প্রায় পনেরো ষোল বছর আগের কথা, আমার শাটল কক্ তখন আবার বড়ো হাসপাতালের কোর্টে। আউট ডোরে বসে রোগীর স্রোত সামলাচ্ছি। আমার আগের হাসপাতালের এক সিনিয়র দাদার ফোন এলো। উনি একটি বাচ্চাকে আমার কাছে পাঠাচ্ছেন। দরজা বন্ধ করার সময় আঙ্গুল ঢুকে গিয়ে বাচ্চাটি চোট পেয়েছে।
বেশ বাজে অবস্থা! আমি তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটারের নার্সদিদিকে ফোন করে সব যন্ত্রপাতি তৈরী করতে বললাম। সারা জীবনের অপারেশনে এই দিদিদের অবদান আমি কখনও ভুলবো না, যখন যা বলেছি হাসিমুখে এঁরা তা শুনেছেন এবং আমায় সাহায্য করেছেন। আমার অপারেশনের সাফল্যের সিংহভাগ কৃতিত্ব এঁদের আর আমার অ্যানাস্থেটিস্ট সহকর্মীদের প্রাপ্য। অপারেশন থিয়েটারের অন্যান্য কর্মচারীদের কৃতিত্ব ও বড় কম নয়।
যাইহোক তাড়াতাড়ি করে আউটডোর শেষ করে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম। আপৎকালীন বিভাগে আগেই বলে রেখেছিলাম বাচ্চাটিকে সোজা থিয়েটারে পাঠাতে। অল্পক্ষণ পরেই রোরূদ্যমান মা এবং বাবা সহ বাচ্চাটি এলো। বছর তিনেকের একটি বাচ্চা ছেলে, তার ডান হাতের মধ্যমা দরজার ভেতরে ঢুকে চোট লেগেছে। সেও তারস্বরে ক্রন্দনরত।
বাচ্চার মা আর বাবাকে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত করে বাচ্চাটিকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হলো। ওকে চেপে ধরে তাড়াতাড়ি আঙ্গুলের ব্লক অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে দিলাম। ব্যথা কমে যেতেই বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়লো। এবার ওর আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ খুলে দেখি আঙ্গুলের মাথাটি প্রায় ঝুলছে, নখের মাঝখান থেকে কেটে গেছে, হাড়ও কেটে গেছে। রক্তচলাচলের নালিগুলি প্রায় সম্পূর্ণ কেটে যাওয়ায় আঙ্গুল বাঁচানো প্রায় অসম্ভব!
যাইহোক হাত ধুয়ে অপারেশনে নামলাম। প্রথমেই ক্ষতস্থান ভালো করে পরিষ্কার করলাম, তারপর বিশেষ ‘নেইল রিপোজিশান স্টিচ্’ দিয়ে আঙ্গুলের ঝুলে পড়া অংশটি টুপির মতো আঙ্গুলের মাথায় বসিয়ে সেলাই করলাম। তারপর অন্যান্য অংশ ও সেলাই করে দিলাম। সাবধানে আঙ্গুলটি ব্যান্ডেজ করে ওকে ওর মায়ের কোলে তুলে দিলাম।
ওর বাবাকে বাচ্চার আঙ্গুলের অবস্থা খুলে বললাম। বললাম যেভাবে আঙ্গুলের মাথা কেটে ঝুলে পড়েছে এই আঙ্গুলটির ওই অংশ না বাঁচাই স্বাভাবিক তাও আমি আমার যথাসাধ্য করেছি। যা হবে, তা দুএক দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। শুনে ভদ্রলোকও এবার কেঁদেই ফেললেন।
বাচ্চাটিকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। পরদিন রাউন্ডে গিয়ে বাচ্চাটির আঙ্গুল ভালো করে পরীক্ষা করলাম। কিন্তু ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে যেটুকু অংশ খোলা রেখেছিলাম তা দেখে ভালো করে বুঝতে পারলাম না। বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই ফিরে এলাম।
পরদিন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ব্যান্ডেজ খুললাম, অবাক বিস্ময়ে দেখি আঙ্গুলের মাথা কালো হয়নি, গোলাপিই আছে। অর্থাৎ প্রকৃতি মা কোন ভাবে আঙ্গুলটি বাঁচিয়ে রেখেছে।
বাচ্চাটিকে আরো কদিন ওয়ার্ডে রেখে ছুটি দিয়ে দিলাম। ও একদিন অন্তর মা বাবার সাথে আসত অপারেশন থিয়েটারে ড্রেসিং করার জন্য। আগেও বলেছি হাতের অপারেশনের ড্রেসিং আমি চিরকাল নিজের হাতে করেছি এবং তা অনেকবারই আমায় সাহায্য করেছে। আস্তে আস্তে ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেল, সেলাই কেটে দিলাম, তারপরও দুএকদিন ড্রেসিং করতে হয়েছিল। ড্রেসিং করার সময় বাচ্চাটি রোজই তারস্বরে চেঁচাতো আর হাতপা ছুঁড়তো। ওইভাবেই ড্রেসিং করতে হতো। শেষদিন যেদিন ড্রেসিং করে বাচ্চাটিকে বললাম ‘ যা, তোকে আর আসতে হবে না’।
দেখি ও কান্না থামিয়ে একটু হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম ‘কিছু বলবি?’ ও বললো ‘তোমায় মারবো।’
বাচ্চা রোগীদের আমায় মারার ইচ্ছা প্রকাশ অবশ্য এই প্রথম নয়। আসলে সেই অপারেশনের দিন ইনজেকশন থেকে শুরু করে একদিন অন্তর ড্রেসিং এবং তদ্জনিত যন্ত্রণা সবকিছুর জন্য এই অতীব দুষ্টু লোকটিই দায়ী এই ধারণা বাচ্চাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। আমার শ্যালকের শিশুপুত্রের হাত ভাঙ্গলে তার প্লাস্টার আমি করেছিলাম। সেও অপারেশন টেবিলে ঘুম ভেঙ্গে প্রথম কথাই বলেছিল, ‘আমি আমার পিসেমশাইকে মারবো’। তার সে আশা অবশ্য পূরণ হয়নি। তাই এই বাচ্চাটির আশাভঙ্গ করতে ইচ্ছে হলো না। আমি তাকে বললাম, ‘মার’।
সে তৎক্ষণাৎ অপারেশন টেবিলে দাঁড়িয়ে পড়ে আমায় কিল, চড়, ঘুষি যদৃচ্ছা মেরে গেল। রোগী সেরে ওঠার পর এই অপরূপ নগদ বিদায় অবশ্য আমার এই প্রথম।
এই ঘটনার প্রায় মাসখানেক পরে ওই বাচ্চাটির মা তাঁর রক্তাপ্লুত হাত নিয়ে আমার কাছে এসে হাজির। দা দিয়ে নারকেল কাটতে গিয়ে এই বিপত্তি। ওঁকেও দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলাম। হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দেখি উনি নিজের বাঁ হাতের তর্জনীর মাথা নখ এবং হাড় কেটে আক্ষরিক অর্থেই প্রায় নামিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও আঙ্গুলের ওই ছিন্ন অংশ বাঁচানো খুবই মুশকিল। যাইহোক আমার বিদ্যেয় যে টুকু কুললো সেই মত অপারেশন করে আঙ্গুল ব্যান্ডেজ করে দিলাম। আমি এই আঙ্গুল বাঁচবে বলে আশা বিশেষ করিনি। ওঁকে এবং ওঁর স্বামীকেও সেকথাই বললাম। আমার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করেছি, এবার বাকিটা প্রকৃতির হাতে। ওই অংশটি পচে গেলে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে।
ওঁকে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলাম। ইনজেকশন ইত্যাদি যা যা দেওয়ার সবই দেওয়া হল। দুদিন পরে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ খুলে এবারও অবাক হয়ে গেলাম। আঙ্গুলের ছিন্ন অংশটি বেঁচে আছে !
দুচারদিন ড্রেসিং করে ওঁকে ছুটি দিয়ে দিলাম। ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেলে সেলাই কাটা হলো। শেষ ড্রেসিং করে যেদিন বললাম যে ওঁকে আর আসতে হবে না, উনি বললেন ‘ডাক্তারবাবু আমি আর নারকেল খাবো না’। আমি বললাম ‘নিশ্চয়ই খাবেন, তবে আঙ্গুল বাঁচিয়ে’।
অল্পদিনের ব্যবধানে মাতাপুত্রের এই আঙ্গুল বেঁচে যাওয়া, প্রকৃতি মায়ের এই অকৃপণ দাক্ষিণ্য আমায় চমৎকৃত করেছিল।
তোমার প্রজাপতির পাখা, আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপনমাখা, তোমার চাঁদের আলো মিলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান।
তোমার লেখা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকি l
অনেক ধন্যবাদ দাদা, প্রণাম নেবেন।
অনেক ধন্যবাদ।
ছবি তোলা না কথায় ছবি আঁকা, কোনটা বেশি সুন্দর? সব গুলিয়ে যায়।
অসামান্য!
হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা থৈথৈ করছে। “মানুষ প্রহর জাগে মানুষের মনে।” আমার এত্ত আদর!
অনেক ধন্যবাদ দাদা, প্রণাম নেবেন।