সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যৌনকর্ম নিয়ে এক নির্দেশিকায় বলেছে—যখন যৌনকর্মী প্রাপ্তবয়স্ক এবং স্বেচ্ছায় যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করছেন তখন পুলিশ অবশ্যই তাঁর কাজে বাধা দেবে না এবং কোন ফৌজদারি ব্যবস্থা নেবে না। যখন কোন যৌনকর্মী ফৌজদারি/যৌন/অন্য কোন অপরাধের অভিযোগ করছেন, তখন পুলিশকে সেই অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বেশ্যালয়ে রেডের সময় যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা, শাস্তি দেওয়া বা অন্য কোনোভাবে বিব্রত করা চলবে ন্ কেন না স্বেচ্ছায় যৌনকর্ম বেআইনি নয়, কেবল বেশ্যালয় চালানো বেআইনি।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আমাদের বারবার যাঁর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তিনি ডা স্মরজিৎ জানা। ঠিক এক বছর আগে কোভিড 19 আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে তাঁকে।
যৌনকর্মীদের নিয়ে এক বিশাল সংগঠন গড়ে তোলা, তাঁদের কথাকে ভাষা দেওয়া এসবের জন্যই স্মরজিৎদার খ্যাতি। কিন্তু আমরা যারা তাঁকে চিনি আরো বেশি দিন ধরে, তাদের কাছে মানুষটির আরো অনেক পরিচয় আছে।
স্মরজিৎ জানা (১৯৫২–২০২১) ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। কলেজে স্টুডেন্টস এসোশিয়েসনে সক্রিয় ছিলেন, এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে তিনি বহু আন্দোলনে যোগ দেন এবং বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকেন। এই সময় ‘বীক্ষণ’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন – গল্প এবং কবিতা। তারপর প্রিভেন্টিভ এন্ড সোশ্যাল মেডিসিন (বর্তমানের কমিউনিটি মেডিসিন)-এ এমডি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ থেকে। এমডি পড়ার সময় স্মরজিৎদা থাকতেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিরিবাবু লেন হোস্টেলে প্রদীপ (সাহা)-জ্যোতি (জ্যোতির্ময় সমাজদার)-সুরজিৎ (বিশ্বাস)-দের ঘরে। সেই সময় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।
সেই সময়টা প্রবল সামাজিক আলোড়নের—গণবিজ্ঞান আন্দোলন, গণস্বাস্থ্য আন্দোলন, যুক্তিসঙ্গত ওষুধ নীতির দাবিতে আন্দোলন। স্মরজিৎদা এসবে নেতৃস্থানীয় ছিলেন। লিখতেন ‘উৎস মানুষ’-এর প্রত্যেক সংখ্যায়, ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’-তে। তাঁর লেখার একাধিক সংকলন উৎস মানুষ থেকে প্রকাশিত হয়ে মানুষজনকে যুক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রেরণা যুগিয়েছে। ‘ওষুধের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য ওষুধ’ এই স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলা ‘ড্রাগ একশন ফোরাম, ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর অন্যতম সংগঠক তিনি। ফোরামের পত্রিকা ‘ড্রাগ ডিজিজ ডক্টর’-এর সম্পাদনার ভারও সামলেছেন কিছুদিন অধ্যাপক পি কে সরকারের পর। ১৯৮৪-র ভোপাল গ্যাস কাণ্ডের পর গ্যাস পীড়িতদের সঠিক তথ্য জানার অধিকার, সঠিক চিকিৎসার অধিকারের আন্দোলনের পাশে ছিলাম আমরা বাংলার জুনিয়ার ডাক্তাররা। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্মরজিৎদা।
স্মরজিৎদা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ সার্ভিসে কিছুদিন কাজ করেন, কিছুদিন কাজ করেন ইএসআই-তে। সেই সময় ইএসআই প্রকল্পে শ্রমিকদের কিকি পাওয়ার কথা আর তাঁরা কি পাচ্ছেন তা নিয়ে এক অতি প্রয়োজনীয় পুস্তিকা তাঁর লেখা।
এরপর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেলথ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন তিনি। সে সময় সারা পৃথিবী জুড়ে এইচআইভি-এডস এর আতঙ্ক। এই মহামারীর সংক্রমণ প্রধানত যৌন সংসর্গে। যৌনকর্মীদের সংগঠিত করে তাদের উদ্যোগে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনার এক অভিনব মডেল গড়ে তোলেন তিনি, সোনাগাছি প্রজেক্ট নামে যার পরিচয়। আর এই প্রজেক্ট তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ আমি ছত্রিশগড়ে, সেখানকার শহীদ হাসপাতালে আমার সহকর্মী শৈবালদা (জানা) ও আশীষদা (কুন্ডু) স্মরজিৎদার সহপাঠী। কলকাতায় এলে যে দু-তিন জনের সঙ্গে প্রতিবার দেখা করতাম কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে, নতুন আইডিয়া পেতে তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্মরজিৎদা।
কলকাতায় আমার ফিরে আসার পর যোগাযোগ কিছুটা ক্ষীণ হয়েছিল, কারণটা তাত্ত্বিক। স্মরজিৎদা ও তাঁর গড়ে তোলা সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি যৌনকর্মকে শ্রমের মর্যাদা, যৌনকর্মীদের শ্রমিকের অধিকার দেওয়ার দাবি তুলেছেন আর আমরা অনেকে চাইছি এমন একটা সমাজব্যবস্থার লক্ষ্যে কাজ করতে যে সমাজ ব্যবস্থায় বেশ্যাবৃত্তি বিলুপ্ত হবে।
সেই মতপার্থক্য থেকে গেলেও এটা অনস্বীকার্য যে গণিকাদের মুখে তিনি ভাষা যুগিয়েছেন, তাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। গণিকাদের সন্তানের জন্য আবাসিক হোস্টেল, তাদের পরিচালিত ঊষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক, গণিকাদের উদ্যোগে দুর্গাপুজো, তাদের সন্তানদের ফুটবল দল, দুর্বারের পত্রিকা—দুর্বার ভাবনা, তাদের প্রকাশন সংস্থা—সবই অভিনব।
স্মরজিৎদা সরকারি চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন, দুর্বারের ছিলেন প্রধান পরামর্শদাতা।
গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলনে স্মরজিৎদাকে পাওয়া গেছে বারবার। ডা বিনায়ক সেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিনায়ক সেন মুক্তি মঞ্চ-এ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে দুর্বার। আদিবাসী শিক্ষিকা সোনি সোরির মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা সোনি সোরি মুক্তি মঞ্চ দুর্বারের সঙ্গে আমাদের অন্য বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভালোভাবে কাজ করেছে। সমর সেনের গড়ে তোলা ফ্রন্টিয়ার সাপ্তাহিক যখন মট লেনের দপ্তর ছেড়ে উদ্বাস্তু হলো তখনো সাথ দিয়েছেন স্মরজিৎদা। দুর্বারের একটি ঘরে এখন ফ্রন্টিয়ারের দপ্তর।
আমাদের কয়েকজনের উদ্যোগে নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট থেকে ২০০৬- এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা’। আমাদের আক্রমণের তীর ছিল দুর্বারের তত্ত্বের দিকে। তাতো স্মরজিৎদার না জানার কথা নয়, কেননা তাঁর এক সাক্ষাৎকারে ছিল বইটিতে। তারপরও একসঙ্গে কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। গণসংগঠনগুলোকে নিয়ে ডেঙ্গু মহামারী মোকাবিলার এক স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা কিছু মানুষ, সেই স্বপ্নকে সাকার করতে স্মরজিৎদা এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের হেলথ ওয়েব ম্যাগাজিন ‘ডক্টরস’ ডায়ালগ’-এ একাধিক বার লিখেছেন তিনি কোভিড অতিমারী প্রসঙ্গে।
স্মরজিৎদাকে যেভাবে হারালাম তা নিয়ে নিজেদের ওপর ক্ষোভ থেকে যাবে সারা জীবন। কোভিড নিয়ে যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন, অক্সিজেনের মাত্রা কমার পর যেখানে তাঁকে ইনটিউবেট করার মত যোগ্য আরএমও ছিলেন না, সে হাসপাতালের পরিকাঠামো সম্পর্কে আমরা তো জানতাম আগেই। কেন স্মরজিৎদাকে বারণ করলাম না?!
আর স্মরজিৎদার মৃত্যুর পর দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি-তে যা শুরু হয়েছে তাও আমরা যারা স্মরজিৎদার বন্ধু তাদের জন্য কষ্টকর। ক্ষমতালিপ্সু কিছু মানুষ দুর্বার থেকে স্মরজিৎদার স্মৃতিকে মুছে ফেলতে চাইছে, তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ ছিল ঊষা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে, সেই টাকা পাচ্ছেন না তাঁর পরিবার। গণিকাদের জমা করা লক্ষ লক্ষ টাকা মারা গেছে, তাদের টাকায় কেনা দুর্বারের সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
এসব কিছুর কিছুটা দায় কি বর্তায় না স্মরজিৎদার ওপর? নিজের আশেপাশে, সংগঠনে কারা ঘোরাফেরা করছে, কারা ক্ষমতায় উঠছে—তাদেরকে চিনতে পারেননি তিনি? তিনি যখন থাকবেন না, তখনকার জন্য দ্বিতীয় সারির সংগঠক কোথায়?
এসব সত্ত্বেও এক জীবনে ৬৯ বছরে যা যা করে গেলেন তিনি, তার জন্য ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। আর মনে রাখব আমরা যাঁদের তিনি মেডিকেল ছাত্র আন্দোলন থেকে গণস্বাস্থ্য আন্দোলনে আসতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
এই লেখাটির ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ ‘একশ তারার আলো’-এ প্রকাশিত।
স্মরজিৎ কে আমিও কিছু কথা বলেছিলাম। সেসব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এমনটা যা ঘটবে তা অনুমান করা গেছিল অনেক আগেই। সম্প্রতি হোমের রিপোর্ট পেলাম। খুবই দুঃখজনক।
তবুও বলি ওর কাজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার দাবি রাখে।