ধরুন মাঝ রাস্তায় আপনার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। কিছুতেই আর ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। তখন কি করা হয়?
আপনি বা ড্রাইভার গাড়ির ষ্টিয়ারিং ধরে ড্রাইভার সীটে বসেন। তারপর অন্য যাত্রী বা আশেপাশের লোকদের অনুরোধ করেন গাড়ি ঠেলতে। গাড়ি ঠেলে মাঝরাস্তা থেকে পথের ধারে নিরাপদ জায়গায় গাড়িটা সরিয়ে নেন। ট্রাফিক পুলিশ কাছাকাছি থাকলে তিনিও সাহায্য করেন। তারপর ফোন করেন গ্যারেজ বা সার্ভিস কেন্দ্রে। তারা গাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্রেন পাঠিয়ে গাড়ি সারাতে নিয়ে যান। তাই না?
আপনি কি গাড়ি টেনে নিয়ে মাঝরাতে গাড়ি মিস্ত্রির বাড়িতে উপস্থিত হন? সোজা সাপ্টা উত্তর হল- না। কারণ গাড়ি মিস্ত্রি আপনার গাড়ি সারানোর জন্য যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে মাঝরাতে বসে নেই। আর খালি হাতে সে আপনার গাড়ির একটা নাটবল্টুও খুলতে পারবে না।
তাহলে মাঝরাতে জটিল মরণাপন্ন রোগী নিয়ে ডাক্তারের বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হন কিসের আশায়? ডাক্তার কয়েকটা মন্ত্র পড়ে মরণাপন্ন বা দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগীকে ভালো করে দেবে?
আপনি কি আশা করেন?
১. ডাক্তার তার বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ই সি জি মেশিন, এক্স রে মেশিন, স্যালাইনের নল এবং বোতল, ডিফিব্রিলেটর মেশিন, ল্যারিঙ্গোস্কোপ, এন্ডোট্রেকিয়াল টিউব (যে নল শ্বাসনালীতে প্রবেশ করিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখা হয়) এবং জরুরী ওষুধ, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি মজুত করে রাখবে।
২. ডাক্তার তার বাড়িতে একাই দশ হাতে এই সব যন্ত্রপাতি চালাবে।
৩. তারপর রোগীর প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেই মাঝরাতে অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করবে।
আপনি বলবেন, গাড়ি আর মানুষের শরীর কি এক ? সত্যিই এক নয়। গাড়ি গেলে কষ্টেসৃষ্টে আর একটা গাড়ি জোগাড় করা যাবে। কিন্তু জীবন অমূল্য। প্রাণ গেলে আর তা পাওয়া যায় না। তাই যেনতেন প্রকারে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
কিন্তু শুধু উদ্দেশ্য থাকলেই তো হবে না, উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে। কিন্তু তা কি খালি হাতে হবে? নিজের বাসস্থলে ডাক্তারের সম্বল তো দুটো হাত আর একটা মস্তিস্ক। বেসিক লাইফ সাপোর্টের প্রশিক্ষণ তার নেই। আর কোনো এককালে ট্রেনিং নিয়ে থাকলেও চর্চার অভাবে বিস্মৃতির অতলে। খালি হাতে তিনি নিধিরাম সর্দার! সামনে উদ্যত শত্রু- ভয়াল মৃত্যু। চারিদিকে অসহযোগী ভীড়। যারা সামান্য অসাফল্যে ডাক্তারের গর্দান নেওয়ার জন্য তৈরী।
আরো কথা আছে। জরুরী অসুস্থতা, যেমন- স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, অ্যাক্সিডেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে সময়ই হল আসল রাজা। ডাক্তারি পরিভাষায় বলে ‘গোল্ডেন আওয়ার (‘golden hour’)। অর্থ্যাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। নাহলে সব শেষ। সেই সময় পার হয়ে গেলে পরবর্তীকালে ভালো চিকিৎসা দিয়েও আর কোনো লাভ হয় না। এই জন্যেই এমার্জেন্সী বিভাগ। এই ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত প্রাথমিক সাড়াদানকারী (trained first responder) ও চিকিৎসা কর্মী (paramedic) দের ভুমিকা।
স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, অ্যাক্সিডেন্ট হঠাৎ করে হয়। রাস্তায়, কর্মস্থলে বা বাড়িতে। ভোরে, দুপুরে, মাঝরাতে, শেষরাতে- যে কোনো সময়। সব সময়, সব পরিস্থিতিতে, সব জায়গায় উপযুক্ত ডাক্তার কে ঘটনাস্থলে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে তো নয়ই, উন্নত দেশেও নয়। শহরাঞ্চলে ও কিছু কিছু গ্রামাঞ্চলে হাসপাতাল ও এমার্জেন্সী বিভাগ আছে। কিন্তু সেখানে নিয়ে যেতে এত সময় লাগে যে, ততক্ষণে চিকিৎসার উপযুক্ত সময় (golden hour) পার হয়ে যায়। হাসপাতালের চিকিৎসকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
তাহলে এই সমস্যার সমাধান কি নেই? উত্তর হল- আছে। প্রাথমিক সাড়াদানকারী (first responder) দের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রশিক্ষিত এবং আধুনিক এমার্জেন্সী চিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত চিকিৎসাকর্মীর (paramedic) সুশৃঙ্খল বাহিনী তৈরী করা। অ্যাপ,ওয়েবসাইট এবং মোবাইল ফোন দ্বারা সংযোজিত (connected) উপযুক্ত সংখ্যক অ্যাম্বুলেন্স বাহিনী (fleet) তৈরী রাখা যারা বার্তা পাওয়া মাত্র ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে রোগীকে সিপি আর বা কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (Cardiopulmonary resuscitation) বা কার্ডিয়াক ম্যাসাজ, ডিফিব্রিলেশন, কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। এগুলোর কোনটা একজন ডাক্তারের পক্ষে বাড়িতে বা খালি হাতে একার পক্ষে করা সম্ভব? বলা বাহুল্য সম্ভব নয়।
উন্নত দেশগুলোতে সারা দেশ জুড়ে এমার্জেন্সী সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। সেখানে তিন অঙ্কের একটা টেলিফোন নম্বর কোনোক্রমে ডায়াল করতে পারলে অ্যাম্বুল্যান্স-সহ প্যারামেডিক টীম অকুস্থলে পৌঁছে যায়।
আমাদের দেশেও দুয়েকটা শহরে বিচ্ছিন্নভাবে এবং বেসরকারী উদ্যোগে এই প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যাগের অভাবে এবং সারা দেশ জুড়ে ব্যবস্থা করা যায় নি বলে এই প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। এখন প্রশ্ন হল, কোনোভাবেই কি এই এমার্জেন্সী মেডিক্যাল সার্ভিসের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়?
সম্ভব। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন- সারা দেশ জুড়ে সরকারি উদ্যোগ, মানুষের সচেতনতা,
প্রাথমিক সাড়াদানকারী (first responder) দের প্রশিক্ষন, উৎসাহ, কর্মদক্ষতা, কর্মসংস্কৃতি এবং সরকারী অর্থবরাদ্দ।
আমাদের দেশ হচ্ছে ব্যক্তিপূজার দেশ। এখানে সংগঠিত সিষ্টেম বা ব্যবস্থাপনার চেয়ে কোনো একজন সফল ব্যক্তির ভাবমূর্তি জনসাধারণ, সমাজ ও প্রশাসনের কাছে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। একজন সফল ও জনপ্রিয় অভিনেতা, সংগীতশিল্পী, সফল খেলোয়াড়, সফল চিকিৎসক, সফল সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে রাজনৈতিক লাভ ওঠানোর চেষ্টা হয়ে থাকে। আর সাধারণ মানুষ দৌড়য় খ্যাতি ও নামের পিছনে। এটাই আমাদের দেশে স্বাভাবিক। তাই একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকের কাছে রোগীর ভীড় উপচে পড়ে। যশস্বী চিকিৎসককে নিয়ে মাতামাতি হয়, কিন্তু কার্যকরী কোনো সিষ্টেম গড়ে ওঠে না।
সাধারণ মানুষ ব্যক্তিপূজা করে, যশের পেছনে ছোটে- সেটা তবু মানা যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যখন নিয়মবহির্ভুতভাবে যশস্বী ব্যাক্তির দিকে হেলে পড়ে- তখন দৃষ্টিকটু লাগে। শল্যচিকিৎসক বা পরিপাকতন্ত্রের বিশেষজ্ঞের কাছে অতিমারী বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কড়িকাঠ গোনে।
তাই গ্রাম্য মানুষ যে হার্ট অ্যাটাকের রোগী নিয়ে পাড়ার ডাক্তারবাবুর বাসস্থানের দোরগোড়ায় ফেলে রেখে আসন্ন মৃত্যুকে তরান্বিত করবে এবং তারপর মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারী পেশার মুন্ডু চিবিয়ে খাবে- এ আজকাল প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা।
অথচ মুমুর্ষ, অজ্ঞান অথবা দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগীকে অসময়ে, অস্থানে হাটে-ঘাটে-মাঠে-রাস্তায়-বাড়িতে খালি হাতে পুনরায় শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্র চালু করতে একজন বেসিক-লাইফ-সাপোর্টে-অপ্রশিক্ষিত সাধারণ চিকিৎসকের থেকে একজন প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত স্বাস্থ্যকর্মী (paramedic) অনেক বেশী কার্যকর- এই বিষয়টা আমাদের দেশের সরকার, মিডিয়া, জনসাধারণ- কেউই বোঝে না বা বুঝতে চায় না।
এমনকি প্রথম সাড়াদানকারী (first responder) যেমন- ট্রাফিক পুলিশ, গাড়ির ড্রাইভার, ছাত্র-ছাত্রী, ক্রীড়াকর্মী, খেলোয়াড়- এদের সিপিআর (cardiopulmonary resuscitation) এবং বেসিক লাইফ সাপোর্টের প্রশিক্ষণ দিলে তারা হৃদযন্ত্রের গোলমাল, দুর্ঘটনা বা অন্য কারনে হঠাৎ জ্ঞান হারানো রোগীর প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারে- সমগ্র বিশ্বে এরকম ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। তবু সারা ভারত জুড়ে এই ধরণের প্রশিক্ষন দেওয়ার কোনো সামাজিক বা সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। শুধু মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে এখানে-ওখানে কোনো কোনো প্রচেষ্টা হয়। ১৪০ কোটি জনসংখ্যায় তা খুবই নগণ্য।
এই রকমই এক প্রচেষ্টা ভারতীয় অস্থিচিকিৎসা সংস্থা ( Indian Orthopaedic Association) প্রতি বছর আগষ্ট মাসে করে থাকে। সেই প্রচেষ্টার ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে এক প্রশিক্ষণের আয়োজন গত দুবছর যাবৎ করছি। তবে তার অভিজ্ঞতা খুবই করুণ। ২০২১ সালে নিজের কোভিড পরবর্তী অসুস্থ অবস্থায় প্রায় একশ’ জন পুলিশকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আমন্ত্রণ জানালাম সেন্ট জনস অ্যাম্বুলেন্স হলে। ট্রেনিং নিতে এল মাত্র নয় জন পুলিশকর্মী। তাদের মধ্যেও মাত্র চারজন পুরো প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। বাকীরা এসেছিল প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করতে। গত বছর প্রশিক্ষণ দিয়েছি একশ ছাত্র-ছাত্রীকে। তারা দেখলাম এই বিষয়ে খুব উৎসাহী- যেরকম হয়। কিন্তু হাতে কলমে কাজ এবং প্রশিক্ষণের পুনরাবৃত্তি না করতে পারলে তাদের এই টেকনিক ভুলতে সময় লাগবে না।
পুলিশের এক কর্তা এসেছিলেন কয়েকদিন আগে, নিজেকে দেখাতে। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম ব্যাপারটা। তিনি বললেন, ‘পুলিশকে দিয়ে আর কত কাজ করাবেন স্যার?’
সত্যিই তো দিনে-রাতে এত কাজ পুলিশদের করতে হয় এবং হচ্ছে!
কিন্তু সবশেষে তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? আমরা পরিকাঠামো গড়ব না, সচেতন হব’ না, রোগ প্রতিরোধ করব না, প্রশিক্ষণ নেবো না। শুধু বিপর্যয় ঘটে গেলে ঢাল-তরোয়াল বিহীন কয়েকজন নিধিরাম সর্দারের উপরে গায়ের ঝাল মেটাবো। এই-ই চলছে এবং চলবে।
চিত্র: অন্তর্জাল