আমি হাড়ের ডাক্তার। অর্থোপেডিক রোগী দেখি। হাড়,অস্থিসন্ধি বা মেরুদন্ডে চোট নিয়ে রোগীরা আসে। ডাক্তার বা হাসপাতালে আসার আগে চোট পাওয়া অনেক রোগীই কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা করে আসে। তাতে রোগীর কষ্ট লাঘব হয়। চোট পরবর্তী ক্ষতি কমে। উন্নত দেশে এই প্রাথমিক চিকিৎসা বা শুশ্রূষা বিষয়টা খুব সংগঠিত। প্রশিক্ষিত অচিকিৎসক চিকিৎসাকর্মীরা এই প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কারণ কোনো দেশেই সমাজ বা লোকালয়ের প্রতিটি কোনে কোনে স্পেশালিষ্ট চিকিৎসক পাওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের বিষয়টা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানেও প্রাথমিক শুশ্রূষা হয়- তবে তা প্রশিক্ষিত চিকিৎসা কর্মীর অভাবে মাসী-পিসি, ঠাকুমা-দিদিমার কাছে প্রশিক্ষিত আর আজকাল গুগুল প্রশিক্ষিত এবং উৎসাহী (রোগীর) বাড়ির লোকদের রোগীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লতা-পাতা, গাছের ছাল-বাকল, বাঁশের বাখারি, কাঠের টুকরো ইত্যাদির সাহায্যে হয়ে থাকে।
বছর পনেরো আগে সকালে এক নার্সিংহোমে অপারেশন করছিলাম। অপারেশন শেষে গ্লাভস খুলে হাত ধুচ্ছি। রবিবার। সেদিন আর কোনো কাজ নেই বলে মনে ফুরফুরে আনন্দ। এমন সময় একজন ওটি ষ্টাফ বলল, ‘নীচের চেম্বারে একজন পেশেন্ট আছে, স্যার।’
‘আজকে? আজ তো রবিবার!’
‘হ্যাঁ। আজকেই এসেছে।’
হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত হবে না।’ ঠিক আছে, বসতে বলো। চা খেয়ে যাচ্ছি।’
‘না স্যার, আগেই যান। চা পরে খাবেন।’
আশ্চর্য হলাম। এমার্জেন্সি না হলে নার্সিং হোমের ষ্টাফেরা এমনভাবে বলে না তো!
‘এমার্জেন্সি পেশেন্ট না কি?’
‘পেশেন্টের এমার্জেন্সি না, নার্সিং হোমের এমার্জেন্সি।’
বিষয়টা গোলমেলে বুঝেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরোলাম। কোনো বড়সড় নেতা-মন্ত্রীর জানাশোনা হতে পারে!
লিফটটা একতলা নামতেই ভক্ করে পচা গন্ধটা নাকে এল।
দুর্গন্ধ আমাকে সহজে কাবু করতে পারে না। অ্যানাটমি হলে ডিসেকশনের পরে দিনের পর দিন ঝাঁঝালো ফর্ম্যালিন জর্জরিত ডেডবডির দু-গজ দূরে বসে থেকেছি। টিফিন কৌটো খুলে বাড়ি থেকে আনা রুটি-আলুচচ্চড়ি দিয়ে লাঞ্চ করেছি। পুলিশ মর্গে ফরেনসিক মেডিসিনের ক্লাসে পচাগলা বেওয়ারিস বডির পোষ্টমর্টেম দেখেছি। এখনো কোনো কোনো অর্থোপেডিক কোর্সে পড়াতে গেলে Cadaver ডাকে, ‘আয়, আয়, আয়।’
সেই আমি এই পচা গন্ধে একেবারে ব্যোমকে গেলাম। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে লিফট থেকে বেরোতেই দেখলাম আমার সহকারী যুগল, মানে সুভাষ আর সমীরদা, রুমালে নাক-মুখ চাপা দিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।
(সুভাষ আজ আকাশের ওপারে। ঘটনাটা বিশ্বাস না হলে সমীর-দা কে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে।)
রিসেপশনে একজন মুখে গামছা বেঁধে বসে আছে। লিফটম্যান, রিসেপশনিষ্ট, সিকিউরিটি সহ বাকি লোকজন সব উধাও!
চেম্বারে ঢুকতেই গন্ধের উৎস আবিষ্কার করা গেল। পচা মাংসের গন্ধে আমারও তখন গা গুলিয়ে বমি আসছে। ট্রলিতে শুয়ে আছে একটি মাঝ বয়স্ক লোক। তার হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে কিছু জড়ানো। পায়ের এক্সরে-টা ভিউ বক্সে লাগানো রয়েছে। টিবিয়া-ফিবুলা ফ্র্যাকচার। ন্যাকড়া খুলতেই তার ভিতর থেকে কালচে থোকা থোকা কিছু জিনিস বেরিয়ে। রোগীর পায়ের চামড়া প্রায় পুরোটাই পচে গেছে। বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি এগুলো?’
‘কই মাছের মাথা।’
‘কোথা থেকে করিয়েছ এসব?’
‘ডায়মন্ড হারবার।’
তার কথায় জানা গেল, পা ভাঙতেই রোগীকে ডায়মন্ড হারবার-এর এক Bone setter এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক মাস আগে। সে নাকি অনেকগুলো কই মাছের মাথা থেঁতলে তাই দিয়ে পুলটিস বানিয়ে হাড়ভাঙা রোগীর ভাঙা হাতে বা পায়ে ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে দেয়। ওতে নাকি হাড় জোড়ে।
পনেরো বছর আগেকার কথা। নতুন নার্সিং হোম। ঝাঁ চকচকে মেঝে ও দেওয়াল ফিনাইল ইত্যাদি সহ বালতি বালতি জলে ধুয়েও গন্ধ গেল না। নানান সুগন্ধ দ্রব্য ছড়ানো হল। রোগীর পায়ের ড্রেসিং করলাম। কিন্তু তারপর অন্য রোগী ও তাদের বাড়ির লোক এবং কয়েকজন ষ্টাফের প্রবল আপত্তিতে রোগীকে ভর্তি করতে পারছিলাম না। শেষে সবাইকে অনেক বুঝিয়ে এক আইসোলেশন ওয়ার্ডে কোনো মতে, যাকে বলে, গ্যারেজ করা হল। তার পরের দু-তিনদিন অন্য রোগীদের বিরক্তি, উষ্মা ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রোগীর চিকিৎসা চলল। আস্তে আস্তে পায়ের দুর্গন্ধ কমে আসে। প্লাষ্টিক সার্জেনের সহায়তায় বেশ কিছুদিন ধরে অনেক কসরত করে রোগীকে সুস্থ করেছিলাম সে বার।
মাসি-পিসি, ঠাকুমা-দিদিমাদের কথা লোকে এত শোনে এবং বিনা প্রশ্নে বাধ্য ছেলেমেয়ের মত মেনে নেয়- ডাক্তারি পেশায় ঢোকার আগে এ আমার জানা ছিল না। কলেজে সদ্য চাকরি পাওয়া তরুণী সহকারী অধ্যাপিকা স্কুটি চালাতে গিয়ে পা মচকেছেন। ফোলা গোড়ালি নিয়ে চেম্বারে ঢুকছেন। পায়ের চামড়া পুরো হলুদ।
‘এটা কি লাগিয়েছেন?’
‘চুন-হলুদ।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু লাগিয়েছেন কেন?’
‘সবাই তো বলে…’
‘সবাই মানে? কে বলে?’
‘মা, মাসি, বাড়ির বড়রা।’
‘বড়দের কথা আপনি সব শোনেন?’
তিনি আর জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকেন।
‘চোট লাগলে ভালো করে বরফ লাগাবেন, বুঝলেন। চুন-হলুদে চামড়ার খুব ক্ষতি হয়।’
কে শোনে কার কথা!
কুড়ি বছর হয়ে গেল। তখনকার মা মাসিরা এতদিনে বুড়ি এবং ঠাকুমা-দিদিমারা অনেকেই হয়ত পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। কিন্তু ‘চুন-হলুদ’ লাগানোর ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।’ অজুহাত দেওয়ার নতুন নতুন ঠাকুমা-দিদিমা আমদানি হয়েছে।
তবে গতকাল যা হল, তা একেবারে কল্পনাতীত। বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন চেম্বারে। বছর খানেক আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ককসিক্স বা Tail bone এ ব্যাথা। সাধারণ কিছু চিকিৎসা বললাম।
‘ওসব করা হয়ে গেছে।’
‘গরম জলের সেঁক করুন।’
‘সব করা হয়ে গেছে। ব্যাথা কমছে না। আপনি ওটিতে নিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিন।’
‘সব মানে? আর কি করেছেন?’
রোগীর স্ত্রী মাথা নীচু করে বললেন, ‘চুন-হলুদ গরম করে লাগিয়েছি।’
‘অ্যাঁ! ওখানে? পুড়ে যায় নি?’
ভদ্রলোক প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘গেছিলো তো!’
এ সমাজে সক্কলেই জন্মগতভাবেই চিকিৎসক। পরে এদের মধ্যে থেকেই অনেকে পড়াশোনা করে বিশেষজ্ঞ হন আরকি।
gazim4838@gmail.com