আমরা সবাই জানি পুরুষের আয় আর মহিলাদের বয়স কখনো জিজ্ঞেস করতে নেই। সেটা ভদ্রতা বিরোধী। আরো জানি, সিনেমার নায়িকাদের বয়স প্রতি পাঁচ বছরে এক বছর করে বাড়ে। এগুলো অনেকটা পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো- স্বতঃসিদ্ধ।
তবে ডাক্তারি করতে হলে কখনো কখনো সামাজিক ভদ্রতার সীমারেখা পার হতে হয়। মানুষের মনের গোপন ঘরে আলো ফেলতে হয়, অনেক ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করতে হয়- অবশ্যই তা রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজনে এবং আইন ও সামাজিক প্রথা মেনে। রোগীর এইসব তথ্য অন্য কারো সাথে আদান-প্রদান করা আইনের চোখে গর্হিত অপরাধ।
আইনের কচকচি অনেক হল। আবার আমরা বয়সের মত হাল্কা বিষয়ে ফিরে আসি। মহিলাদের বয়স জিজ্ঞেস করার মত গর্হিত কাজটা আজকাল সরাসরি আমাকে করতে হয় না। আমার সহকারীরা এইসব প্রশ্ন করে উত্তরগুলো কম্পিউটারে এন্ট্রি করে দেয়। স্বভাবতঃই আমাকে আর নাম-ধাম, বয়স ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতে হয় না। আর হাসপাতাল-পলিক্লিনিকে বিলের মধ্যেই নাম-ধাম, বয়স ইত্যাদি উল্লিখিত থাকে।
আগে যখন প্রত্যেক রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স,অন্যান্য রোগের খবর নিজে লিখতে হত- তখন আমি, বিশেষতঃ মহিলাদের জিজ্ঞেস করতাম, ‘আপনার সঠিক বয়সটা বলুন।’ এই ‘সঠিক বয়স’ কথাটায় বেশ জোর দিতাম আর তাতে কিছু রোগী তাঁর সঙ্গী অথবা স্বামীকে খুব বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘এই বল না, আমার আসল বয়সটা কত?’
তখন স্বামী নামক আসামীটি ভিজে বেড়ালের মত মুখ করে বয়স খুঁজতে বসতেন। অনেক খুঁজে পেতে- ননদের বয়স, ননদ তার থেকে দু বছরের বড়- ইত্যাদি বিস্তর হিসেব কষে ‘সঠিক বয়স’ নির্ধারিত হত। ইদানিং অবশ্য আধার কার্ড-ভোটার কার্ডের যুগে বয়স নিয়ে এই বিভ্রান্তি কিছুটা হলেও কমেছে।
একবার এই ‘আমার আসল বয়সটা কত গো?’ প্রশ্নের উত্তরে এক আসামী বললেন, ‘তোমার আসল বয়স আমি কি করে বলব? আমি কি তখন ওখানে ছিলাম!’ অকাট্য যুক্তি। কিন্তু উত্তর শুনে মহিলা কটমট চোখে তাকালেন তাঁর স্বামীর দিকে।
আবহাওয়া বেগতিক দেখে আমি মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করি, ‘মোটামুটি একটা বয়স বলুন- তাহলেই হবে।’
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে এই পরিস্থিতিটা আবার উল্টে যায়। সত্তরের পর বয়সটা আবার লিপ ইয়ারের মত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
কোভিডের আগে ২০২০ সালে কমলদার পঁচাত্তর বছর উদযাপন করা হল। ২০২৩ এ এসে শুনি, তাঁর নাকি আশি হয়ে গেছে।
নব্বইয়ের কোঠা পার করতে পারলে সকলেই শতায়ু। ‘আমার ঠাকুমার তো এই একশ-এক হল!’ চেতন চৌহানের মত ‘নার্ভাস নাইনটি’-তে কতজন যে আউট হন- সে খবর কি এরা রাখেন!
এক বৃদ্ধ রোগীকে তাঁর ছেলেমেয়েরা ধরে ধরে আমার চেম্বারে নিয়ে এল। রোগী আমার পূর্বপরিচিত। বছর দশেক আগে তাঁর কোমরে অপারেশন করেছিলাম। এবার এসেছেন হাত ভেঙে। রোগীর ছেলে বললেন, ‘বাবার তো পঁচানব্বই। আর এই বয়েসে অপারেশনে যাব না।’
‘সে ঠিক আছে, কিন্তু পুরনো কাগজ বলেছে ২০১২ সালে ওনার বয়স ছিল আটাত্তর। তাহলে ২০২২ সালে পঁচানব্বই হয়ে গেল কি করে?’
এইসব ক্ষেত্রে কমন উত্তর যা হয় ভদ্রলোক তাই দিলেন, ‘ওই হল।’
তবে গতকাল যা হল, চুড়ান্ত বাড়াবাড়ি। এক মহিলা রোগী ও তাঁর স্বামী আমার চেম্বারে এসেছেন। ভদ্রমহিলার হাঁটুতে সামান্য ব্যথা। কম্পিউটারে দেখি বয়স লেখা রয়েছে একচল্লিশ।
‘হাঁটু ব্যথা ছাড়া আপনার আর কি রোগ আছে?’
‘ওই তো প্রেশক্রিপশন দিলাম। মধ্যমগ্রামে ডাঃ ভৌমিককে দেখাই।’
দেখলাম, রোগী উচ্চ রক্তচাপ এবং থাইরয়েডের ওষুধ খান। প্রেসক্রিপশনে বয়স লেখা চৌত্রিশ।
‘ডাঃ ভৌমিককে তো দেখিয়েছেন ডিসেম্বর মাসে। তখন আপনার বয়স ছিল চৌত্রিশ। চার মাসের মধ্যে সেটা বেড়ে একচল্লিশ হয়ে গেল কি করে?’
ভদ্রমহিলার তখন ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা।
তাঁর স্বামী বললেন, ‘আসলে ওই দিন তো আমি সঙ্গে যাই নি, তাই ওরকম হয়েছে।’