ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চিকিৎসক ও বিজ্ঞান সাধক। তিনি অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ, জ্ঞানী অথচ কাঠখোট্টা মানুষ। শোনা যায়, তিনি এমনকি যুগপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবকেও বিশেষ তোয়াক্কা করতেন না। যদিও তিনি রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁদের দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট ছিল।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের মুখে কোনো কথাই আটকাত না।
একবার এক ধনীবাড়ির গৃহিণী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাঃ সরকারকে কল দিয়ে নিয়ে আসা হয়। সেই যুগে উচ্চকোটির হিন্দু মহিলারা ছিলেন পর্দানশীন। তাঁদের কাছে পরপুরুষের দর্শন ছিল নিষিদ্ধ। এদিকে অসুস্থ হলে সেই পুরুষ চিকিৎসকই তখন ভরসা। ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।
মহিলা রোগীদের বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা করা খুব কঠিন ছিল সে যুগে। কারণ ডাক্তারী পরীক্ষা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে একটা লম্বা ষ্টেথোস্কোপ ডাক্তারের কানে থাকত। রোগিণী এং ডাক্তারের মাঝে থাকত মোটা পর্দা। রোগিণীর বাড়ির লোকেরা ষ্টেথোস্কোপের বেল অংশটা নিয়ে ডাক্তারের অগোচরে রোগিণীর বুকে চেপে ধরত। ডাক্তার না দেখে কানে রোগীর হৃদস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেতেন। এইভাবেই চেষ্টা হত রোগিণীর রোগনির্ণয়ের।
আবার ফিরে আসি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের গল্পে। লম্বা ষ্টেথোস্কোপ নিয়ে অদৃশ্য রোগিণীর চিকিৎসার চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিলেন ডাঃ সরকার। রোগীর পরিবারের প্রতি খিঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘ষ্টেথোস্কোপ কোথায় লাগাচ্ছে- বুকে, নাকি _ দে, কিছুই বোঝার উপায় নেই। এভাবে কি ডাক্তারি করা যায়? চুলোয় যাক’
এই বলে তিনি বিদায় নিলেন।
তিনি তো ছাড়লেন। তারপর কয়েক যুগ পরে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং আরো কয়েকজন নারী চিকিৎসক এলেন। নারীদের আধুনিক চিকিৎসা শুরু হল। বাংলার নবজাগরণের প্রভাবেই হোক আর ইউরোপীয় প্রভাবেই হোক- নারীরা শিক্ষায়, শিল্পে, সাহিত্যে, বানিজ্যে, রাজনীতিতে,অর্থনীতিতে ক্রমশঃ এগিয়ে এলেন। আজ দেড়শ বছর বাদে পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তিত। কিন্তু চিকিৎসায় নারীদের অংশগ্রহণ কি এখনও পর্যাপ্ত?
জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। অথচ স্বাস্থ্যকর্মীদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মহিলা- তাও নার্সদের ধরে। এই পার্থক্য শুধু আমাদের দেশে নেই, সারা পৃথিবীতে আছে। তাই ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ, সংস্কার যাই থাকুক না কেন মহিলাদের চিকিৎসায় পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী।
ব্যপারটা শুধু একতরফা নয়, অন্য লিঙ্গের স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে চিকিৎসা নিতে কারও ব্যক্তিগত আপত্তি বা অস্বস্তি থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে, বিশেষতঃ মহিলা রোগীদের পরীক্ষা করার সময় মহিলা অ্যাটেন্ড্যান্ট রাখার বিধান আছে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে- যেমন, জরুরী জীবনদায়ী পরিস্থিতিতে, সবসময় মহিলা অ্যাটেন্ড্যান্টের
উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করার সময় নাও থাকতে পারে। মৃত্যুপথযাত্রী মহিলা রোগীকে পুরুষ স্বাস্থকর্মী বা first responder তৎক্ষণাৎ লাইফ সাপোর্ট দিতে শুরু করবে, নাকি মহিলা অ্যাটেন্ড্যান্টের জন্য অপেক্ষা করবে? জানি না।
স্ত্রী-পুরুষ ভেদে রোগের কিছু কিছু তফাৎ হয় ঠিকই। অ্যাটেন্ড্যান্ট পর্যন্ত তবু ঠিক আছে, কিন্তু সমলিঙ্গের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া অবধি রোগীর চিকিৎসা শুরু করা না গেলে হাত গুটিয়ে বসে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী থাকতে হবে। আজকাল সমাজের পরিস্থিতি এতটাই প্রতিবর্তী (regressive)।
কিন্তু কিছু করারও নেই। যেখানে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-চিকিৎসককে সন্তানসমা মহিলা রোগীকে পরীক্ষা করার অপরাধে জেল খাটতে হয, সেখানে পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ব্যপারে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর বিষয়টা শুধু মহিলাদের দিকে একতরফা নয়। উভয় পক্ষেরই পছন্দ-অপছন্দ, স্বস্তি-অস্বস্তি থাকতে পারে।
কয়েকটা সত্যি ঘটনা বলি। ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার হবে।
ঘটনা ১: আমার ছোটবেলার এক বন্ধু আমার কাছে এসেছিল পশ্চাদ্দেশে প্রবল ব্যথা নিয়ে। বন্ধুটি খুবই লাজুক। কিছুতেই ব্যথা কমছে না। শেষমেষ দেখা গেল অপারেশন করা দরকার। কারণ নিতম্বে পূঁজ জমে আছে। রোগীকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তখনও সার্জেনস রুমে। ওটি-র পোষাক পরছি। ওটি নার্স এসে বলল, ‘স্যার, আপনার বন্ধুকে কিছুতেই অজ্ঞান করা যাচ্ছে না।’
অপারেশন রুমে গিয়ে দেখলাম সেখানে রোগী বাদে সবাই নারী। এমনকি অ্যানাসস্থেটিষ্ট পর্যন্ত। তাই রোগী পোষাক খুলে অপারেশন টেবিলে শুতে রাজী হচ্ছে না। অস্বস্তিবোধ করছে। আমি গিয়ে বোঝাতে কাজ হল। অজ্ঞান করে অপারেশন করা গেল।
ঘটনা ২: আমি তখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ি। পাড়ার ক্লাবের এক পরিচিত বন্ধু এসেছে চোখের সমস্যা নিয়ে। তাকে চোখের ডিপার্টমেন্ট আর আই ও তে বসিয়ে দিয়ে ক্লাস করতে চলে গেছি। ক্লাস করে ফিরে গিয়ে শুনি বন্ধুটি চলে গেছে। তাকে আর খুঁজে পেলাম না। তখনো মোবাইল ফোন আসে নি। পরে একদিন পাড়ায় দেখা হতে বলল যে, আর কোনোদিন মেডিক্যালে চোখ দেখাতে যাবে না। কেন জিজ্ঞেস করাতে বলল যে, মহিলা অপটোমেষ্ট্রিষ্টের ব্যবহার ভাল লাগে নি।
‘সে কি, কেন? কি হয়েছিল?’
অনেক চাপাচাপির পরে সে বলল যে, অপথালমোস্কোপি করার সময় অপটোমাট্রিষ্টের চোখ ও ঠোঁট দুটো নাকি ওর খুবই কাছে চলে এসেছিল। সেই যৌবন বয়েসে আমরা সব বন্ধুরা ওকে এই নিয়ে খুব আওয়াজ দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা একটা বাস্তব সমস্যা। অনেক পুরুষ রোগীরও মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে অস্বস্তি হয়। অথচ তারা লজ্জায় মুখ খোলে না।
ঘটনা ৩: মিউনিখের হাসপাতালে ফেলোশিপ করছি। ক্রিস্তফ মায়ান, আমার মেন্টর প্রফেসর মাইকেল মেয়ারের জুনিয়র কনসালট্যান্ট। ক্রিস্তফ আমারই বয়সী। স্কোলিওসিস ক্লিনিক চালায়। প্রথম দিন আমাকে বলল ওর ক্লিনিকে চলে আসতে। সপ্তাহে একদিন। সকাল আটটা থেকে শুরু হয়। সন্ধ্যা ছটা অবধি চলে। ক্লিনিকে আমি আর মেয়ান। একজন নার্স পর্যন্ত নেই। দ্বিতীয় সপ্তায় দু-তিনটে রোগী দেখার পর একসময় ক্রিস্তফ বলল,
‘তুমি রোগী দেখতে থাকো, আমি ওয়ার্ডে একটা কাজ করে আসছি।’
তারপরের প্রথম রোগী উনিশ বছরের কলেজ গার্ল। স্কোলিওসিস অপারেশন হবে। মায়ের সাথে এসেছে। তার পিঠ পরীক্ষা করে কতটা বাঁকা সেটা মেপে দেখতে হবে। আমি নার্সের জন্য অপেক্ষা করছি। রোগীর মা আমার সামনে বসে। আর রোগী পর্দার ওপাশে তৈরী হয়ে অপেক্ষা করছে। ভাষার সমস্যা। দুজনের কেউ বুঝতে পারছে না, আমি চুপচাপ বসে আছি কেন। কিছুক্ষণ পরে ক্রিস্তফ এসে হাজির হল। ‘তুমি বসে আছ কেন? কিছু সমস্যা?’
‘ফিমেল অ্যাটেনন্ড্যান্ট এখনো আসে নি।’
‘ফিমেল অ্যাটেনড্যান্ট? সেটা কি?’
‘না, মানে নার্স তো আসবে!’
‘ওসব এখানে লাগে না।’
ততক্ষণে মা-মেয়ে দুজনেই দেরির কারণ বুঝে হাসতে শুরু করেছে। রোগিণী তো অন্তর্বাস পরিহিতা অবস্থায়ই পর্দার ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে মায়ের কাছে চলে এসেছে। ক্রিস্তফ-ও হাসছে। আর আমি সবার মাঝে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি।
ঘটনা ৪: সদ্য ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা প্রায় সবাই জানেন। কলকাতার মা ফ্লাইওভারের উপরে এক ভদ্রমহিলা দুর্ঘটনায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান এবং তাঁর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। তখন গাড়ি চড়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন দুজন চিকিৎসক। তাঁরা তক্ষুণি ভদ্রমহিলাকে রাস্তায় শুইয়ে বেসিক লাইফ সাপোর্ট এবং সি পি আর দিতে শুরু করেন। রোগীর হৃদস্পন্দন ফের চালু হয়। তখন তাঁকে ওই দুজন ডাক্তারই গাড়িতে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। রোগী বেঁচে যান।
সিপিআর বা কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন রোগীর বুকে জোরে চাপ দিয়ে হৃদযন্ত্র চালু করার চেষ্টা করা হয় এবং মুখে ফুঁ দিয়ে কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু করা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু কেউই রোগী নারী, ডাক্তাররা পুরুষ, ফিমেল অ্যাটেনড্যান্ট চাই- ইত্যাদি প্রসঙ্গ তোলে নি। উঠলে ওই রোগী আর বাঁচত বলে মনে হয় না।
ঘটনা ৫: সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের অর্থোপেডিক আউটডোর। ওখানকার সদ্য পাশ করা এক তরুণ দক্ষিণ ভারতীয় চিকিৎসক মণিকরণ (নাম পরিবর্তিত) আরো অন্যান্য চিকিৎসকের সাথে পালা করে রোগী প্রাথমিক ভাবে দেখে প্রফেসরের কাছে কেস হিষ্ট্রি বলছে। এক ইন্দোনেশীয় সুন্দরী তরুণী রোগী খেলতে গিয়ে উরুসন্ধিতে চোট পেয়ে হাসপাতালে দেখাতে এসেছেন। একাই। সঙ্গে বন্ধু বা সঙ্গী কেউ নেই। পরনে শর্টস এবং স্পোর্টস ব্রা। ওদেশে এটা খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোগিণীকে পরীক্ষা করতে এবার ডাঃ মণিকরণের পালা। তাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখে চীনা প্রফেসর বললেন,
‘নার্সকে চাই?’
মণিকরণ বলল, ‘হ্যাঁ’
সিঙ্গাপুরে মহিলা রোগীকে দেখার সময় ফিমেল অ্যাটেন্ড্যান্ট বাধ্যতামূলক নয়। এই রোগিণীরও সেই ব্যাপারে কোনো দ্বিধা আছে মনে হল না।
মহিলা নার্সের উপস্থিতিতে রোগিণীকে পরীক্ষা করে এসে মণিকরণ বলল,
‘উপযুক্ত ব্যবস্থা উপলব্ধ থাকতে খালি হাতে আগুনে হাত দিয়ে হাত পোড়াব কেন?’
আমি বললাম, ‘তোমার নিজের উপর বিশ্বাস নেই?’
‘এখনো সেটা তৈরি হয় নি।’
এই ঘটনাগুলো থেকে আশাকরি এটা পরিষ্কার যে, সামাজিক পরিস্থিতি সব দেশে এক নয়। আমাদের দেশে সবসময়ই রোগীর পরীক্ষায় মহিলা অ্যাটেন্ড্যান্টের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। এখন আরো পিছিয়ে গিয়ে মহিলা রোগীর পরীক্ষা কেবল মহিলা চিকিৎসক বা টেকনোলজিষ্টকেই করতে হবে, এমন ধুয়ো তোলার চেষ্টা হচ্ছে- যেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। সুতরাং কোনো একটা জায়গায় সীমারেখা টানতে হবে।
বিপরীত লিঙ্গের চিকিৎসাকর্মীর কাছে শুধু মহিলা রোগীই নন, কোনো কোনো পুরুষ রোগীও অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিপরীত লিঙ্গের চিকিৎসাকর্মীর কাছে পরীক্ষা বা চিকিৎসা করাবেন কিনা তা রোগীর ব্যক্তিগত পছন্দ হতে পারে এবং সেই পছন্দকে সম্মান জানানো উচিত। তবে সেটা রুটিন এবং জরুরী নয় এরকম পরিস্থিতিতে। জরুরী এবং জীবনদায়ী পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অনেক সময় চিকিৎসাকর্মীও বিপরীত লিঙ্গের রোগীকে পরীক্ষা করতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনিও অ্যাটেন্ড্যান্ট চাইতে পারেন। তবে জরুরী পরিস্থিতিতে নয়।
জরুরী প্রয়োজনে মানুষের প্রাণ বাঁচানোকেই একমাত্র অগ্রাধিকার দিতে হবে। রোগী পুরুষ না মহিলা না তৃতীয় লিঙ্গের- সেসব ভাবলে চলবে না। দরকারে সেভাবেই আইন সংশোধন করতে হবে।
সবশেষে, এটা না বললেই নয় যে, প্রাচীন সংস্কার ছেড়ে সমাজকে প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর ‘ধর্মাবতার’-রা বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী অনুশাসন জারি করলে ভালো হয়।