……ভোর হয়ে এসেছে। সিবি আপ ওয়ার্ড (দোতলা) থেকে নেমে এমার্জেন্সীর ঘুমন্ত ইন্টার্ন পিজিটি দের পাশ কাটিয়ে বাইরে এলাম। এমসিএইচ বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে চা-ওয়ালা চাচা তখনও বসে।
‘চা দেব নাকি?’
‘দাও’
গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছি। অনুভব করলাম পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
ঘুরে দেখলাম একটি মেয়ে। এইমাত্র দেখে আসা রোগীর বাড়ির লোক। সম্ভবতঃ তার বড় মেয়ে।
‘কিছু বলবেন?’
‘বাবা হাঁটতে পারবে তো?’
‘আপনি কি চিরঞ্জিত বাবু (নাম পরিবর্তিত)-র মেয়ে?’
‘হ্যাঁ, আমি বড়। সঞ্চিতা (নাম পরিবর্তিত) ছোট।’
একটু অযাচিতভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নাম?’
ভাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বলল
‘কবিতা।’
‘আচ্ছা আপনার বাবা কি সত্যিই জানলা গলে পড়ে গেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য! তা জানলাটা কত বড়?’
‘জানলাটা বড়, সত্যিই বড়। এটা বুঝতে গেলে আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।’
‘সেটা তো সম্ভব না, কিন্তু উনি পড়লেন কিভাবে? ময়লা ফেলতে গিয়ে? তাও মাঝরাতে?’
‘না, বাবা ময়লা ফেলতে গিয়ে পড়ে যান নি।’
‘তাহলে কিভাবে?’
‘জানি না। ওই সময় আমি ঘরে ছিলাম না।’
আশ্চর্য! এই বলছে, ময়লা ফেলতে গিয়ে পড়ে নি। পরক্ষণেই বলছে জানি না । একই বাড়িতে থেকে ‘জানে না’- কি করে হয়?
যাই হোক, এরপর হিরণ্ময় নীরবতা। আর কথা চলে না। অচেনা মহিলাকে সকালবেলা গতরাতের কান্ডকারখানার বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।
তাছাড়া অনিদ্রায় আমার চোখ জ্বালা করছে। জানতাম যে, না বলবে, তবু ভদ্রতা করে বললাম- ‘চা খাবেন?’
‘না, আপনি খান। আচ্ছা, পুলিশ কেস লিখল কেন?’
‘অ্যাক্সিডেন্ট কেস, ফ্র্যাকচার হয়েছে তো তাই।’
এবার তরুণীটি কেটে কেটে বলল, ‘ওরা কি করে শিওর হল যে, অ্যাক্সিডেন্ট?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তা বলতে পারব না। পুলিশ-কে জিজ্ঞেস করবেন। আমার কাজ চিকিৎসা শুরু করা, করেছি। থানাকে জানানো, জানিয়েছি। এবার চলি।’ ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। তাই আপাততঃ কেটে পড়লাম।
মেয়েটা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশ আসবে না কি?’
‘দরকার মনে করলে আসতেও পারে।’
হোষ্টেলে গিয়ে স্নান করে ঘন্টা খানেক ঘুমোনোর পরে লোকজনের চেঁচামেচিতে উঠে পড়লাম। গপ্গপ্ করে লুচি-আলুর তরকারি গলায় পুরে জামা গলিয়ে ওয়ার্ডে দৌড়। পোষ্ট-অ্যাডমিশন ডে মর্নিং রাউন্ড, সেমিনার, পরদিনের কোল্ড অপারেশন গুলোর প্রস্তুতি- অনেক কাজ বাকি।
গ্রীন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে দিতেই সিষ্টার-দের মুখে গতরাতে ভর্তি হওয়া রোগী আর তার বাড়ি লোকদের কথা শুনতে পেলাম। এমার্জেন্সী দিয়ে রোজ কতই তো অর্থোপেডিক রোগী ভর্তি হয়। তাদের নিয়ে তো এত চর্চা হয় না!
গ্রীণ ওটি তে একবার উঁকি দিয়ে গোটা ইউনিট সহ চললাম ক্যাজুয়াল্টি ব্লকের দিকে। লিফ্টের দরজায় পুরোনো দিনের কোলাপ্সিবল গ্রীল লাগানো। লিফ্টে উঠতে উঠতে তার ভেতর থেকে দেখলাম গতরাতের রোগী চিরঞ্জিত লাহাড়ীর বৌ আর ছোট মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাচ্ছে।
ওয়ার্ডে ঢুকতেই অনন্যা সিষ্টার (নাম পরিবর্তিত) কানের কাছে হিসহিসিয়ে বলে গেল, ‘বৌবাজার থানা থেকে পুলিশ এসেছে।’
পুলিশ তো হাসপাতালে হরবখত আসেই। দেখতে হবে কি জন্য এসেছে। রাউন্ড দিতে দিতে দেখলাম সাদা ড্রেস পরা কলকাতা পুলিশের দুজন লোক গতরাতে ভর্তি হওয়া রোগীর বাড়ি লোকদের সাথে কথা বলে খাতায় নোট নিচ্ছে।
পুরনো রোগীদের হালহকিকত জানতে জানতে গোটা ইউনিট গিয়ে পৌঁছল নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের কাছে।
চিরঞ্জিত লাহিড়ীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন
‘এর কি হয়েছে?’
‘ডিস্ট্যাল ফিমার ফ্র্যাকচার।’
এক্সরে দেখতে দেখতে মন্তব্য করলেন, ‘পায়ের ভাস্কুলারিটি (রক্তসঞ্চালন) ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তাহলে আর কি? ট্র্যাকশন তো দেওয়াই হয়ে গেছে। ইনভেষ্টিগেশন পাঠাও। অপারেশনের জন্য রেডি কর।’
‘ইয়েস স্যার।’
‘কিন্তু হলো কিভাবে।’
আর এম ও বললেন, ‘ওটাই তো বোঝা যাচ্ছে না – পেশেন্ট নিজে বলছে উনি নাকি জানলা গলে পড়ে গেছে। তাও মাঝরাতে!’
‘আর কোনো ইনজুরি নেই তো?’
আমি বললাম, ‘স্ক্যাল্পে (মাথার বাইরে) একটু থেঁতলে গেছে।’
‘অজ্ঞান হয়ে গেছিল?’
‘না, তবে অ্যালকোহলিক। মদ খেয়ে ছিল।’
‘সিটি স্ক্যান করিয়ে নাও। পেশেন্টের তো মনে হচ্ছে পয়সাকড়ি আছে। বাইরে থেকে করাতে পারবে। না হলে পিজিতে পাঠাও।’
তখনো মেডিক্যাল কলেজে সিটি স্ক্যান আসে নি। রোগীকে বন্ড দিয়ে বাইরের সেন্টার থেকে সিটি করিয়ে আনলো বাড়ির লোক। কিন্তু সেই তিনজন। মা আর দুই মেয়ে। এই ধরণের রোগী ভর্তি হলে সাধারণতঃ বিভিন্ন মহল থেকে অসংখ্য অনুরোধ, চিঠি (যাকে মেডিক্যালের পরিভাষায় বলে ক্যাচ) আসতে শুরু করে আর অনেক প্রভাবশালী লোক এসে হাজির হয়। অদ্ভুতভাবে এদের সেরকম কেউ নেই মনে হচ্ছে।
(এরপর পরের পর্বে)
ছবি: অন্তর্জাল