(এ প্রবন্ধটির একটি সংক্ষেপিত এবং ভিন্ন ভার্সন আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয় হিসেবে ৪.১১.২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল।)
১৬ অক্টোবর, ২০২২ তারিখে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের নেতৃত্বে এমবিবিএস পড়ার জন্য হিন্দিতে মেডিক্যাল টেক্সট বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন অমিত শাহ। উদ্বোধন উপলক্ষে এক জনসভায় তিনি এ ঘটনাকে একদিকে “পুনর্জাগরণ এবং পুনর্গঠন”, অন্যদিকে “ব্রেন ড্রেন” থেকে, প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, “ব্রেন গেন” হবে। তিনি জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার সবক্ষেত্রেই এবার পড়ানো, প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষা ইত্যাদি সবকিছুই আঞ্চলিক ভাষায় হবে। কিন্তু এখানে শঙ্কিত মনে প্রশ্ন জাগে, যেভাবে হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে তাতে আঞ্চলিক ভাষা বললেও বকলমে কার্যত সেটা হিন্দিতে পর্যবসিত হবে নাতো?
প্রশ্ন উঠবে, আঞ্চলিক ভাষায় মেডিক্যাল বা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার টেক্সট বই লেখা হলে সমস্যা কোথায়? আপাত দৃষ্টিতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। মাতৃভাষায় মেডিসিনের চর্চার (ইংরেজিতে ভার্নাকুলারাইজেশন) উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০০ বছরেরও বেশি আগে। মেডিক্যাল টেক্সটের ক্ষেত্রে বাংলার সাথে সাথে তামিলনাড়ু, কেরালা কিংবা হিন্দিভাষী অঞ্চলও পেছিয়ে ছিলনা। বিস্তৃত আলোচনা ব্যতিরেকে দুয়েকটি তথ্য উল্লেখ করা যায়। ১৮১৯ সালে বাংলায় শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হল উইলিয়াম কেরির বড় পুত্র ফেলিক্স কেরির লেখা বিদ্যাহারাবলী (বাংলায় প্রথম অ্যানাটমি চর্চার বই)। খোদ উপনেবেশিক কর্তাদের ইচ্ছেয় প্রধানত সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত আধা-চিকিৎসকের ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলা, উর্দু, নাগরি এবং ফার্সিতেও মেডিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হত। ভারতে আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য প্রথম যে স্কুল তৈরি হয়েছিল – নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন – সেখানে এই চারটি ভাষাতে শিক্ষা দান করা হত।
এমনকি মেডিক্যাল কলেজেও ইংলিশ ক্লাসের সাথে কিছুদিনের জন্য “হিন্দুস্তানি ক্লাস”ও খোলা হয়েছিল। আমরা নজর করলে বুঝবো, দুধরণের ভার্নাকুলারাইজেশন চালু হল। একদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাবল্যের সময়ে ভারতীয়দের তরফে ইংরেজি বইগুলোর (মেডিক্যাল টেক্সটের কথাই শুধু আলোচনায় রাখছি) আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ শুরু হল, এবং অন্যদিকে ছিল ইংরেজ শাসকের তরফে আঞ্চলিক ভাষায় মেডিক্যাল টেক্সটের অনুবাদ করে পাশ্চাত্যের জ্ঞানকে আরও বেশি ভারতীয়র কাছে গ্রহণযোগ্য করে শাসন পদ্ধতির বনিয়াদ মজবুত করার চেষ্টা। ইংরেজি মেডিক্যাল টেক্সটে ব্যবহৃত ডায়াগ্রামগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দ প্রতিস্থাপিত হল সংস্কৃত, তামিল, বাংলা, হিন্দি বা মালয়ালী প্রতিশব্দ দিয়ে – প্রমাণ করা যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী আয়ুর্বেদে প্রাচীন কাল থেকেই অ্যানাটমি, ফিজিওলজি এমনকি ব্যাক্টেরিয়োলজির উন্নত জ্ঞানও মজুত ছিল।
উভয়ক্ষেত্রেই যা লক্ষ্যণীয়ভাবে দৃশ্যমান তা হল মৌলিক গবেষণার কোন স্পৃহার অনুপস্থিতি। ব্রিটিশের তরফে সামরিক প্রয়োজন মেটানো এবং শিক্ষার খরচ বাঁচানো এ দুটি ছিল মূল তাগিদ এবং ভারতীয়দের তরফে হিন্দুত্বের আদি গৌরব বর্ণনা। খেয়াল করা দরকার, সেসময়ের হিন্দুত্বের চরিত্র বহুভাষিক প্রকৃতির ছিল – যেমন, বাংলা, হিন্দি, তামিল, মালয়ালী ইত্যাদি ছিল। এ সব ভাষাতেই ভার্নাকুলার মেডিক্যাল টেক্সট তৈরি হয়েছে।
নীচের কয়েকটি চিত্র বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করবে।
(এই চিত্রগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে সাধারণ ইংরেজি মেডিক্যাল টেক্সটের থেকে ডায়গ্রামগুলো নির্দ্বিধায় তুলে নিয়ে, “টুকে” বললে আরও যথার্থ হয়, তার পাশে হিন্দি, বাংলা, তামিল বা সংস্কৃত প্রতিশব্দ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটা বোঝানোর চেষ্টা খুব স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে যে আয়ুর্বেদের প্রাচীন টেক্সটে যেন এ সমস্ত অপ্রকম্পিত জ্ঞানরাজি কেবলমাত্র আধুনিক সময়ে ব্যবহৃত হবার অপেক্ষায় মজুত হয়ে ছিল।)
আমরা এখানে জাপানের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করতে পারি। প্রধানত মেইজি রাজত্বকালে অর্থাৎ উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে জাপানে ভার্নাকুলারাইজেশন আলাদা গতিবেগ পায়। জাপানি ভাষায় মেডিক্যাল শিক্ষা শুরু হয়। ভার্নাকুলারাইজেশনের ক্ষেত্রে ভারতের সাথে জাপানের একটি মূলগত প্রভেদ একেবারে গোড়া থেকেই ছিল। ও দেশে নতুন পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য মেডিসিনের জ্ঞান আহরণ করলেও এর মূল চালিকা শক্তি ছিল নতুন গবেষণার অভিমুখে যাত্রা করা। ইউরোপীয় জ্ঞানের আত্মীকরণের কয়েক দশকের মধ্যে ১৮৯৪ সালে প্লেগের জীবাণু আবিষ্কারের অন্যতম দাবিদার একজন জাপানি গবেষক কিতাসাতো।
পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে আহরণ করার জন্য যে নতুন ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন সে ব্যাপারে জাপানে মূলত তিনটি প্রশ্নকে বিবেচনায় রাখা হয়েছিল – (১) বিশেষ অভিষ্ট লাভের জন্য ভাষা শিক্ষা, (২) ভাষা শিক্ষার লক্ষ্যে ভাষা শিক্ষা, এবং (৩) জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য ভাষা শিক্ষা। ভাষা শিক্ষার সঙ্গে মৌলিক ভাবনা এবং গবেষণার রাষ্ট্রিক উৎসাহের বাস্তব ফলাফল হল ১৮৯৭ সালে ডিসেনটেরির জীবাণুর জাপানি আবিষ্কারক শিগা কিয়োশি – যাঁর নামে “শিগেলোসিস” রোগের নামকরণ হয়েছে। ১৯০১ সালে মানব দেহের অ্যাড্রেনালিনকে গবেষণাগারে প্রথম পৃথকভাবে তৈরি (extract) করেছিলেন জাপানি গবেষকেরা। ১৯৪৯ সাল থেকে ধরলে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি নোবেলজয়ী রয়েছে জাপানে। বিজ্ঞানে ২০১৬ সাল অব্দি নোবেল জয়ের তালিকায় আন্তর্জাতিকভাবে পঞ্চম স্থানে রয়েছে জাপান। ২০০০ সালের পরের হিসেব বলছে আমেরিকার (৫৯) পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে জাপান (১৬)।
আমাদের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে ডাক্তারি কি কেবল রোগ নিরাময় এবং অর্থোপার্জনের পথ? সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসক এ পথের পথিক। কিন্তু যে স্বল্পসংখ্যক মেধাবী চিকিৎসক গবেষণা করতে চান তাঁরা রাষ্ট্রিক উদ্যোগে গবেষণা করবেন কোন ভাষায়? জ্ঞানের আন্তর্জাতিক জগতের সাথে যোগাযোগই বা রক্ষিত হবে কিভাবে? শিক্ষার গোড়া থেকেই গবেষণা-স্পৃহা বিনষ্ট হবে কি? হয়তো রাষ্ট্র একেবারেই চায় না কোন মৌলিক গবেষণা বা চিন্তা জন্ম নিক। কার্যত একদল মেডিক্যাল কেরানী বা এডুকেশনাল ম্যানেজার তৈরি হবে – চোখে বিজ্ঞান-সাধনার কোন স্বপ্ন নেই, চিন্তায় “কেন” প্রশ্ন নেই। যেভাবে রাষ্ট্রের তরফে গবেষণার জন্য ব্যয়বরাদ্দ ক্রমাগত ছাঁটাই হচ্ছে তাতে এ আশংকা আরও গাঢ় হয়। এ পথে “ব্রেন ড্রেন” থেকে “ব্রেন গেন” সত্যিই হবে তো?
নীচের তুলনামূলক টেবিলটি অনেক কথা বলেছে।
দ্য ফার্মাসিউটিকাল জার্নাল-এর ২০১৫ সালের একটি তথ্য এরকম।
(Data from clinicaltrials.gov show that 1.4% of global clinical trials are currently carried out in India compared with 3.2% in China, 1.5% in the Czech Republic, 1.0% in Turkey, and 0.9% in Thailand. Half of all trials being conducted worldwide are based in North America, with the UK hosting 5.5% of trials – data retrieved on 11/03/2015).
অনবদ্য় লেখা –
Jayanta Bhattacharya thank you.Anywhere in Indian subcontinent Essentially and Virtually we all practice our profession while speaking in and explaining to patients mostly in local language .So we are all bi or tri lingual in our professional practice. I wonder, Perhaps those books in CMC ( Hindustani) were meant for British Doctors – I am not sure .
However in a Multilingual country like India with practice of minimum 25 state owned languages ,attempt of educating Medicine / Engineering etc without a common language ( here English) will be very complicated and exhausting in my opinion.
In Germany , France or Japan etc it was possible because they have one language all over the country . And mostly all of them learn English as second or third language in their school days . Moreover the letters and scripts of their own languages are the same as English . So atleast they can have some level of understanding while dealing with English speaking people .And they are able to read. Here in India certainly many of us can not read Malaywalam or Tamil scripts or Gurumukhi scripts .I do not feel confident about How teaching in state languages will be successful.
Are all those fundamental ,Almighty books like Harrison, Robbins, Bailey -Love ,Davidson been translated in 25 local state languages already !! I doubt .
অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনার সান্নিধ্যে অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে । আপনি প্রমাণ করেছেন ডাক্তারি শুধু অর্থোপার্জনের পথ নয় । আপনার মত চিকিৎসক এবং গবেষক আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের অত্যন্ত আবশ্যক। প্রণাম জানাই প্রচেষ্টা ও অবদানের।
Dear Jayanta — cannot agree more with you . There are many pseudo nationalistic spirit — purely on vested interest — that works behind this idea.To tell the truth — the breeding ground of this policy — was Bengal (Calcutta Vaidya Samaj Particularly — led by my own great,great, great maternal Grandfather Bamboo Cheif Dewan Ram Comal Sen of Sankibhamga area of Central Calcutta) — who fought tooth and nail against abolition of NIM and establishment of Calcutta Medical College and even against the transformation of Hindu College to Presidency College. Ram Comal Sen’s aversion to Benting’s abolition of ‘sati daha pratha’,direct involvement in removal of De Rosio from faculty of Hindoo College,treating derisively Madhusudan’s natural poetic ability ( to him :Madhu’s Jessore Bangla is not suitable to literary Bengali — first recorded derive stance of ill famous Ghati -Bangal discordant mental state of Banglar North Calcutta Baboo Samaj )— are historical truth as most expressive progenitive retrogate religion centric mentality — which has morphed into todays’ — Pan Indian Pseudo Nationalistic feature in every way of life.Sometimes I feel deeply — the famous remark of Tilak’s statement — WHAT BENGAL THINKS TODAY — INDIA WILL THINK TOMORROW — was well masked derisive remark or otherwise! ! In this context I like to point out — as opposed to Ram Comol’s most conservative view — Pandit Dr. Madhusudan Gupta of Baidyabati –was a close relation of Ram Comal.
x
আজকাল আমরা অনেক কিছুই নেট সার্চ করে বার করি কিন্তু হিন্দিতে সারা জীবন পড়াশোনা করলে কি ভাবে সেটা সম্ভব? ইংরেজির ওপর তো আইডিয়াই তৈরি হবে না।কোন রেফারেন্স বই কি করে ঘাঁটবে? জ্ঞানের পরিধি হয়ে পড়বে অনেক সংকীর্ন
অসাধারণ লেখা। এবং প্রতিটি যুক্তির সঙ্গে আমি সহমত
পড়লাম। দেরি হলো। সূচনাতে বর্তমান ভারত শাসকের অন্যতম কেষ্টবিষ্টু মহাশয় যে আঞ্চলিক ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ার কথা বলেন, কোন সংশয় নেই তা আসলে হিন্দি ভাষার কথাই বলাহল। আর অন্তিমে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষাকাঠামোয় গবেষণা ও আন্তর্জাতিক মানের কথা ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ঘটনাহল বর্তমানে পন্যায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থায়, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেই গবেষণা করে যাতে তার লাভক্ষতি আছে।উদ্বৃত্ত উৎপাদন হতে পারে।আর সব শিক্ষার একটা মান থাকা দরকার। সেখানে শিক্ষার নামে, আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের অপবিজ্ঞান পাঠ্যসূচীতে ঢোকালে বিপদ বাড়বে। এই আশঙ্কার সাথে সহমত।তথ্যসমৃদ্ধ লেখা সমৃদ্ধ করল আমাকে।
ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যের লেখাটি পড়ে অনেক ভাবনার উদ্রেক হোল। ডাঃ দেবারতি চক্রবর্তীর মন্তব্যও প্রাসঙ্গিক। আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষিত মেধাবী কিশোর-কিশোরীরা যখন চিকিৎসাবিদ্যা শেখা শুরু করে ইংরেজী বই পড়ে এবং ইংরেজী মাধ্যমে তখন অন্ততঃ প্রথম বছর যথেষ্ট অসুবিধার মধ্যে থাকে। সাধারণভাবে বেশ কিছু ডাক্তার শিক্ষক পড়ানোর সময় মাতৃভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করেন বলে তারা কিছু শেখা শুরু করতে পারে। যদি সেই কলেজে অন্য ভাষার ছাত্র-ছাত্রী থাকে তবে তারা অসুবিধায় পড়ে।
আমাদের দেশে স্কুল শিক্ষা সাধারণভাবে আঞ্চলিক ভাষায় চলে। আবার বেশ কিছু ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল আছে যেখানে সাধারণভাবে উন্নত আয়ের সন্তানেরা পড়ে। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী দুদিকেই আছে। শেখার আগ্রহ থাকলে চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষিতদের অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়।
অতএব, মেডিকেল কলেজে ইংরেজীর সাথে সাথে আঞ্চলিক ভাষা ও বইয়ের ব্যবহার হোক। তবে আঞ্চলিক ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপযুক্ত বই পাশাপাশি তৈরী হোক।