গতকাল এক বয়স্ক মহিলা এসেছিলেন দেখাতে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলেন চেম্বারে। সম্ভবতঃ হাঁটুর সমস্যা। সঙ্গে এক কমবয়সী মহিলা। মেয়ে কিম্বা বৌমা হবে! কমবয়সী মহিলা হি*জাব পরিহিতা। বয়স্কজন সাধারণ শাড়ি।
‘ডাক্তারবাবু, ভালো আছেন?’ কমবয়সী মহিলা প্রশ্ন করলেন।
দেখে এবং প্রশ্নের ধরনে মনে হল আগে কখনো দেখাতে এসেছিলেন। আজকাল খুব কম মানুষ ডাক্তারের কুশল জানতে চায়। যারা জানতে চায়, তারা সাধারণতঃ সবাই পুরোনো রোগী বা রোগীর পরিজন।
‘আমি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আপনি বোধহয় আমাকে ভুলে গেছেন!’
একটু চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু পুরোপুরি মনে করতে পারছি না। এত শত রোগী ! এত কাজের চাপ। মনে রাখাই মুশকিল।
‘আমার বাবার পা ভেঙে গিয়েছিল। আপনি অপারেশন করেছিলেন।’
‘কবে?’
‘সে অনেকদিন আগে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। তারপর কোভিডের আগে একবার হাজব্যান্ডকে নিয়ে এসেছিলাম না?….. ভুলে গেছেন।’’
‘ও হো। বয়স হয়েছে তো! ভুলে যাচ্ছি অনেক কিছু।’
‘কোথায় বয়স হয়েছে আপনার?’
‘আচ্ছা তোমার মায়ের কি কষ্ট, কি হয়েছে বল তো?’
‘উনি ঠিক আমার মা নন। মায়ের মত। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। আমি বড়মা বলি। ওনার হাঁটুতে ব্যথা।’
তখন ফাইলটা নজর করে দেখলাম এবং বুঝলাম রোগিণী এই মেয়ের নিজের মা নন। রোগিণীর নাম রমা মন্ডল এবং মেয়েটির নাম তুহিনা বেগম (নাম পরিবর্তিত)।
‘আপনি আমার হাজব্যান্ডকে চেনেন। গতকাল আপনাকে ফোন করেছিল।’
‘কে? ইমদাদ (নাম পরিবর্তিত)?’
‘হ্যাঁ।’
আমি ইমদাদ-কে চিনি। সরকার অধিগৃহীত একটা সংস্থায় ক্যাজুয়াল কর্মচারী। চাকরিটা স্থায়ী নয়, মাইনেও খুব একটা বেশি নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু হাব-ভাব ষোল আনা। তবে আমার চিকিৎসায় ভরসা করে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আসে মাঝে মধ্যে। তবে লোকটা কেমন যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আর সেই নিরাপত্তাহীনতা-কে চাপা দিতে বড় বড় হাব-ভাব দেখায় ।
আজ ইমদাদের গল্প নয়। রোগিণীর গল্প-ও নয়। আজ তুহিনা-র গল্প।
‘ডাক্তার বাবু, ছোটবেলায় বেশী দৌড়োদৌড়ি করলে কি হাঁটুতে বাত হয়?’
‘এমনি দৌড়োদৌড়িতে আর কি হবে? তবে প্রফেশনাল অ্যাথলিটদের ক্ষেত্রে বয়স হলে হাঁটুতে বাত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী থাকে।’
প্রেসক্রিপশন টাইপ করছি আর তুহিনার সাথে কথা বলছি। রোগিণী বাইরে গিয়ে বসেছে।
‘আমার মাঝে মাঝে হাঁটুতে ব্যথা হয়।’
‘তোমার এখনো বাত হওয়ার বয়স হয় নি। আর ওসব প্রফেশনাল অ্যাথলিটদের বয়সকালে হয়। তোমার এত তাড়াতাড়ি হবে না। যাকগে, তোমার বড়মা-কে ডাক। ওনাকে প্রেসক্রিপশনটা বুঝিয়ে দিই।’
তুহিনা তার বড়মাকে ডাকার ধার দিয়েও গেল না। সে বলল, ‘আমিও তো স্টেট চ্যাম্পিয়ান ছিলাম!’
‘অ্যাঁ? কিসে?’
‘দুশো মিটারে। লংজাম্পেও গোল্ড ছিল।’
‘ছিল কেন, আছে বল।’
‘আর আছে! সব বেচে খেয়ে নিয়েছে!’
‘তারপর? ন্যাশন্যালে?’
তুহিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর সব বন্ধ।’
‘ন্যাশন্যাল গেমসে নামলে না?’
‘নাঃ। যেতে দিল না। বাড়ির বৌ হাফপ্যান্ট পরে দৌড়বে? তারপর আমরা মু*স*লী*ম। যেতে দেয়!’
‘সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি পরে দৌড়নো যায় নাকি?’
‘কে ওদের বোঝাবে?’ তুহিনার চোখে জলের ধারা।
‘পিঙ্কি প্রামানিক কে মনে আছে স্যার?’
‘হ্যাঁ মনে আছে তো, এশিয়াডে সোনা জিতেছিল।’
‘আমার থেকে দু বছরের সিনিয়ার। আমরা একসাথে সল্টলেক সাই-তে প্র্যাকটিস করতাম।’
‘ও তাই নাকি?’
‘একসময় স্বপ্ন দেখতাম, এশিয়াডে নামব, মেডেল জিতব। আর আজ? আমার বান্ধবীরা এশিয়াডে দৌড়ল। আর আমি বাড়িতে ধান সেদ্ধ করলাম!…..’
একটু থেমে আবার বলল, ‘লং জাম্পে সাড়ে ছ’মিটার লাফিয়ে ছিলাম, জানেন? পুলিশে চাকরি পেয়ে যেতাম। ইন্টারভিউতে ডেকেওছিল।’ গলা বুঁজে এল তার।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, মেয়েদের খুব সমস্যা। সমাজ, সংসার, ছেলেমেয়ে দেখে আর এসব হয়ে ওঠে না।’
‘তখন কত কত জায়গায় ফাংশানে সম্বর্ধনা দিত!! একবার শেয়ালদায় ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম- একটা মেয়ে ট্রেনের টিকিট চেকার….আমাদের সাথে খেলত …..মেয়েদের বিয়ের আগেই যা করার করে করে নিতে হয় স্যার, বুঝলেন। তারপরে আর কিছু হয় না।’ তুহিনা-র গলায় স্পষ্টতঃই দীর্ঘশ্বাস।
‘যাকগে, যা হয়েছে, হয়েছে। এখন বাড়ির কাছাকাছি স্কুলের বাচ্চাগুলোকে তো শেখাতে পারো?’
‘হ্যাঁ, ডেকেছিল তো! এই সেদিনও, দত্তপুকুরের স্কুলে। আগেও কয়েকটা স্কুলে চাকরি পেয়েছিলাম। কিছুতেই করতে দিল না।’
‘কেন? স্কুলে কি সমস্যা ?’
‘দেবে না, কি করব! এখন বুঝছে। বাবা রিটায়ার করে গেছে। একা সংসার চালাতে পারছে না।’ চোখ মুছতে মুছতে বলে।
কি বলব ভেবে পেলাম না।
তুহিনা বলল, ‘অনেক মনের কথা বলে ফেললাম স্যার। আজ বাড়ির কেউ সঙ্গে নেই তো, তাই। কিছু মনে করবেন না।’ তারপরে যোগ করল, ‘তবে বড় ছেলেটা মনে হচ্ছে খেলাধূলোয় ভালো করবে!’
বললাম, ‘বাঃ’
যেতে যেতে চোখ মুছে হেসে বলল, ‘যাই।’