মি টু ড্রাগ (Me too drugs)-এর বাংলা কি হবে? আমিও ওষুধ! বহু প্রচলিত, পরিচিত একটা ওষুধের গঠনে সামান্য পরিবর্তন এনে যে বা যেসব ওষুধ তৈরি করা হয়, তাদের বলে মি টু ড্রাগস। এই ওষুধগুলো কতটা দরকারী?
আগে পেপটিক আলসারের চিকিৎসা হত এন্টাসিড দিয়ে। আশির দশকে বাজারে এল সিমেটিডিন (cimetidine)। যে গোত্রের ওষুধ তাকে বলা হয় এইচ টু ব্লকার (H2 blocker)—হিস্টামিন ২ জৈব-গ্রাহকের কাজ আটকে এরা পাকস্থলীর এসিড উৎপাদনকারী কোষগুলো থেকে এসিড ক্ষরণ কমায়। সিমেটিডিন খেতে হত দিনে চারবার। একই গোত্রের র্যানিটিডিন (ranitidine) বাজারে আসায় চিকিৎসা সহজতর হল, র্যানিটিডিন দিনে দুবার খেলেই চলে। তারপর এল ফ্যামোটিডিন (famotidine), নিজাটিডিন (nizatidine)।
উচ্চরক্তচাপ কমায়, হার্টের গতিও কমায় বিটা-ব্লকারগুলো (Beta-blockers)। প্রথমে আবিষ্কৃত প্রোপ্রানোলল (propranolol) উচ্চরক্তচাপ কমাতে গেলে দিনে দুবার বা তিনবার খেতে হয়। একই গোত্রের অ্যাটেনেলল (atenelol) এল, তা দিনে একবার খেলেই চলে। এখন একই গোত্রের অ্যাসিবুটল (acebutol), বিটাক্সোলল (betaxolol), বিসোপ্রোলল (bisoprolol), এসমোলল (esmolol), মেটোপ্রোলল (metoprolol), নাডোলল (nadolol), নেবিভোলল (nebivolol), পেনবুটোলল (penbutolol), সোটালল (sotalol)। এই গোত্রেরই কার্টিওলল (carteolol), ল্যাবেটালল (labetalol), পিন্ডোলল (pindolol) বাজারে এসেও চলে গেছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি বা কম কাজের বলে। টিমোলল (timolol) উচ্চরক্তচাপ কমানোর জন্য আর ব্যবহার করা হয় না, করা হয় গ্লকোমায় চোখের চাপ কমাতে।
উচ্চরক্তচাপ কমানোর আরেক গোত্রের ওষুধ ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকারগুলো (calcium channel blockers)। নিফেডিপিন (nifedipine) প্রথম ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, খেতে হত দিনে তিনবার। এল অ্যাম্লোডিপিন (amlodipine), যা দিনে একবার খেলেই চলে। তারপর এসেছে অ্যারানিডিপিন (aranidipine), অ্যাজেলনিডিপিন (azelnidipine), বার্নিডিপিন (barnidipine), বেনিডিপিন (benidipine), ক্লিনিডিপিন (clinidipine), ক্লেভিডিপিন (clevodipine), ইসরাডিপিন (isradipine), এফোনিডিপিন (efonidipine), ফেলোডিপিন (felodipine), ল্যাসিডিপিন (lacidipine), লেরকানিডিপিন (lercanidipine), ম্যানিডিপিন (manidipine), নিকার্ডিপিন (nicardipine), নিলভাডিপিন (nilvadipine), নিমোডিপিন (nimodipine), নিসোল্ডিপিন (nisoldipine), নিট্রেন্ডিপিন (nitrendipine), প্রানিডিপিন (pranidipine)।
উচ্চরক্তচাপ কমানোর আরেক গোত্রের ওষুধ এসিই ইনহিবিটর (ACE inhibitor)—এই গোত্রের প্রথম ওষুধ এনালাপ্রিল (enalapril)। এখন বাজারে আছে আরও বেনাজেপ্রিল (benazepril), ক্যাপ্টোপ্রিল (captopril), ফসিনোপ্রিল (fosinopril), লিসিনোপ্রিল (lisinopril), ময়েক্সিপ্রিল (moexipril), পেরিন্ডোপ্রিল (perindopril), কুইনাপ্রিল (quinapril)।
রক্তে কোলেস্টেরল আর কিছুটা ট্রাইগ্লিসারাইড কমায় স্ট্যাটিনগুলো (statins)। অ্যাটরভাস্ট্যাটিন (atorvastatin) প্রথম ওষুধ, তারপর আসে ফ্লুভাস্ট্যাটিন (fluvastatin), লোভাস্ট্যাটিন (lovastatin), প্রাভাস্ট্যাটিন (pravastatin), রোসুভাস্ট্যাটিন (rosuvastatin), সিমভাস্ট্যাটিন (simvastatin), পিটাভাস্ট্যাটিন (pitavastatin)।
গল্প শুরু করেছিলাম পেপ্টিক আলসারের ওষুধ নিয়ে। শেষও করব পেপ্টিক আলসারের আরেক গোত্রের ওষুধ নিয়ে। মাসে একদিন আমি মেডিকাল ক্যাম্প করি জলপাইগুড়িতে, জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে। ডিসেম্বরে এক মহিলা দেখাতে এলেন পেপ্টিক আলসারের উপসর্গ নিয়ে, ভিক্ষাউপজীবিনী। কোন এক প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার তাঁকে দামী এক ওষুধ খেতে দিয়েছেন—ইলাপ্রাজোল (ilaprazole)। ওষুধের ফর্মুলারীতে নাম খুঁজে পেলাম না, খুঁজে পেলাম না নেটেও। নাম থেকে বুঝলাম ওষুধটা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (proton pump inhibitor)। আমরা ব্যবহার করি এই গোত্রের ওমিপ্রাজোল (omeprazole)। তাছাড়া আছে ল্যান্সোপ্রাজোল (lansoprazole), ডেক্সল্যান্সোপ্রাজোল (dexlansoprazole), র্যাবিপ্রাজোল (rabeprazole), প্যান্টোপ্রাজোল (pantoprazole), এসওমিপ্রাজোল (esomeprazole)। ওমিপ্রাজোলের চেয়ে অনেকগুণ দামী ইলাপ্রাজোল. মনে হয়, সবে বাজারে এসেছে, ডাক্তারবাবুকে বুঝিয়ে গেছেন মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভ আর তিনি লেখা শুরু করে দিয়েছেন রোগীর পকেটের কথা না ভেবেই।
কেন একই গোত্রের এতো ওষুধ, যাদের কাজে ফারাক নামমাত্র?
মনে রাখবেন ওষুধ কোম্পানী ওষুধ তৈরী করে মুনাফার জন্য। চাইলেই তো নতুন ওষুধ পাওয়া যায় না। ১০০ টা ওষুধ-পদপ্রার্থী রাসায়নিক নিয়ে কাজ করলে তার মধ্যে গড়ে মাত্র ১টা রাসায়নিক ওষুধের সম্মান পায়। নতুন ওষুধকে বাজারে আনতে ওষুধ পিছু খরচ পড়ে গড়ে ৫০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। একটা নতুন ওষুধকে বাজারে আনতে সময় লাগতে পারে ১৫ বছর অবধি, তার মধ্যে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য ১০ বছর অবধি।
একটা ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পর আবিষ্কারক কোম্পানীর পেটেন্ট থাকে একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি, সেই সময়ে ওষুধটাকে নিয়ে ইচ্ছে মতো ব্যবসা করা যায়, ইচ্ছে মতো দাম রাখা যায়। পেটেন্টের সময় সীমা পেরোলে অন্য কোম্পানীগুলোও সেই ওষুধ তৈরী করে বাজারে আনতে পারে। প্রতিযোগিতায় তখন দাম কমে, লাভের হারও কমে। বেশি মুনাফার জন্য ওষুধ কোম্পানীর তাই চাই নতুন নতুন ওষুধ।
এবার মনে করুন একটা রাসায়নিক ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত—কার্যকর, পার্শ্বপ্রিতিক্রিয়া কম। আগের উদাহরণগুলোতে যেমন—সিমেটিডিন, প্রোপ্রানোলল, নিফেডিপিন, এনালাপ্রিল, অ্যা টরভাস্ট্যাটিন বা ওমিপ্রাজোল। এদের অণুতে সামান্য পরিবর্তন করলে কার্যকারিতা একই রকম থাকবে, কিন্তু তা হবে নতুন ওষুধ—যাতে বেশি বেশি লাভ করা যাবে বেশ কিছু কাল।
এই নতুন ওষুধগুলোর কিছু অবশ্যই লাভদায়ক। সিমেটিডিন যেখানে দিনে চারবার খেতে হতো, সেখানে র্যানিটিডিন দুবার খেলেই চলে, র্যানিটিডিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। প্রোপ্রানোলল বা নিফেডিপিন উচ্চরক্তচাপের ওষুধ হিসেবে দিনে তিনবার খেতে হলেও অ্যাটেনেলল আর অ্যাম্লোডিপিন খেতে হয় দিনে একবার।
কোনও এক গোত্রের প্রথম যে ওষুধ আবিষ্কৃত হয়, তাকে বলা যায় ব্রেক থ্রু ড্রাগ (break through drug) আর ব্রেকথ্রু ড্রাগের অণুতে সামান্য পরিবর্তন এনে যে নতুন ওষুধগুলো তৈরি করা হয় সেগুলোকে বলা যায় মি টু ড্রাগস।
ওষুধ কোম্পানী নানান যুক্তিতে মি টু ড্রাগসগুলোকে চালায়, ব্রেক থ্রু ড্রাগস-এর চেয়ে কার্যকারিতা বেশি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, রোগীর জন্য সুবিধাজনক, যে রোগীদের ক্ষেত্রে প্রথম ওষুধটা কাজ করছে না সে ক্ষেত্রে কাজ করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। যে তিনটে উদাহরণ দিলাম—অর্থাৎ সিমেটিডিন থেকে র্যানিটিডিন, প্রোপ্রানোলল থেকে অ্যাটেনেলল, নিফেডিপিন থেকে অ্যাম্লোডিপিন—তাছাড়া উদাহরণের বাকী মি টু ড্রাগগুলোর ক্ষেত্রে এসব যুক্তি খাটে না।
অসুবিধা আরও আছে। ওষুধের যুক্তি সঙ্গত ব্যবহারের জন্য কেবল ওষুধের নাম আর মাত্রা জানলেই চলে না, তাছাড়াও জানতে হয়ঃ
- ওষুধটা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়,
- কি কি রূপে পাওয়া যায়,
- কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলবেই না,
- কোন কোন ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে,
- গর্ভাবস্থা বা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের দেওয়া যাবে কিনা,
- অন্য ওষুধের সঙ্গে ব্যবহার করলে কোন অসুবিধা আছে কিনা,
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি,
- কিভাবে ওষুধটা কে রাখতে হবে।
২০২১-এর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকায় আছে ৪৭৯ টা ওষুধ। ২০২২-এ প্রকাশিত ভারতের অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকায় আছে ৩৮৪ টা ওষুধ। যে কোন একটা তালিকার সব ওষুধ সম্পর্কেই যদি একজন মানুষকে মনে রাখতে হয় তাহলেই তা কষ্টকর। তার ওপর একই গোত্রের একাধিক, অনেক ক্ষেত্রে বহু ওষুধ সম্পর্কে যদি জানতে হয় তাহলে অবস্থাটা কেমন হবে ভেবে দেখুন!