সকলের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
এই শতকের গোড়ার দিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক প্রবীণ স্বাস্থ্য আধিকারিকের মুখে একটি গল্প শুনেছিলাম। রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন সরকারি দফতরের পক্ষে যাঁরা পরিষেবা দেন, নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কতটা সম্পৃক্ত — গ্রামীণ জনগণকে একটি সমীক্ষার মাধ্যমে তার মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। সমীক্ষার অভিনবত্ব ছিল যে, নম্বরের ভিত্তিতে নয়, মূল্যায়ন করতে হবে হাতে গড়া রুটির সাইজের ভিত্তিতে। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ জনসংযোগ রক্ষাকারী দফতরের রুটি হবে সবচেয়ে বড় আকারের — আর সমস্যা ও তার সুরাহা বিষয়ক কথাবার্তার আদানপ্রদানে মানুষের সন্তুষ্টির ক্রমাবনতিতে ছোট হয়ে আসবে রুটির সাইজ।
পঞ্চায়েত, জনস্বাস্থ্য কারিগরী, পূর্ত, শিক্ষা ইত্যাদি নানা দফতরের মাঝে সবচেয়ে ছোট সাইজের রুটিটা কিন্তু প্রাপ্য হয়নি স্বাস্থ্য দফতরের। তারা পেয়েছিল মাঝারি আকারের রুটি — অর্থাৎ, সমীক্ষার ফল বলেছিল যে মানুষ স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের সঙ্গে একেবারে হরিহর আত্মা না হলেও তাদের দূরের গ্রহের জীব বলে মনে করেন না, কিছুটা মানসিক নৈকট্য রয়েছে তাদের সঙ্গে, যাতে অল্প হলেও অভাব অসুবিধার কথা জানানো যায়।
চিকিৎসক হচ্ছেন এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরের স্তরের পরিষেবা প্রদানকারী। উপরোক্ত সমীক্ষার ফল যদি খন্ডিত সত্য বলেও ধরে নেওয়া যায়, তাহলে গ্রামে বা মফস্বলে চিকিৎসকদের নিজেদের কাজটুকু করতে খুব অস্বচ্ছন্দ বোধ করার কথা নয়।
অথচ বাস্তব ঠিক বিপরীত কথা বলে। কেন?
কারণগুলো নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
প্রথমত, শহরের মানুষজনের তুলনায় গ্রামীণ মানুষের রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বহুলাংশে কম। জীবনসংগ্রামের কাঠিন্যের কারণে তাঁরা রোগব্যাধিকে প্রাথমিকভাবে ততটা গুরুত্ব দেন না — ভাবেন, আপনিই সেরে যাবে। এই ঔদাসীন্য, আর হাতুড়ে, তাবিজ, মাদুলি জাতীয় অপচিকিৎসার ফাঁক গলে রোগ জটিল আকার ধারণ করে — চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে তখন শুধু রোগের সঙ্গেই নয়, যুঝতে হয় অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারের সঙ্গেও। তিনি তখন নির্ভর করেন বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার উপর। এইবার আসে দ্বিতীয় সমস্যা।
তিনি যদি সরকারি হাসপাতালে যুক্ত থাকেন, দেখা যায়, বহু পরীক্ষা নিরীক্ষাই সেখানে হয় না। কেন হয় না? কারণ, প্রাথমিক স্তরে গ্রামেগঞ্জের হাসপাতালে উচ্চস্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষা হওয়ার কথাই নয়। সেখানে মৌলিক কিছু রোগনির্ণায়ক পরীক্ষা হবে যাতে রোগের একেবারে প্রাথমিক স্তরেই ডাক্তার রোগটি ধরতে পারেন, আরম্ভ করে দিতে পারেন চিকিৎসা। আর রোগনির্ণয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলে উপযুক্ত কাগজপত্র সহ পাঠিয়ে দিতে পারেন পরবর্তী পর্যায়ের হাসপাতালে। যদিও এখন বহু মফস্বলী হাসপাতালে পরীক্ষানিরীক্ষার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে, কিন্তু সেগুলি পরিচালনা করার লোকাভাব রয়েছে। কারণ সব টেকনিক্যাল পদে এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ হয়নি।
আর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক যদি বেসরকারি হ’ন, তাহলে তিনি প্রাইভেট ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলেন। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকাস্থিত প্রাইভেট ল্যাবগুলির রিপোর্ট কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তাদের ফলাফলের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বই বা কাদের, সে বিষয়ে চিকিৎসকেরই ধন্দ যায় না। বহু ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষার ফলের সঙ্গে ল্যাবরেটরির রিপোর্টের বিস্তর গরমিল লক্ষ করা যায়। তাই তিনিও ঝুঁকি না নিয়ে রোগীর নিরীক্ষা এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে পাঠিয়ে দেন জেলা সদর বা নিকটস্থ বড় শহরের চিকিৎসাকেন্দ্রে।
এরপর আসে তৃতীয় সমস্যা।
সুচিকিৎসার জন্য রোগীকে শহরে নিয়ে যেতে হলে শুধু রোগীর পরিজন এবং সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়, সুগম সড়কপথ এবং যানবাহনের সহজলভ্যতাও প্রয়োজন। বহুক্ষেত্রে সেটা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। বাহন যদি বা পাওয়া যায়, রাস্তা খারাপ। আবার পথ ভাল থাকলেও অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্স অমিল হয়। এই অবস্থায় জটিল রোগীর অবস্থার অবনতি হলে বুঁদির কেল্লা আগলে থাকা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মরত চিকিৎসকটির উপরেই পরিজনদের রোষ গিয়ে পড়ে। কিন্তু চিকিৎসার সহায়ক উপযুক্ত পরিকাঠামো বা নিরীক্ষাব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের জন্য কি সরাসরিভাবে তিনি দায়ী হতে পারেন?
পরীক্ষানিরীক্ষার পরের ধাপে রয়েছে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা। সরকারি স্তরে সুলভে জেনেরিক ওষুধ পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আছে জন ওষধি কেন্দ্র। আবার তারই পাশাপাশি রয়েছে প্রাইভেট দাওয়াইখানা, যেখানে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে চলেছে সেই একই জেনেরিক নামের বিভিন্ন কোম্পানিপ্রসূত ওষুধ। গ্রামের মানুষের সঙ্গে চিকিৎসকও বিভ্রান্ত। দামের ফারাকের সঙ্গে গুণাগুণেরও তফাৎ নেই তো? এখানেও রয়েছে ওষুধপত্রের গুণমান পরীক্ষার পরে ছাড়পত্রের প্রশ্ন।
ওষুধে কাজ না হলে, সেই চিকিৎসককেই বইতে হয় অসাফল্যের দায়ভার। সরকারি চিকিৎসালয়ে আবার সব সময় সব ওষুধের পর্যাপ্ত জোগান থাকে না। তার জবাবদিহিও করতে হয় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককেই।
যে সমস্যাগুলির কথা লিখলাম, তার কোনোটার সমাধানই সরাসরিভাবে চিকিৎসকের হাতে নেই। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিবিড় জনসংযোগের কাজে নিযুক্ত আশাদিদি বা স্বাস্থ্য সহায়িকারা যদি মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের সঙ্গে অন্যান্য গুরুতর রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজে তাঁদের সহায়তার হাতটি প্রসারিত করেন, তবে উপকার হয়, মানুষ বেশি করে সচেতন হবেন।
যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলির সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বারা নিয়মিত, সতর্ক পরিদর্শনের আওতায় থাকা উচিৎ। লাইসেন্সবিহীন পরীক্ষাগারগুলি চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারলে পরীক্ষানিরীক্ষার রিপোর্টে স্বচ্ছতা আসবে, রোগনির্ণয়ে দিশা পেতে সাহায্য করবে চিকিৎসককে।
গ্রাম থেকে শহরের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে নিশ্চয়ই, তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। পঞ্চায়েত, ভূমি ও ভূমিরাজস্ব, পূর্ত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরির মতো দফতরগুলির সমন্বয়সাধন এক্ষেত্রে আবশ্যিক।
এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করব। আমাদের দেশে চিকিৎসা শিক্ষার পাঠক্রম একান্তভাবেই শহুরে মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের পরিকাঠামোর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হয়। সেই কারণে সহস্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও, ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও, ভারতের মতো জনবিস্ফোরণে জর্জরিত উন্নতশীল একটি দেশে গ্রামাঞ্চলে কি ভাবে অবস্থানুগ চিকিৎসা দেওয়া যায়, হাতে কলমে তার পাঠ ও বাস্তব রূপায়ণের প্রয়োজন রয়েছে বলে অনুভব করি।
একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার একেবারে তৃণমূল স্তরের আধিকারিক থাকাকালীন স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে জোকার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে একটি ওয়ার্কশপে যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানেই এক শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম, অন্যান্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থায় যেখানে ১০০ থেকে ১ বিয়োগ করার ফল ৯৯, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সেই ফল শূন্য। অর্থাৎ কোনো চিকিৎসক যদি নিরানব্বইটি রোগীর সফল চিকিৎসা করার পরে একজনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হ’ন, তাঁর সাফল্যের ভাগ শূন্য — ‘আরে, ঐ ডাক্তার তো রুগী মেরে দেয়’ — এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে আমাদের সমাজ, সে শহরেই হোক বা গ্রামে।
সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের রথে সওয়ার হয়ে পৃথিবী এখন এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে — একটু শ্লথ হলেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-মফস্বল কেউই পিছিয়ে নেই — তারাও প্রযুক্তির হাত ধরে ছুটছে টলমল পায়ে। তাই ভেবে দেখা প্রয়োজন, যে সবেধন নীলমণি একটিমাত্র স্টেথোস্কোপ সম্বল করে, গাছের তলায় টেবিল পেতে অগ্নীশ্বর মুখুয্যের মতো জনদরদী চিকিৎসা আজকাল কে-ই বা করবেন? আর উপভোক্তা মানুষ আজকের যুগে তা গ্রহণ করবেনই বা কেন?
উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এ ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৩-এ প্রকাশিত।