, এটুকু নিশ্চিত।
কাজেই, ওই শ্রমিক কথাটুকুই থাকুক – কেননা, এই বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা ঠিক তেমনভাবেই অবহেলিত। স্বাস্থ্যশ্রমিকরা শোষিত এবং নিপীড়িতও বটে, কিন্তু শব্দগুলো বহুলব্যবহারে এমন ব্যাঞ্জনাহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে – তাই অবহেলিত শব্দটুকুই থাকুক – এবং ঠিক শ্রমিকদের মতোই, রাষ্ট্র আপাতত তাঁদের ব্যবহার করে পরিত্যক্ত পাপোশে পরিণত করার বেশী কিছু ভাবতে চাইছেন না।
কেন এসব কথা বলছি? বলছি, কারণ, এই অতিমারী পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ দেখে অন্য কিছু ভাবার কথা মাথায় আসছে না।
নাহলে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে কোনো বিশেষ ব্যবস্থাপনা নেই কেন? নিজে বা পরিবারের কেউ এই অসুখে আক্রান্ত হলে, তাঁদের জন্য আলাদা কোনো সুযোগসুবিধে নেই কেন? এই অসুখে মারা গেলে বীমার যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিলেন, দেশের মৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবারের এমনকি দশ শতাংশও সেই বীমার অর্থ পাননি। স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিজনেরা টিকা পাননি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, অথচ ঘরের লোক কোভিড ডিউটি করার কারণে বাড়তি ঝুঁকি তাঁদেরও। স্বাস্থ্যপরিষেবা দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী অসুস্থ হলে, বা তাঁর পরিজন অসুস্থ হলে – তাঁদের চিকিৎসার জন্যে একটু বিশেষ ব্যবস্থার দাবি কি খুব অন্যায্য, বা খুব স্বার্থপরতা? কোভিডের দিনে বাড়তি কাজ করার সুবাদে রাজ্য সরকারি আমলারা একমাসের বাড়তি বেতন পেয়েছেন – সেখানেও স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা ভাবা হয়নি। এখন এই ভয়ঙ্কর সংক্রমণের মুহূর্তেও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাগ করে ডিউটি না করিয়ে একশ শতাংশ হাজিরার হুলিয়া কেন? তাঁদের যাতায়াতের ব্যবস্থা কেন সরকার শুরু করতে পারছেন না? পাব্লিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করে কোনো একজন স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত হয়ে বাকিদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে ফেললে, একলপ্তে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ঘরবন্দী হয়ে পড়লে নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল কেমন দাঁড়াবে?
তবে স্বাস্থ্যশ্রমিকরা কি সম্মান বা স্বীকৃতি একদমই পেলেন না? না, এমন অভিযোগ ঠিক নয়। সরকারবাহাদুর বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্বাস্থ্যশ্রমিকরা সুপার-হিউম্যান – তাঁদের শরীরের ক্রিয়াকলাপ ফিজিওলজি বায়োলজি, এমনকি তাঁদের শরীরে ভাইরাসের ক্রিয়াকলাপও সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনুন, কোভিডে আক্রান্ত হলে বাকিদের জন্য দুসপ্তাহের নিভৃতবাস জরুরী হলেও দিল্লির সরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সেই বিশ্রাম নামিয়ে এনেছেন দশদিনে – সরকারিভাবেই – লিখিত অর্ডারের মাধ্যমে।
আর অলিখিত? একটি ঘটনা বলি, শুনুন। বন্ধুপুত্র দিল্লির এইমস-এ পাঠরত। তার হস্টেলের অনেকেই কোভিড-আক্রান্ত – এমনকি রুমমেট কোভিড নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বন্ধুপুত্রেরও উপসর্গ শুরু হয় – গায়ে হাতেপায়ে ব্যথা ইত্যাদি। উপরমহল থেকে নির্দেশ আসে, খবরদার, জ্বর না এলে টেস্ট করানো চলবে না। এবং বাকি উপসর্গ অগ্রাহ্য করেই হাসপাতালে ডিউটি করতে হবে। দুদিন বাদে জ্বরও আসে। এবার টেস্ট হয় – প্রথমদফার রিপোর্ট নেগেটিভ। ডিউটি চলতেই থাকে। অসুস্থতার কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি হলে টেস্ট আরেকবার হয় – এবারে রিপোর্ট পজিটিভ।
আজ মে দিবসে, রিপোর্ট পজিটিভ আসার সাতদিনের মাথায় তাকে ডিউটিতে জয়েন করতে বলা হয়েছে – জ্বর আপাতত নেই, কাশি রয়েছে রীতিমতো, সাথে ভয়ানক দুর্বলতা – কী বলবেন? তাকে কি নিপীড়িত শ্রমিক হিসেবে ধরা যাবে? নাকি ডাক্তার বলেই… স্বাস্থ্যকর্মী বলেই…
মার্জনা করবেন, মে-দিবসে চক্ষুলজ্জা ছেড়ে স্বার্থপরের মতো নিজেদের কথাই বলছি। আসলে, সবার জন্য স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যখাতে আরো বেশী সরকারি বরাদ্দ, সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা, মজবুত স্বাস্থ্যপরিকাঠামো এসব নিয়ে অনেক বললাম – বলেই চললাম – আপনাদের মধ্যে কজন আর সেসব দাবিদাওয়ায় গলা মেলালেন!! আর যে দাবিগুলো সবার জন্যে, সেগুলোতেই যখন পাশে দাঁড়াতে পারলেন না – তাহলে আমাদের কথাগুলো আমাদের হয়ে আর কেউ বলতে আসবেন, এমন আশার যুক্তি কতটুকু!!
সব স্বার্থ পর হয় না।