সেদিন সারাদিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়ে অবশেষে একটু শান্ত হয়েছে। করোনাকে তিন তুড়ি মেরে চাতাল হাতুড়ে একটা নিকটবর্তী চা-দোকানে উপবেশন করেছে। মাথার ওপরে নীল প্লাস্টিকের ছাদ জলভারে নুয়ে পড়েছে। সেই দোকানদার সাময়িক বৃষ্টিবিরতিতে চা-লালায়িত মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়ে মিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এমন সময়ে জনতা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
একজন বুদ্ধিজীবী, পরোপকারী ভদ্রলোক একটা চিকিৎসকের অবহেলা নিয়ে একটা চমৎকার প্রসঙ্গ তুলে সিক্ত বৈকালিক চা পানের বর্ষণবিরতিকে অগ্নিময় করে তুললেন। জনতার চোখে পড়লো একজন, হাতুড়ে হলেও, চিকিৎসক সেখানে উপস্থিত। সকলে মিলে আধাপাগল হাতুড়েকে চেপে ধরলেন। বেচারা হাতুড়ে বৈকালিক চা-পানে এরূপ বিঘ্ন ঘুণাক্ষরেও আশঙ্কা করে নি। চমকে চা চলকে, বিষম খেয়ে, হেঁচে কেশে একাকার কান্ড বাধালো।অতঃপর একটা নির্দোষ প্রশ্ন করলো “আজ্ঞে আমি তো জন্ম অপরাধী, যাকে বলে দাগী, কিন্তু ঘটনাটা কী? যদি আজ্ঞা করেন, সেটা জানতে পারি কি?”
এবার বাকিরা থমকালো। কেন না,এমন সময় একটা দুধসাদা জমকালো গাড়ি, বিদেশী হোটেলের ছাপ মারা, ঘচাং করে অকুস্থলে দাঁড়ালো। সেখান থেকে সোনালী হলুদ স্যুটেড, সাদা বুটেড, কালো টাইদুরস্ত এক গোলাকার মানুষ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে চায়ের দোকানের প্লাস্টিকের ফাটা টুলে বসলেন।
এটা অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। পেঁকো খাল দিয়ে সুদৃশ্য প্রমোদতরণী গেলে যেমন অবিশ্বাসের ঢেউ উঠবে, উপস্থিত চা-তাল জনতার মনে তার চেয়েও বেশী ঢেউ খেলে গেলো। এক কোটির গাড়ি নিয়ে বিমলের দোকানের প্লাস্টিক টুলে! বিমলের পরম সৌভাগ্য টুলটা মচ মচ করেও মচৎকার প্রাপ্ত হয় নি। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে একটা দশ টাকার বিড়ির বান্ডিল নিয়ে, রিকশাওয়ালা স্টাইলে হীরে বসানো লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরালেন। বিমলবাবু ওর একটা স্পেশাল চা এগিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক সুরুৎ করে চুমুক দিয়ে তারপর অত্যন্ত মিহি তীক্ষ্ণ গলায় আত্মপরিচয় দিলেন “আমি পীতাম্বর গোঁসাই। বাঁকুড়ার ছেলে। একটু চা খেতে এলাম, বলুন কি বিষয়ে কথা হচ্ছে। এটা তো বেওয়ারিশ, বারো ইয়ারি, আড্ডা, আমি এখন থেকে আপনাদের একজন ইয়ার। সুতরাং এটা এখন তেরো ইয়ারি আড্ডায় পরিণত হল।”
এমনিতেই ভদ্রলোকের কথাবার্তা, চালচলন সন্দেহজনক। ভুঁড়ির মধ্যে ছুরি লুকানো আছে কিনা কে জানে?
সমবেত সুধীমন্ডলী একমতে, একস্বরে বলে ওঠেন “ডাক্তারের অবহেলা। কলে যায় নি। খারাপ পেশেন্ট জেনেও।”
পীতাম্বর মিহি গলায় বললেন “তারপর? তারপর?”
জনতা “এক বেচারা মাতৃভক্ত সন্তান, চার চারটে ঘন্টা অপেক্ষা করে, কাউকে না পেয়ে মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যায়”
পীতাম্বর “ততঃ কিম? ততঃ কিম?”
সুবিবেচক, সমাজসেবী ভদ্রলোক উত্তর দ্যান “হাসপাতালে ইসিজি আর কিসব ঢপের পরীক্ষা করে’ই বলে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে অর্থপিচাশগুলো পঞ্চাশ হাজার বিল করে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দ্যায়। সেখানে এখন আইসিসিইউতে….”
সমবেত জনতার কোরাসকন্ঠ “ডাক্তার কেন যায় নি? ডাক্তার আগে গেলে সময়মতো চিকিৎসা হতো”
পীতাম্বর মিহিসুরে পুনরুক্তি করেন “আগে গেলে সময়মতো চিকিৎসা হতো।” তারপর খ্যাঁস খ্যাঁস করে ঘাড় চুলকে বলেন “চিকিৎসা হতো। কিন্তু কী ভাবে?”
সমাজসেবী, ভোটবাদী সমাজপন্থী গলা চড়ান “ডাক্তার গেলে আগে রোগ ধরা পড়তো। আগে চিকিৎসা হতো। আমরা এর বদলা লুঙা। লুঙাই লুঙা।” (শোনা যায় ভোটবাদী, সমাজপন্থী মানুষেরা হিন্দিতে স্লোগান দ্যান। তাতে বিপ্লব জোরদার হয়।)
জনতা(কোরাস) “বদলা চাই। বদলা দাও”
পীতাম্বরের মিহিগলা স্লোগান (স্লো মানে ধীরে চলা?) ছাপিয়ে বলেন “ডাক্তার গেলে আগে রোগ ধরা পড়তো। ডাক্তার গেলে আগে রোগ ধরা পড়তো। বটেই তো কিন্তু কী ভাবে?” (হাতুড়ের এই গলাটা তীক্ষ্ণ মিহি গলাটা খুব চেনাচেনা লাগে। অথচ….)
সমাজপন্থী “স্টেথো বসালেই ধরা পড়তো (হঠাৎ গলার জোর কমে আসে)। পড়তো না?”
অপর জন “বিদেশে সভ্য দেশে ডাকলেই ডাক্তার বাড়িতে আসে। (এনারও গলার জোর কমে আসে)। আসে না?”
মিহিগলা এবার উচ্চৈঃস্বরে বলেন “হয়নি হয়নি ফেল। ও বড়বাবু সবাইকে একটা করে চা আর খুকি দিন”
বড়বাবু নাহয় বিমলবাবু (দোকানদার) সেটা বোঝা গেলো, কিন্তু সে এ্যাতোগুলো খুকি কোথা থেকে সাপ্লাই করবে? তাই বিমলবাবু চোখ পিটপিট করে ইতিউতি চাইতে থাকে।
হাতুড়ে ফিশফিশ করে বলে “বিমলবাবু, খুকি মানে বিশকুট”
বিমলবাবুর খুশিতে সামনের র্যাবিট টিথ বেরিয়ে আসে।
মিহিগলা বলতে থাকেন “স্টেথো বসিয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হার্ট অ্যাটাক ধরা যায় না। অনেক সময়ে ছ’ ঘন্টার আগে ইসিজি করলেও ধরা যায় না। সুতরাং…”
সমাজবাদী বিপ্লবজীবীর একজন সমব্যথী বলেন “কে দেখতো? স্পেশালিস্ট দেখায়নি কেন?”
চা যদিও ভীষণ কিছু খাওয়া নয়, তবু মিহিগলা সামান্য চা খেয়েই বিষম খান। কেশে টেসে হতভাগা এবার যায় বুঝি। থাবড়ে থুবড়ে দিতে একটু ঠিক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “স্পেশালিস্ট দ্যাখাবে কি রকম? ওনার ডাক্তার স্পেশালিস্টের কাছে না পাঠালে কী করে দ্যাখাবে? বিদেশে তো সেটা হয় না…”
বিপ্লবজীবী সহ প্রত্যেকে কোরাসে যোগ দ্যায় “কোন্দেশ? ওটা কোন্দেশ?”
“আমি তিনটে দেশে কাজ করেছি। অস্ট্রেলিয়া, ইউএস, আর ইংল্যান্ড। কিছুদিন জার্মানিতেও। ওখানে চিকিৎসার নথিপত্র মানে রেকর্ড আপনার ডাক্তারের কাছে থাকবে। মানে জিপি-র (জেনারেল ফিজিশিয়ান) কাছে। অন্য ডাক্তার দ্যাখাতে চাইলে তার কাছে নাম রেজিস্টার করে আপনার আগের ডাক্তারকে জানাতে হবে। তখন আপনার রেকর্ডস উনি নতুন জিপিকে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু স্পেশালিস্ট তো কেবল রেফার করলেই দেখতে পারেন। নাও দেখতে পারেন।” পড়ন্ত রোদ্দুরে ওনার হলুদ স্যুট সোনার মতো ঝলকাতে থাকে।
“ওখানে চিকিৎসা আমাদের দেশের চে’ সস্তা?”
“যদি সরকারি সাহায্য পাওয়া ডাক্তার হয়, বা সরকার কিছু টাকা দ্যায় মানে এনলিস্ঠেড ডাক্তার হয় তাহলে আমাদের টাকায় হাজার চল্লিশেক টাকা ফীজ নাহলে ঢের বেশী, আরও ঢের বেশী” ওনার বাঁশির মতো গলায় সুর খ্যালে।
“হাসপাতালে? হাসপাতালে? তাহলে হাসপাতালে কতো?” কোরাসকন্ঠ ম্রীয়মান।
“সাধারণতঃ এগারো হাজার ইউরো পার ডে মানে দিনে বারো হাজার ইউরোর কাছাকাছি। ভারতীয় মুদ্রায় বারো লক্ষ টাকা। তবে আইসিইউতে আরো বেশী।”
“তাহলে মেডিক্যাল এমার্জেন্সিতে কি হবে?”
পীতাম্বর গোঁসাই সরু গলায় প্রতিধ্বনি করেন “এমার্জেন্সিতে কি হবে? আপনি আমেরিকায় ৯১১ ডায়াল করবেন, ইউরোপে ১১২, আপনার কাছে পাশ করা এমার্জেন্সি টেকনিশিয়ান সমেত অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে যাবে। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে- এতে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত থাকে। তবে এই নম্বরে কোন কোন বিশেষ অসুবিধায় ফোন করা যাবে তার নিয়ম আছে।”
ফিসফিসিয়ে কোরাস “ডাক্তার? ডাক্তার যাবে না?”
পীতাম্বর গোঁসাই উঠে পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে হাতুড়ের হাতে দ্যান। “চিনতে পারলি না তো? আমি ফার্স্ট ব্যাচের পিতুদা। এখন ইউএসএ সেঠেল্ড। অমলের কাছে শুনলাম তুই পাগল হয়ে গেছিস তাই দেখতে এসেছিলাম।দেখলাম, তুই সত্যিই পাগল হয়েছিস না হলে এ্যাতোগুলো উন্ম্যাডের সঙ্গে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবি ক্যানো?”
তারপর সরু গলা আরও সরু করে (সরুতম কথাটা কি ব্যাকরম সেদ্ধ?) বিমর্ষ (আজ এ্যাতো বিমর্ষ ক্যানো, মুখে নেই হর্ষ ক্যানো?) জনতাকে বলেন “ডাক্তার তো সব সব সময় ইসিজি মেশিন, ইনফিউশন পাম্প, ডিফিব্রিলেটর, ভেন্টিলেটর, স্যালাইনের বোতল আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘোরে না। সে এমার্জেন্সি সামলাবে কি করে? বসে বসে নাড়ি ধরে কাঁদু করবে? তার চেয়ে আইসিইউ ট্রেনিং পাওয়া লোক এলে অন্ততঃ এই ব্যবস্থাটা চটপট হবে, ডায়াগনোসিস পরে হলেও চলবে।
টাটা…” বলে কোটি টাকার গাড়ি চেপে চোঁ চাঁ ধাঁ।।
Excellent.
থ্যাঙ্ক্যু দাদা আমার