খবরটা কাল নিউজ চ্যানেলে (নিউজ টাইমস বোধহয়) দেখলাম। হিন্দিতে ডাক্তারি পঠনপাঠন শুরু হচ্ছে। দু’লাইন খবর দেখানোর পর একজন চিকিৎসকের (নাম ভুলে গেছি) বক্তব্য শোনানো হ’ল। ভদ্রমহিলার মূল বক্তব্য এরকম- “হিন্দিতে পড়ানো হবে না-ই বা কেন? হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রভাষায় পড়ানো শুরু হ’লে এ তো আনন্দের কথা!” সাংবাদিকবাবুও ভালো মানুষের মতো মুখ করে শুনলেন।
গা-রিরি করে উঠলো। যে মিথ্যাচার এতদিন ধরে সবাইকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা শেষমেশ একটা প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলেও ফলাও করে শোনানো হবে? মূল বিষয়ের আলোচনা পরে হবে। যাঁরা এখনো জানেন না আগে তিনবার জোরে জোরে বলে নিন- “হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়। ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু হয় না। হতে পারে না। এটা হিন্দি বলয়ের বহুল প্রচারিত মিথ্যাচার।” অর্থাৎ, রাষ্ট্রভাষা বলে সে বিষয়ে ডাক্তারি পড়ানো হবে, এটা একটা কুৎসিত মিথ্যা।
সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় আলাদাভাবে ডাক্তারি পড়ানো শুরু হবে, এমন কথা মিউ মিউ করে বলা হলেও আসলে উচ্চবাচ্য করছেন না কেউ। যেমনভাবে আগেও বিভিন্নভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এটা তারই আর একটা রূপ ছাড়া কিচ্ছু নয়। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অহিন্দিভাষী। তাছাড়া যেসব এলাকায় হিন্দি বহুল-প্রচলিত সেখানেও বিভিন্ন স্থানীয় ভাষা গিলে খেয়ে হিন্দির কলেবর বেড়েছে। তাহলে হিন্দিকে নিয়ে এত রমরমা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মেনে নেবেন কেন? সরকারি খরচে ‘হিন্দি-দিবস’ পালন হয়। তার খরচ মেটায় কারা? যদ্দুর জানি, দেশের কোষাগারে হিন্দির প্রাধান্য থাকা রাজ্যগুলোর অবদান খুব বেশি নয়। তাহলে বহু ভাষাবাসীর দেশে কোনও একটা ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার প্রচেষ্টাকে পেশীশক্তির আস্ফালন ছাড়া কী বলবো? এবং, যে ভাষাকে এত মহিমান্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে; দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার অবদান কতটা?
মূল আলোচনা থেকে একটু সরে গেলাম হয়তো। কিন্তু এটা না বুঝলে আসল আলোচনায় ঢোকা যায় না। যাক, এবার গোড়ার কথায় আসি। হিন্দি ছাড়ুন, মাতৃভাষায় ডাক্তারি-চর্চা নিয়ে আলোচনা করি। মূল বক্তব্য শুনতে বেশ ভালো লাগে- ডাক্তারিটা যেহেতু মানুষের জন্য তাই মাতৃভাষায় চর্চা হ’লে সাধারণের জন্য সুবিধে হবে। একটা বড় অংশ ছাত্রছাত্রীদেরও সুবিধে হবে। রাশিয়া, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি উদাহরণও মজুত। কিন্তু, ভুলে যাওয়া হচ্ছে বা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে- মাতৃভাষায় চর্চা করতে হ’লে একটা দীর্ঘ অনুশীলন, দীর্ঘ প্রস্তুতি, দীর্ঘ অধ্যবসায় লাগে। ইংরেজি থেকে হাস্যকর অনুবাদের মাতৃভাষার বই দিয়ে ডাক্তারি পড়ানো যায় না। যে সব দেশ নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করে তাদের নিজেদের ভাষায় বিজ্ঞান বা ডাক্তারি চর্চার ইতিহাসটা বহুদিনের। এবং, তারা সেটা বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে অর্জন করেছে। আজ মনে হ’ল আর কাল শুরু করে দিলাম, এরকম গিমিকবাজি দিয়ে ডাক্তারি হয় না। আপনি বলবেন, একটা তো শুরুর দিন হবে। তারপর না হয় ধীরে ধীরে ব্যবস্থাটা পোক্ত করা যাবে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, এভাবে ডাক্তারি পড়ানো যায় না। ট্রেনে-বাসে বিক্রি হওয়া তিরিশ পাতার ‘এক মাসে সহজ ***প্যাথি শিক্ষা’ আর ডাক্তারি পড়ানো দুটো আলাদা জিনিস। আগে চর্চার ক্ষেত্রটা প্রস্তুত করা দরকার। অবশ্য, মোড়ের মাথায় মাথায় গজিয়ে ওঠা হাজার একটা মেডিক্যাল কলেজ, আশি শতাংশ সংরক্ষণ, টাকা দিয়ে সিট কেনা ইত্যাদি মিলিয়ে ডাক্তারি যে জায়গায় গেছে তাতে উৎকর্ষের কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। যে ছেলে বা মেয়েটি ‘গবিনী-অলিন্দ-মহাধমনী’ পড়তে পড়তে আন্তর্জাতিক জ্ঞানের অকূল পাথারে হাবুডুবু খাবে সে রাষ্ট্রের কাছে শুধুই একটা সংখ্যা, যাকে সবাই ‘ডাক্তার’ পরিচয়ে চেনে। এমনকি ডাক্তারি-পরিভাষা ইংরেজিতে রেখে মূল ব্যাখ্যা বাংলা বা অন্য মাতৃভাষায় পড়ালেও ভুল ব্যাখ্যা ছড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আগেই বলেছি, মাতৃভাষায় ডাক্তারি বা কোনও বিজ্ঞানচর্চা করতে হ’লে আগে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া দরকার। নিজেদের বই, নিজেদের জ্ঞানের জায়গাটা তৈরি হওয়া দরকার। এখনো অব্দি মূল বিশ্বাসযোগ্য বইগুলো সবই ইংরেজিতে। অক্ষম অনুবাদে মূল বইয়ের ‘বাড়ি’ অনুবাদের ‘গাড়ি’ হয়ে রোগীর কাছে ‘হাঁড়ি’ হবে না, এই নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? এখনো অব্দি আমাদের নিজস্ব অল্প কিছু ‘গাইডলাইন’ ছাড়া আমরা মূলত আন্তর্জাতিক বইগুলোর কথা মুখস্থ করে ডাক্তারি করি। সে ভাষাটা ইংরেজি। সেটাকে কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এখনো শৈশবে। তার আগেই অনুবাদের বই পড়ে ‘ডাক্তার’ তৈরি হবে? ইংরেজি একটা সহজ ভাষা, সারা পৃথিবীর ভাষা। তাকে এড়িয়ে গিয়ে একজন ডাক্তার তৈরি হবেন, অন্তত এদেশে সে অবস্থা এখনো আসে নি। জার্মানি কিংবা রাশিয়ার সাথে তুলনা নেহাতই হাস্যকর। ‘দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসকের গোলামি’ ইত্যাদি নেহাতই আবেগের কথা। ইংরেজি একটা কাজের ভাষা। যেটা সবাই বোঝে আর যেটাকে এড়িয়ে বাঁচা যায় না। আমরা যারা বাংলা মাধ্যম স্কুল এসেছি, তাদের প্রথমে সমস্যা হয়েছে বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেটা কাটিয়ে ওঠা মোটেই কঠিন নয়। যে কোনও জ্ঞান, যে কোনও বই প্রকৃত ভাষায় না পড়লে শেখা সম্পূর্ণ হয় না।
জানি, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই অমোঘ উক্তি সাজিয়ে বসেছেন- “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয় না, তাঁরা হয় বিজ্ঞান জানেন না নয় বাংলা জানেন না।” কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, যে যুগে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যে কোলকাতা বা বাংলা সারা এশিয়ার এক নম্বর তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম সেরা। প্রকৃত অর্থেই ‘দ্বিতীয় লন্ডন’। সে সময় যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলো ছড়িয়েছিলেন তাঁরা সারা পৃথিবীর নিরিখেই শুরুর দিকে পড়বেন। সুধী পাঠক, একশো বছর। একশো বছর পেরিয়ে গেছে। এখন দেশের নিরিখেই এ রাজ্যের অবস্থান খুঁজতে কষ্ট হয়। আলো ছড়ানো মানুষেরা একে একে নিভে গেছেন। আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগেও উচ্চশিক্ষিত মানুষ নির্বিঘ্নে জ্ঞানচর্চায় নিমজ্জিত থাকার অন্তত সুযোগটুকু পেতেন। বছর কুড়ি আগেও উচ্চশিক্ষিতের জন্য জ্ঞানচর্চা না হোক, অন্তত চাকরির নিশ্চয়তা ছিল। আজ উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে ‘ভাতা’র জন্য বাঁচে। যে দিন গেছে সে দিনের ‘উক্তি’রও ‘এক্সপায়ারি ডেট’ পেরিয়েছে। আমরা খেয়াল করিনি। বর্তমানে বাঁচুন। শুধু হিন্দি বলেই বিরোধিতা করছি না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বাংলায় ডাক্তারি পড়ানো শুরু হ’লে তারও বিরোধিতা করবো।
তাহলে? আমাদের যে মানুষের কাছে পৌঁছোনোর কথা ছিল, তার কী হবে? সাধারণ মানুষ তো আপনার নেলসন, হ্যারিসন, উইলিয়ামস, বেইলি অ্যান্ড লাভ বোঝে না। তাদের জীবন-জীবিকা ছুঁয়ে দেখার কথা উঠবে না?
উঠবে। নিশ্চয়ই উঠবে। দুটো আলাদা জিনিসকে গোলালে চলবে না। পড়াশোনাটা ইংরেজিতেই হোক। বরং, ‘কমিউনিকেশন’ বা এ জাতীয় কোনও একটা বিষয় যোগ হোক। যেটা এমবিবিএসের ফাইনাল ইয়ার এবং ইন্টার্নিশিপে থাক। যেখানে ভাবী-ডাক্তাররা সাধারণ মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, শিখুক। সাধারণ সামাজিক সমস্যা, কুসংস্কার শিখুক। কাওয়াসাকি ডিজিজ কিংবা পলিআর্টারাইটিস নোডোসার সাথে সাথে কীটনাশক খাওয়া রোগী কিংবা সাপের কামড়ের চিকিৎসা শিখুক। বলতে শিখুক, বাচ্চা প্রথম ছ’মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই খাবে। ‘প্রকৃত’ কারণ ছাড়া কোনও ডাক্তার বা কোনও প্রতিষ্ঠান বাইরের দুধ খাওয়ার পরামর্শ দিলে সেটা অন্যায়। ছেলে বা মেয়ে যে-ই হোক, জন্মের দিন থেকে একশো আশি দিন পেরোলেই ভাত-খিচুড়ি খাক। কোনও আশ্বিন-কার্তিক-ফাল্গুন-অঘ্রাণ নয়, ছ’মাস মানে ঠিক একশো আশি দিন। সেই চর্চাটা যে যার মাতৃভাষায় হোক। কিন্তু মূল ডাক্তারি শিক্ষা এখনো ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় করার পরিস্থিতি আসে নি।
আবার ঘুরেফিরে পুরোনো কথায় ফিরি। মুখে ‘ইতি গজ’র মতো মাতৃভাষায় ডাক্তারি পড়ানোর কথা উঠলেও এটা আসলে আরও একবার হিন্দি গেলানোর কৌশল। যেভাবে ‘ধ্যান-দেবদ্বিজে ভক্তি-প্রাণায়াম মার্কা’ গৈরিকীকরণ শুরু হয়েছে এটা তারই আর একটা পদক্ষেপ। চল্লিশ শতাংশ ভোট বড় কম কথা নয়। হাজার হাজার ডাক্তার পাশ করে বেরিয়ে কোথায় কাজ করবে, কী কাজ করবে, কাদের জন্য কাজ করবে সে ব্যাপারে কারও হেলদোল নেই। যেনতেনপ্রকারেণ সংখ্যা বাড়লেই মোক্ষ। হিন্দিতে বা অন্য মাতৃভাষায় ডাক্তারি পাশ করে ভিন রাজ্য বা অন্য দেশে কাজ করা বা জ্ঞান আদান-প্রদানের জন্য অসুবিধেয় পড়বে কিনা সেটা দেখার কেউ নেই। যদিও এসব বলে কিছুই হবে না জানি। আর পাঁচটা বিষয়ের মতো এটাও রমরমিয়ে শুরু হয়ে যাবে। ‘গবিনী’ আর ‘ঊর্ধ মহাশিরার’ কুয়োর দুনিয়া আন্তর্জাতিক জ্ঞানসমুদ্রে মাথা কুটে মরলে কার কী আসে যায়? বাংলা মাধ্যম স্কুল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কারও কিছু যায় আসে না। কারণ, আমাদের দামী স্কুলে পড়ানোর ক্ষমতা আছে। আশি শতাংশ সংরক্ষণ আর হাস্যকর শিক্ষাব্যবস্থার কোপে ডাক্তারি-শিক্ষা হারিয়ে গেলেও পরোয়া নেই। আমাদের কর্পোরেট হাসপাতাল আছে। বাদবাকি হরেন, ফুলমণি কিংবা গফুরদের কথা না ভাবলেও চলবে। দরকার তো শুধু ভোটের সময়। আর ভাত ছড়ালে কাকের অভাব কোনওদিনই হয়নি।
(ছবিটা ফেসবুকেই পাওয়া। সত্যি-মিথ্যে জানি না)