এক
সে অনেকদিন আগেকার কথা|
বাবার শ্রাদ্ধের কাজ মিটে যাবার পর বসে আছি বারান্দায়| রজনীগন্ধার স্তুপে ঢেকে যাওয়া ফটোটা ঘরে নিয়ে যাবো ভাবছি| তখনি সে ডাকলো| আমারে এট্টু আগাইয়া দিবা বাবু| দেখলাম খাবার-টাবার পুটলি বেঁধে পানখাওয়া কালো দাঁত বের করে সে অপেক্ষায়| যশোদা বুড়ি| অনুষ্ঠান বাড়িতে পাতা টাতা পরিষ্কার করে| সারাদিন এখানেই ছিল| রাস্তায় যেতে যেতে কথা হয়| টুকুর টাকুর গল্প| বাড়িতে তাঁর দুইখানা নাতি নাতনি|ছেলেটা অর্ধোন্মাদ| কোনোদিন বাড়ি ফেরে, কোনোদিন শুয়ে থাকে রেলস্টেশনে|বৌটা চলে গেছে কোথায়| অভাবের সংসারে পাগল স্বামী নিয়ে কেইবা থাকতে চায়!
তা তুমি তো রোজই অনুষ্ঠান বাড়ি, এ বাড়ি সে বাড়ি করে বেড়াও তোমার নাতি নাতনিদের কে খাবার করে দেয়?
নাতনিডা শেয়ানা হৈছে|এট্টু আধটু পারে| আর রাইতে খাবার নিয়া আসি| বুড়ির নিশ্চিন্ত উত্তর|
রাত তখন এগারোটার বেশি| পোঁটলা কাঁধে যশোদা বুড়ি| তার ফোকলা পানখাওয়া দাঁত| অর্ধ-নোংরা থান চাদর| সাথে আমরা দুজন| আমি আর এক ভাই| বাড়িতে অপেক্ষায় দুইখান কি তিনখান পেট| হালকা শীতে কুয়াশায় মায়াবী রোডলাইট| টুপটাপ শিশির|
রাস্তাটা খুব বেশি নয়| মাত্র মিনিট পাঁচেকের হবে| যখন পৌছুলাম তার উঠোনে রাত এগারোটা পার হয়ে গেছে| ফেব্রুয়ারীর হালকা হালকা শীত| উঠোনের একপাশে মাটির ঘর |কঞ্চির বেড়া দেওয়া বারান্দা| টিম টিম করে জ্বলা একটা লাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের একটা মেয়ে| বারান্দার সামনে| পাশের মাদুরে কিশলয় সহজপাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বড়োজোর পাঁচ বছরের একটা ছেলে ঘুমিয়ে কাদা| আমরা দাঁড়াইনি বেশিক্ষণ| তবে ফেরত আসতে আসতে স্পষ্ট শুনেছি| কিরে ওঠ .. খাবিনা ওঠ …
শুনতে পাই ছেলেটার বাচ্চাবাচ্চা উচ্চারণ ..ঠাকমা কি আনছো আইজ ….|
ফেরার সময় রাস্তায় পুরো সময়টা নির্বাক ছিলাম| আগে জানলে নিশ্চই আগেই পাঠিয়ে দিতাম খাবার| অথচ প্রতিদিন তো এভাবেই খায় ওরা| নেমন্তন্ন বাড়ির ফুরিয়ে আসা রয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাবারের পাচন ওরা খায়| অপেক্ষায় থাকে| হয়তো তৃপ্তি করেই খায়| খিদের পেটে ঝলসানো রুটিও গরম তন্দুরী|
এরপর অনেকদিন এই ছবিটা তাড়া করেছে আমায়| সভ্যতার এতগুলো দিন পরেও কাউকে কাউকে অপেক্ষা করতে হয় এভাবে| অনুষ্ঠান বাড়ির টেবিলে টেবিলে আধখাওয়া তন্দুরী চিকেন ডাস্টবিনে ফেলতে ফেলতে এই খিদে, অপেক্ষারত নাতি নাতনি ..এদের কথা হয়তো মনেও পড়ে তার| যশোদাবুড়ির|
দুই
লক ডাউন তখন উঠেছে দেশ জুড়ে| পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরে আসছে করোনা সঙ্গে নিয়ে| কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো বাঁশ দিয়ে বেড়া দিচ্ছে লোকজন| হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে অমুকের ছেলে মহারাষ্ট্র থেকে এসে বাড়িতেই ছিলো| কোয়ারেন্টাইনে রাখার পর টেস্ট রিপোর্ট পসিটিভ| দাগী আসামির মত তাকে গাল দিচ্ছে টপিক খুঁজে পাওয়া লোকজন| মোড়ে মোড়ে শারীরিক দূরত্বের মাথায় আগুন দিয়ে এইসব পিএন পি সি চলছে মাস্কবিহীন| মোবাইলে ফোন করলেই শোনা যায় ধীরে ধীরে অনলকিং-এর গান| আমার হাসপাতালের ওপরের ঘরগুলো বিকেল পার হলে খাঁ খাঁ করে| এতদিন গমগম করতো সন্ধ্যায়| চা বানিয়ে খাওয়াতো ফার্মাসিস্ট অভিরূপ| কম্পিউটারে কাজ করতে করতে চিৎকার করতো রবিবাবু| কিহলো ..বলও ..| কথায় কথায় এটা বলা তার মুদ্রাদোষ| উদ্ভট ভঙ্গিতে বব ডিলন গাইতো অভিরূপ| আর রান্না ঘরের পাশ দিয়ে কেউ গেলেই লেজটাকে আদুরে ভঙ্গিতে নাড়াতে নাড়াতে সে বলতোঃ ম্যাঁও|
সে আমাদের লকডাউনের অতিথি| কোথা থেকে হঠাৎ করে এসে পড়া বেড়াল|অভিরূপ তাঁর নাম দিয়েছিলঃ টিনটিন| হোমসার্ভিসের স্বপনদা একটা লাল প্লাস্টিকের গামলা টাইপের দিয়েছিল টিনটিনের জন্য| যা খাওয়া হতো লাল গামলায় ভাগ পেতো টিনটিন| কিন্তু লকডাউন শেষ হতেই সব্বাই বাড়ি থেকেই ডিউটি করে| ওপরটা এখন ফাঁকা|
এমনি একদিন নাইট ডিউটি| রাত এগারোটায় লাঞ্চ সেরে এঁটোকাঁটা রাখবো বলে বাথরুমের পাশটায় হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনলামঃ ভীরু ভীরু| মৃদু| অথচ অপেক্ষার|অনুরোধের| মিয়াঁও ….আরে টিনটিন যে!
কিরে কোথায় ছিলি য়াদ্দিন ??
কেউ তো সবসময় থাকে না ওপরে| সত্যিই তো কোথায় খায় সে এখন!
যত্ন করে খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো ..মাছের মাথা ..কাটা ফাঁটা রাখি| আজ কিছু রাখিনি রে|ভুলেই গেছিলাম তোর কথা|
টিনটিন যত্ন করে খায়| কাঁটা ফাঁটা কটোর মটোর চেবায়| লেজটা নাড়তে নাড়তে বলে ম্যাঁও| খিদের একটা ডাকনাম হয়তো ম্যাঁও|
আমার যশোদাবুড়ির সেই নাতিনাতনিদের কথা মনে পরে হঠাৎ|এই করোনা কালে অনুষ্ঠান নেই| বিয়ে বাড়ি নেই| যশোদা বুড়ির নাতি নাতনিদের এখন আর অপেক্ষায় থাকতে হয় না!
তবু আমার কানের সামনে বাজে মিঁয়াও …ঠাকমা কি আইনছো আইজ ….