প্রথমেই ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি। আমি স্কুলের পরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে (যার আসল নাম মেডিক্যাল কলেজ বেঙ্গল) পড়েছি। পশ্চিমবঙ্গের কোনো মেডিক্যাল কলেজেই প্রায় কোনো র্যাগিং তখন হত না। র্যাগিং-কে উৎসাহ দেওয়ার কোনো কালচার কোনো মেডিক্যাল কলেজে ছিল-ই না। তাই র্যাগিং করার বা ragged হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই।
মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র রাজনীতি হত। সে রাজনীতি বাম, অতি বাম, ডান- তাতে টানার জন্য- অর্থ্যাৎ সদস্য বাড়ানোর জন্য নবীন ছাত্রছাত্রীদের মাথায় হাত বোলানো চলত রীতিমতো প্রতিযোগীতা সহকারে। শারীরিক বা মানসিক অত্যাচারের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বরং সিনিয়রদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ভালোবাসা কখনো কখনো মাত্রা ছাড়া হয়ে যেত।
অবশ্য নতুন কলেজে এসে হোষ্টেলে ঘর পেতে, বোন সেট পেতে নতুন ছাত্রছাত্রীদের বেশ সুবিধাই হত এতে।
কিন্তু র্যাগিং নিয়ে পরোক্ষ অভিজ্ঞতাও আমার নেই – একথা বলা যাবে না। আমাদের সময়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হত। আমার ছিল আক্ষরিক অর্থেই জয়েন্ট। দুটোতেই চান্স পেয়ে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে গেছিলাম।
তখন দ্বিতীয় হুগলী সেতু অর্থ্যাৎ বিদ্যাসাগর সেতু তৈরী হচ্ছে। লঞ্চে গঙ্গা পার হয়ে শিবপুর বি ই কলেজে গেছি। ফর্ম তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা সঙ্গে রয়েছে, কিন্তু অনেক দূরে। মেন গেটের কাছে। বাবা-মা সঙ্গে থাকলে আরো বেশী র্যাগিং-এর সম্ভাবনা। তাই এই ব্যবস্থা।
লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। তৃতীয় বর্ষের কয়েকজন এসে প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করছে – সিগারেট খেতে জানে কি না। যে বলছে ‘না’, তাকে বি ই কলেজের লনে গরুর মত ঘাস খেতে হচ্ছে। তা না করলেই ভয়ঙ্কর মার- প্রকাশ্যে।
আমার সময় এল। বুক ঢিপঢিপ করছে। বুক ওয়ার্ম ছিলাম না। স্কুলে খেলেছি, বদমায়েসি, মারামারি করেছি। কিন্তু সংগঠিত এতজনের সাথে পারব না।
জিজ্ঞাসা করল, ‘সিগারেট খাস?’
‘সিগারেট কোথায় পাব? বিড়ি খাই। বারাসাতের বিখ্যাত ঘড়ি বিড়ি।’
‘অ্যাঁ?’ এমন উত্তরের জন্য ওরা বোধহয় প্রস্তুত ছিল না।
সিগারেট সত্যিই খেতাম। ক্লাস ইলেভেন থেকে। সঙ্গে বিড়ি, ফিল্টারলেস চারমিনার এবং ‘প্রিন্স হেনরি’ ব্রান্ডের তামাক দিয়ে কাগজ রোল করে বানানো সিগারেট। না, বাবার পয়সায় নয়। টিউশনি পড়িয়ে।
শুধু তাই নয়। আমার মুখে একগাল চাপ দাড়ি। ব্যাগ থেকে ইচ্ছাকৃত উঁকি মারছে ‘তিয়েন আন মেন স্কোয়ার’এ চীনা সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের অত্যাচারের সংবাদ ছাপানো কাগজ। সঙ্গে একটা ডেবোনেয়ার পত্রিকা। দেখে একটু ব্যোমকে গেল র্যাগিং করতে আসা ছেলেগুলো।
সুতরাং আমাকে র্যাগিং-এর ওখানেই ইতি।
অন্যদের তখন নানা ভাবে হার্ডকোর র্যাগিং করছে।
বুঝলাম, র্যাগিং একটা মাইন্ড গেম।
ফর্ম তুলে সেদিন চলে এলাম বি ই কলেজ থেকে।
পরদিন যাদবপুর। একাই গেছি। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এ কাউন্সেলিং হত। স্বাভাবিক ভাবেই অফলাইন। গেটের কাছ থেকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। পথে দেখা হল সেবারে জয়েন্টে ফার্স্ট বয়ের সাথে। চাকদার ছেলে। সে বেচারা সঙ্গী খুঁজছিল। অথচ আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এর রাঙ্ক মোটেই ভালো না। তবুও তার সাথে ভীড়ে গেলাম।
পথে একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাউন্সেলিং কোথায় হচ্ছে।’
‘তোমরা কি ফার্স্ট ইয়ার?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাদের দেখে কিন্তু ফার্স্ট ইয়ার বলে মনে হচ্ছে না। আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেও না। সোজা চলে যাও। সামনেই পড়বে।’
সোজা চলে গেলাম। কাউন্সেলিং এর জন্য বিরাট ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। র্যাগিং করার ছেলে মেয়েরা ঘুরঘুর করছে। আমি ফার্স্ট বয়ের কাঁধে হাত রেখে সিগারেট খাচ্ছি। আমাদের দিকে র্যাগিং এর দল খুব একটা ঘেঁষছে না।
আমার পাশেই ছিল একটি মেয়ে ও তার বাবা। মেয়েটির রাঙ্ক ছিল আমার ঠিক পরেই। সেই দল তাকে ধরে নিয়ে পাশের বিল্ডিং এ গেল। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে যখন ফিরে এল- বর্ননার অতীত। বাবা মেয়ে দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল কাউন্সেলিং ছেড়ে।
যাদবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পেলাম। ভর্তি হলাম। দুদিন বাদে সেটা ছেড়ে মেডিক্যাল কলেজে। সে অন্য গল্প।
সেই বছরেই খড়গপুর আইআইটি র্যাগিং-এর শিকার হয় ‘সিংহরায়’ পদবীধারী (পুরো নামটা ভুলে গেছি) ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে। তাকে তিনতলার ছাদের আলসের উপর হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে সে মারা যায়। সেই হত্যার প্রতিবাদে এক বিরাট অল ইন্ডিয়া কনভেনশন হয় খড়গপুরে। মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে সামিল হয়েছিলাম তাতে।
আইআইটি খড়গপুরে পড়ত বারাসাতে আমার সিনিয়র তাপস দা। সে এখন সিঙ্গাপুরে থাকে। ভর্তির একমাস বাদে প্রথমবার হোষ্টেল থেকে ফিরে জামা খুলে দেখিয়েছিল পিঠে মারের বীভৎস দাগ।
তারপর থেকে র্যাগিং এর বিরুদ্ধে প্রচার, অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড তৈরি করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাগিং বিরোধী প্রচার, ছাত্রছাত্রীদের থেকে র্যাগিং বিরোধী মুচলেকা গ্রহণ, র্যাগিং করে ধরা পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া (Rusticate)- ইত্যাদির ফলে র্যাগিং এখন খুবই কমে গেছে। কিন্তু অবাক কান্ড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাকি র্যাগিং আটকানোর সেরকম চেষ্টাই করে না। যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে- ধিক্কার জানাই তাদের।
কিছু শিক্ষিত মানুষের এখনো এমন ধারণা আছে যে ছাত্রছাত্রীদের স্মার্ট করে তুলতে র্যাগিং দরকার। ধিক্কার জানাই এইসব ভ্রান্ত ধারণা এবং সেই কু-ধারণার ধারক ও বাহকদের।
আমারা ডাক্তাররা র্যাগিং না করে এবং না সয়েও যথেষ্ট স্মার্ট। জীবনে আর স্মার্টনেসের দরকার নেই। বরং বেঁচে থাকার এবং মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার।
Aapnar first year koto saale?
khubi sundar bolechen sir .